জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি কী ইউরোপকে পরিবেশ বান্ধব পরিবহন দেবে?

পোস্টটি দেখেছেন: 37 প্রীতিলতা বিশ্বাস প্রাককথন: ২০২২ সালের মার্চ থেকে সমগ্র ইউরোপ জুড়েই সাধারণ মানুষ যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে সাইকেল বা গনপরিবহন ব্যবস্থার সাহায্য নিচ্ছেন। মে মাস পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুসারে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ এই পরিবর্তনে সামিল হয়েছেন। ইটালি, জার্মানি এবং আয়ারল্যান্ডের সরকার মানুষকে এই পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাসের ভাড়া […]

প্রীতিলতা বিশ্বাস

প্রাককথন: ২০২২ সালের মার্চ থেকে সমগ্র ইউরোপ জুড়েই সাধারণ মানুষ যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে সাইকেল বা গনপরিবহন ব্যবস্থার সাহায্য নিচ্ছেন। মে মাস পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুসারে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ এই পরিবর্তনে সামিল হয়েছেন। ইটালি, জার্মানি এবং আয়ারল্যান্ডের সরকার মানুষকে এই পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাসের ভাড়া কমিয়ে দিয়েছে। ই-বাজারে পুরোনো সাইকেল বিক্রির পরিমান বেড়ে গেছে অনেকটাই। গাড়ির ক্ষেত্রেও পেট্রল বা ডিজেল চালিত গাড়ি বিক্রি করে অনেকেই ব্যাটারি চালিত গাড়ির খোঁজ করছেন। এই পরিবর্তনের তাৎক্ষণিক কারণ জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। আর এই মূল্যবৃদ্ধির পিছনের কারণটি হল রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ, যেটাকে পশ্চিমি সংবাদ মাধ্যম ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বলে উল্লেখ করে থাকে। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে বিচার করলে ইউরোপবাসীর এই পরিবর্তনের ধারা আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন অনেকেই। প্রকৃতই কতটা আশার আলো আছে সেটা খতিয়ে দেখতেই এই লেখার প্রচেষ্টা।

গাড়ি শিল্প যুদ্ধ:

গাড়ি শিল্প প্রথম শুরু হয় ১৮৯৩ সালে কিন্তু প্রথম অবস্থায় বিষয়টি খুবই সময় সাপেক্ষ থাকায় লাভজনক ছিল না একেবারেই। বিশ শতকের প্রথম দশকে আমেরিকার হেনরি ফোর্ড উৎপাদনে ‘সমাবেশ লাইন’-এর প্রচলন করেন। অর্থাৎ একই কারখানার বিভিন্ন বিভাগে তৈরী হওয়া অংশ জুড়তে জুড়তে এসে শেষমেষ এক জায়গায় সম্পূর্ণ গাড়িটি রূপ পাবে। এই পদ্ধতিতে প্রচুর মানুষ দরকার হয়। এই গণ উৎপাদন পদ্ধতিকে হাতিয়ার করে আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরে গড়ে উঠল বিশালাকার ফোর্ড কোম্পানি আর তাকে কেন্দ্র করে ডেট্রয়টের গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, ব্যস্ততার নগর সভ্যতা। গাড়ি শিল্পের বাড়-বাড়ন্ত ধাক্কা খেল ১৯২৯-এর বিশ্ব মন্দার সময়। অনেক শহরে ফোর্ড কোম্পানির কারখানা বন্ধ করে দিতে হল।

১৯৪০, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বিতীয় বছর। দ্রুত যুদ্ধের অস্ত্র ও পরিবহন তৈরী করা প্রয়োজন। রুজভেল্ট আহ্বান করলেন—Arsenal for Democracy. মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল ফোর্ড কোম্পানি। যুদ্ধের জন্য জীপ গাড়ি থেকে বিমান সবই ফোর্ড কোম্পানিতে বানানো হল। সেই সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্রও। কয়েক বছর সাধারণের জন্যে গাড়ি বানানো বন্ধ থাকল। আর কোম্পানির বন্ধ হয়ে যাওয়া সব কারখানা আবার চালু হয়ে গেল। মন্দা কাটিয়ে আমেরিকার অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার এল।

যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে বিধ্বস্ত অর্থনীতি। গঠিত হল IMF, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সহ ‘ব্রেটেন উড সিস্টেম’ এর নতুন অর্থ ব্যবস্থা। ইউরোপ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হল। সহায় আবার গাড়ি শিল্প। ইউরোপের প্রধান রপ্তানী পণ্য হয়ে উঠল গাড়ি। আভ্যন্তরীন বাজারে খুব একটা বিক্রি করা হত না। কারণ এই গাড়ি রপ্তানীকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে তখন। আভ্যন্তরীন পরিবহনে গণ পরিবহন ব্যবস্থাকে ইউরোপ সেইজন্য প্রথম থেকেই গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি যখন আরও বিকশিত হতে চাইল তখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র তার বাহন হল। স্বাধীনভাবে নিজেদের যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত গাড়ি, যাত্রী পরিবহনকারি বাস নয়। ২০২২-এর ১-লা এপ্রিলে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, ইউরোপে প্রতি বছর ১২.১ মিলিয়ন মোটর যানবাহন তৈরী হয় যার ৮০ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি, ভ্যান ১৩.৮ শতাংশ, ট্রাক ৩.৯ আর মাত্র ০.২ শতাংশ বাস। রপ্তানি এখনও গুরুত্বপূর্ণ, এ ছাড়াও আভ্যন্তরীন বাজারে যায় অনেকটাই। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই জীবনে জ্বালানি তেল তাই ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু তাতেই আবার বাঁধ সেজেছে যুদ্ধ।

রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ:

ইউরোপের মোট প্রয়োজনীয় জ্বালানি গ্যাসের ৪৫ শতাংশ এবং জ্বালানি তেলের ২৯ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। এই গ্যাস সরবরাহ করার জন্য রাশিয়া ইউক্রেনের সম্মতিতে তার ভূতল ব্যবহার করে পাইপ লাইন বসায়। কিন্তু এই পাইপ লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা নিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেনের দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২০০৫-সাল থেকে। বিষয়টির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব দ্বিপাক্ষিক স্তরে এর সমাধান হতে দেয় না। ২০১৪ সালে আমেরিকার মদতে ইউক্রেনে অভ্যুত্থান হয় এবং আমেরিকার পছন্দের সরকার গঠিত হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যা আরও গভীর হয়। রাশিয়া বাল্টিক সাগরের তলা দিয়ে গ্যাসের পাইপ লাইন বানানো শুরু করে। নর্ড স্ট্রিম ১নং দিয়ে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছায় বর্তমানে। নর্ড স্ট্রিম ২নং-এর চুক্তি জার্মানি আপাতত স্থগিত রেখেছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর অংশ হিসাবে অবরোধ স্বরূপ।

দুটি নর্ড স্ট্রিম দিয়ে যদি রাশিয়া তার জ্বালানি পশ্চিম ইউরোপে সরবরাহ করতে পারে তাহলে সমগ্র ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ শক্তিশালী হবে। জ্বালানি তেলকে কেন্দ্র করে আমেরিকার বিশ্বব্যাপী ডলার সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে যায় রাশিয়া-জার্মানির এই পদক্ষেপ। তাই শুরু হয় ন্যাটো সম্প্রসারণের নাটক। রাশিয়া-ইউক্রেন পরস্পরের সঙ্গে ১,৪২৬ মাইল সীমারেখা দিয়ে যুক্ত। আর আমেরিকা ৫,৭০৫ মাইল দূর থেকে ইউক্রেনে তার আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ইউরোপের শস্যভান্ডার হিসাবে পরিচিত ইউক্রেনের মানুষ, প্রকৃতি দুই-ই আজ বলির পাঁঠা। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সমাধানের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হিসাবে যুদ্ধটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর আজও আমেরিকা Arsenal for Democracy-র দোহাই দিয়ে ইউক্রেন-পোল্যান্ডের সীমানা থেকে ইউক্রেনকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে যায়, লেজুড় হয় ন্যাটো।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন। ছবি হিন্দুস্থান টাইমস ভায়া এপিএফ

