অক্ষয়কুমার দত্ত : যেতে যেতে একলা পথে

পোস্টটি দেখেছেন: 55 অনিরুদ্ধ দত্ত “কন্যা ও পুত্রের পাণিগ্রহণ সম্পন্ন হইবার পূর্বে পরস্পর সাক্ষাৎকার, সদালাপ উভয়ের স্বভাবগত ও মনোগত অভিপ্রায় নিরুপণ, সদ- সৎ চরিত্র পরীক্ষা ও প্রণয় সঞ্চার হওয়া আবশ্যক। “ এমন আধুনিকমনস্ক কথা বলছেন অক্ষয়কুমার দত্ত, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে। জন্ম বিদ্যাসাগরের সঙ্গে একই বছরে (১৮২০)। অথচ তিনি স্বল্প-পরিচিত ও বিস্মৃতপ্রায় । […]

অক্ষয় কুমার দত্ত

অনিরুদ্ধ দত্ত

“কন্যা ও পুত্রের পাণিগ্রহণ সম্পন্ন হইবার পূর্বে পরস্পর সাক্ষাৎকার, সদালাপ উভয়ের স্বভাবগত ও মনোগত অভিপ্রায় নিরুপণ, সদ- সৎ চরিত্র পরীক্ষা ও প্রণয় সঞ্চার হওয়া আবশ্যক। “

এমন আধুনিকমনস্ক কথা বলছেন অক্ষয়কুমার দত্ত, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে। জন্ম বিদ্যাসাগরের সঙ্গে একই বছরে (১৮২০)। অথচ তিনি স্বল্প-পরিচিত ও বিস্মৃতপ্রায় ।

  একলা পথিক

বিদ্যাশিক্ষার কৌলিন্য অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, বিদ্যালয়ের ডিগ্রিও তাঁর ছিল না। অল্পশিক্ষিত পরিবারে জন্ম। ছোটবেলায় বাবা মারা যান। আত্মীয়দের অবহেলায় বড়ো হওয়া। অনেকটা বেশী বয়সে বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হ’লেও দু’-আড়াই বছরের মধ্যেই বিদ্যালয় ছেড়ে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু পড়াশুনা নিজের মতো করে চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি প্রকৃতই ছিলেন স্ব-শিক্ষিত।

বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভাবনা ছিলো যুগের থেকে এগিয়ে। প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই অক্ষয় কুমার দত্তকে কোন প্রতিষ্ঠানের অংশ হতে দেয়নি। আর যুক্তিমনস্ক ও বস্তুবাদী দর্শনের পক্ষে যারা কথা বলেন তারা সাধারণভাবেই সংখ্যালঘু। অক্ষয় কুমার এই সংখ্যালঘুদেরই একজন। বিশিষ্ট দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অক্ষয় দত্তকে যেভাবে দেখেছিলেন তা তাঁর মত অনুসারে,” অক্ষয় দত্ত ছিলেন বিজ্ঞান-পাগল মানুষ, আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে একরোখা উত্সাহের মাশুল হিসাবে তাঁকে কার্যত একঘরে হতে হয়েছিল, হারাতে হয়েছিল চাকরি।  প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে যাতে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বলে তাচ্ছিল্য করা না হয়, তার জন্য অক্ষয়কুমার তাঁর জীবনসায়াহ্নে ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার মূল খুঁজতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থতা এবং অকালপ্রয়াণের ফলে সে অনুসন্ধান অসমাপ্ত থেকে যায় “(বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অনুবাদ:আশীষ লাহিড়ী)।

 গবেষণা গ্রন্থ:

১৮৮৬ সালে তিনি মারা যান। তবে জীবনের শেষ বেশ কয়েকটা বছর প্রবল শিরঃপীড়া তাঁকে শয্যাশায়ী করে রেখেছিল। যদিও এই সময়েও  অসীম শারীরিক কষ্টের মধ্যেই তিনি রচনা করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠতম গবেষণাধর্মী কাজ ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম ও ২য় খন্ড), ৩য় খন্ডের কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি—-

১ম খন্ড ১৮৭০ সালে ও ২য় খন্ড তের বছর পর ১৮৮৩ সালে, মৃত্যুর তিন বছর আগে। এই গবেষণা গ্রন্থ H H Wilson রচিত Religious Sects of the Hindus (1862)  গ্রন্থটির দ্বারা প্রভাবিত হ’লেও সে সময়ে ভারতে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত একাধিক বই, টীকাভাষ্য, নানা সম্প্রদায় প্রকাশিত বিভিন্ন টীকার বিস্তৃত বিবরণ ইত্যাদি নানা আকরগ্রন্থ তিনি ব্যবহার করেন। এর ফলে উইলসনকৃত ৪৩ টি সম্প্রদায়ের বিবরণ অক্ষয়কুমার দত্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিস্তৃতি ও সংযোজিত হয়ে ১০৬ টিতে দাঁড়ায়।

তাঁর সমসাময়িক জীবনীকার ও অনুরাগী মহেন্দ্রনাথ রায় লিখছেন, “… কখন কখন সন্ন্যাসী ও বৈরাগী দলের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদের আমূল-বৃত্তান্ত এবং প্রকাশ্য ও গুহা-ক্রিয়ানুষ্ঠান বিষয়ে কথোপকথন করিতেছেন। ” আজ যাকে ক্ষেত্র-সমীক্ষা বলে আমরা চিনি, অক্ষয়কুমার দত্ত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনে তা প্রায় দুশো বছর আগেই চালু করে যান এদেশে। গ্রন্থদুটির উপক্রমণিকা মোট চারশো তেতাল্লিশ পৃষ্ঠার যা বইটির অন্যতম সম্পদ।