যুদ্ধে আমেরিকার লাভ:

 ইউরোপে LNG বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের সব থেকে বড় সরবরাহকারি দেশ হল আমেরিকা। ঐতিহাসিক ভাবে এশিয়ার তুলনায় কম দামে ইউরোপকে এই গ্যাসের সরবরাহ দিত আমেরিকা। কিন্তু এখন সেই পার্থক্য ঘুচেছে। ফলে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। বিপুল পরিমানে অস্ত্র বিক্রি করা গেছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলিতে এবং ইউক্রেনকে। ন্যাটোর সম্প্রসারন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃদ্ধির লক্ষ্য সফল হয়েছে। রাশিয়ার উপর অবরোধ পরোক্ষে ভেনেজুয়েলা, নিরাকাগুয়া ও কিউবার উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কাজ করবে। নিজের দেশে বাইডেনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ বেড়েছে যা আগামীদিনের যুদ্ধকে নিশ্চিত করবে। পশ্চিম ইউরোপ বাধ্য হয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক অবরোধ তৈরী করতে। ধাক্কা খেয়েছে ইউরোপের অর্থনীতি যার কেন্দ্রে রয়েছে গাড়িশিল্প। কারণ প্রয়োজনীয় ধাতুগুলির অনেকটাই ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানি করা হত, যা এখন বন্ধ আছে।              

২০২০-সালে আমেরিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নিয়েছে। প্রথমটি হল পৃথিবীব্যপী ৬.৬ মিলিয়ন কিলোমিটার রাস্তা তৈরী। যে প্রজেক্টের নাম road network worldwide.  যার লক্ষ্য হল mass motorizations. ২০২২-সালের হিসাব অনুসারে আমেরিকার ৭৬ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির এবং বাকি ১৯ শতাংশ অফিসের গাড়ির সুবিধা ভোগ করছে। road vehicles  আর তার spare parts -এর বিক্রি থেকে আমেরিকার রাজস্ব আদায় হয় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই খন্ডচিত্র থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে আগামী দিনে আমেরিকা গাড়িশিল্পের ব্যবসাকে নিয়ে কীভাবে অগ্রসর হতে চাইছে। এমনিতেই আমরা জানি, ফোর্ড কোম্পানির হাত ধরে আমেরিকার যে অটোমোবাইল শিল্পের যাত্রা শুরু, সেই অটোমোবাইল শিল্পের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন দেশে তৈরী হয় ১৯৯১-এর পর থেকে, তৃতীয় বিশ্বের সস্তাশ্রম যার প্রধান জ্বালানি।

দ্বিতীয় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব রাজনীতির নিরিখে। আমেরিকা তার Army, Navy, Marine corps, Air Force এবং Coastal Guard এই পাঁচটিকে একত্র করে  Joint Vision 2020 নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে, যার ভাষ্যটি নিম্নরূপঃ

Dedicated individuals and innovative organizations transforming the joint force for the 21st century to achieve full spectrum dominance:

  • Persuasive in Peace
  • Deceive in War
  • Preeminent in Any Form of Conflict.    

উপরের দুটি বিষয় থেকে একটি জিনিস পরিষ্কার যে আমেরিকা তার ‘একমেবম অদ্বিতীয়ম’ হবার লক্ষে কতটা দৃঢ়সংকল্প যার হাতিয়ার হিসাবে থাকবে গাড়িশিল্প, প্রয়োজনে যা যুদ্ধাস্ত্র তৈরীতে রূপান্তরিত করা যায় খুব সহজেই।

কেন গাড়িশিল্প এত গুরুত্বপূর্ণ:

এই শিল্পের পূর্ববর্তী অনুসারী শিল্প—স্টীল ও অন্যান্য ধাতু শিল্প, বিভিন্ন রাসায়নিক তৈরীর শিল্প, এবং টেক্সটাইল শিল্প। পরবর্তী অনুসারী শিল্প—ICT( information and communication technology), মেরামত এবং পরিবহন। ইউরোপে প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ ভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে ১৩.৮ মিলিয়ন মানুষ। GDP-এর ৭ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। অন্যদিকে আমেরিকায় গাড়ি ও তার যন্ত্রাংশ তৈরীর সঙ্গে যুক্ত ৯,২৩,০০০ জন এবং ডিলারের সঙ্গে যুক্ত ১২,৫১,৬০০ জন। GDP-এর ৩ শতাংশ আসে এখান থেকে। আর ভারতের কোনো নিজস্ব ব্র্যান্ড না থাকলেও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা ১৯ মিলিয়ন। ইউরোপের মতোই GDP-এর ৭ শতাংশ আসে এই শিল্প থেকে। এর সঙ্গে পূর্ব ও পরবর্তী অনুসারী শিল্পে নিযুক্ত মানুষের কথা বিবেচনা করলে বলা যায় পুঁজিবাদি অর্থনীতি গাড়ি চেপেই গড়গড়িয়ে চলছে।

গাড়িশিল্প পরিবেশ:

গাড়িশিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্পাত তৈরী হয় লৌহ আকরিক থেকে, যা রপ্তানিতে ভারত দ্বিতীয় স্থানে আছে। স্পঞ্জ আইরন ও পিগ আইরন দুটি পদ্ধতিতে লোহা নিষ্কাশন করা হয়। ভারতে নিষ্কাশিত লৌহের ৮৬ শতাংশ স্পঞ্জ আইরন পদ্ধতিতে তৈরী হয়। অতিরিক্ত দূষণ সৃষ্টির কারণে একে dirty industry  বলা হয়। এছাড়াও প্রয়োজন হয় প্যালাডিয়াম, নিকেল, অ্যালুমিনিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি ধাতু। প্রত্যেকটি ধাতু নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমানে জল খরচ হয় এবং জল ও বায়ু দূষণ হয়। এরপর গাড়ি তৈরীর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বিদ্যুৎ নির্ভর যা জ্বালানি তেল অথবা কয়লা নির্ভর হওয়ায় গ্রীন হাউস গ্যাস উৎপাদন করে। অর্থাৎ গাড়িশিল্পে প্রতিটি গাড়ি তৈরী হয়ে রাস্তায় নামার আগেই যথেষ্ট পরিমান দূষণের জন্ম দেয়। গাড়ির চাকা যখন ঘুরতে শুরু করে তখন নতুন করে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরী হতে শুরু করে। শুধুমাত্র এই পর্যায়ের দূষণকে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করে ব্যাটারি চালিত গাড়ির পক্ষে বিশ্ব জুড়ে জনমত গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তাহলে এবার দেখে নেওয়া যাক গাড়ির ব্যাটারির জন্য কি প্রয়োজন।

গাড়ির ব্যাটারির জন্য প্রয়োজন লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, গ্রাফাইট। এগুলিকে ক্রিটিকাল মৌল বলা হয়। আমেরিকার গাড়শিল্পে ব্যাটারির জন্য আফ্রিকার কঙ্গো থেকে কোবাল্ট নেওয়া হয়, যা শিশু শ্রমিক দিয়ে খালি হাতে সংগ্রহ করা হয়। ইতিমধ্যেই মানবাধিকার কর্মীরা এই নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। একটন লিথিয়াম মাইনিং এ ১৫ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃস্বরণ হয়। এরপর সবকটি ধাতু নিষ্কাশনে আগের মতোই প্রচুর জল খরচ ও জল এবং বায়ু দূষণ হয়। ব্যাটারি নির্দিষ্ট সময় অন্তর রিচার্জ করার জন্য বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন। এই শক্তি সৌর, বায়ু বা জল থেকে উৎপন্ন না করা গেলে তা পুনরায় গ্রীন হাউস গ্যাস উৎপাদন করবে। সৌরশক্তিকে পেতে তার যে প্যানেল তৈরী করতে হবে তারজন্য পৃথকভাবে ধাতু প্রয়োজন। বাতিল ব্যাটারি ও সৌর প্যানেলের পুনর্নবিকরণের জন্য বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন, অর্থাৎ সম্ভাব্য গ্রীন হাউস গ্যাসের উৎস। বস্তুত বর্তমান প্রজন্মের lCV(internal combustion vehicles) এর তুলনায় সামগ্রিক ভাবে ZEV(zero emission vehicle) এর সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের নিঃস্বরণ বাড়বে। শুধু ১ শতাংশ CO2 এর নিশ্বরণ ২০৫০-সাল নাগাদ কমতে পারে, যা বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে তেমন কোন ভূমিকা রাখবে না। সুতারাং শুধুমাত্র গাড়ির চাকা ঘুরে কতটা CO2 নিঃস্বরণ হচ্ছে তাকেই বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সে প্রসঙ্গে একটু বাদে আসছি। এখন দেখে নেব ‘zero emission’-এ পৌঁছানোর লক্ষ্যে আমেরিকার গাড়িশিল্প কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।

আমেরিকার ZEV পরিকল্পনা:

নরওয়ে, নাদারল্যান্ডস ২০২৫ সালে lCV বিক্রি বন্ধ করে দেবে বলে ঘোষণা করেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স ২০৪০-এ আর ভারত ২০৩০-এ lCV বিক্রি বন্ধ করে দেবে। কিন্তু আমেরিকা সামগ্রিকভাবে সেরকম কোন সময় ঘোষণা করে নি। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার সরকার ২০১৮ সালে ঘোষণা করেছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ মিলিয়ন ZEV রাস্তায় নামাতে হবে। সেই সঙ্গে ২০০ হাইড্রোজেন জ্বালানি স্টেশন এবং ২৫০,০০০ ZEV চার্জিং স্টেশন তৈরী হবে। হাইওয়েতে পর্যাপ্ত চার্জিং স্টেশন থাকা প্রয়োজন। এই সব ধরনের পরিকাঠামো নির্মান এবং ZEV কেনার জন্য দামের ছাড় বাবদ ফেডারেল ট্যাক্স ও স্টেট মিলিয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করবে। আগেই উল্লেখ করেছি ২০২০ সালে নেওয়া mass motorizations-এর প্রজেক্ট। অর্থাৎ আগামী দিনে বিপুল পরিমান lCV গাড়ি বাতিল হয়ে পাহাড় প্রমাণ আবর্জনায় পরিণত হবে। যার থেকে ধাতুকে পুনরায় ব্যবহার করার যোগ্য করে তোলার জন্যও বিপুল শক্তির প্রয়োজন।

ইউরোপের বর্তমান অবস্থা:

ইউরোপে গাড়িশিল্পে সবথেকে শক্তিশালী দেশ জার্মানি, তারপর ব্রিটেন। কোভিড কালীন সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের সব দেশই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গেছে। গাড়িশিল্পে শক্তিশালী দেশগুলিকে এই যুদ্ধ যথেষ্ট বিপাকে ফেলেছে, প্রধানতঃ জার্মানিকে। নর্ড স্ট্রিম ২ বন্ধ রাখতে হয়েছে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। আমেরিকা তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়িশিল্পের supply chain অর্থাৎ যন্ত্রাংশ এবং কাঁচামাল যার অনেকটাই ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আসত তার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যোগানও বন্ধ আছে। নতুন প্রজন্মের ICV –যেগুলো কার্বন নিঃস্বরণ অনেকটাই কম করে তার উৎপাদন ধাক্কা খেয়েছে ব্যাপক ভাবে। এদিকে ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম আসত ইউক্রেন থেকে, তা বন্ধ আছে। ফলে ইউরোপে গাড়ি তৈরীর খরচ অনেক বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে আমেরিকা ZEV -তে ভরতুকি দিয়ে দাম কমিয়ে রাখতে পারবে। কাজেই আগামী দিনে গাড়ি রপ্তানিতে ইউরোপের পিছিয়ে যাওয়ায় খুব স্বাভাবিক সম্ভাবনা যদি না গাড়িশিল্পের Research and Development Unit নতুন কিছু আনতে পারে।

ইউরোপ একদিকে নিজের দেশে মানুষকে সাইকেল বা গণ পরিবহনে যাতায়াত করতে উৎসাহিত করছে এবং কার্বন নিঃস্বরণ কমানোর দাবি করছে আবার আর একদিকে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরী করছে যা দূষণের মাত্রাকে বৃদ্ধি করছে।

কার্বন নিঃস্বরণ কমানো যেতে পারে কীভাবে:

যখন একজন ব্যক্তি সাতজন বসতে পারে এরকম একটি গাড়ি চালিয়ে একা অফিসে যান, তখন সেটা তার আর্থিক সামর্থের মধ্যে থাকলেও মানব সমাজের জন্য চুড়ান্ত প্রাকৃতিক অপচয়। গাড়িটি তৈরী হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে, জীবাশ্ম জ্বালানি প্রাকৃতিক সম্পদ যা ব্যবহার করে গাড়ি চলে, আবার সেই জ্বালানি দহনের ফলে বায়ু দূষণ ঘটে। এই সমগ্র বিষয়টি শুধুমাত্র একজন মানুষের জন্য হয়, যখন ঐ একই প্রাকৃতিক ব্যয় সাতজন মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারত। কাজেই ব্যক্তিগত গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়ার অর্থ প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করা। প্রয়োজন গণ পরিবহন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। যাতে মানুষ যে কোনো জায়গায় এই পরিষেবার সুবিধা পেতে পারে। গণ পরিবহন ব্যবস্থা একক বিচ্ছিন্ন মানুষকে সামাজিক করে তুলতে পারে। কিন্তু মানুষের সামাজিক হয়ে ওঠার সঙ্গে পুঁজির বৃদ্ধির একটি সরাসরি বিরোধ আছে। মানুষ যত পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে তত বেশি পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করার সুযোগ তৈরী হবে অর্থাৎ তত বেশি লাভ ও পুঁজির বৃদ্ধি সুনিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে তত বেশি পরিমানে প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা ব্যবহার করে ফেলব এবং প্রকৃতিতে দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকবে।

কিন্তু গণ পরিবহনের সহজ রাস্তা ফেলে রেখে বিশ্ব উষ্ণায়নের দোহাই দিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলি ZEV তৈরী করছে যা বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়ের বিনিময়ে নতুন বিশ্ব বাজার তৈরী করবে। শেয়ার বাজারে টাকা ক্রমে ফুলেফেঁপে ওঠে—ভবিষ্যতে উৎপাদন হলে সেই পণ্য বিক্রি হয়ে কত লাভ দিতে পারে তাকে বর্তমানে বসে কল্পনা করে টাকা তুলে নেওয়া হয় বাজার থেকে। যে পুঁজির সঙ্গে উৎপাদনের কোনো যোগ থাকে না, সেই কাল্পনিক পুঁজির জন্য দরকার নতুন ধরনের পণ্যের বাজার। ZEV সেই বাজার তৈরী করবে। গ্রীন এনার্জি, নীল আকাশ ইত্যাদি কথার ফাঁকিতে ঢাকা থাকবে প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার ও মানব সম্পদের অপচয়ের কাহিনী।    

লেখক পরিচিতি:

প্রীতিলতা বিশ্বাস গণিতের ছাত্রী এবং শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। বিগত কয়েক বছর যাবত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।

Contact:  biswaspritilata2017@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top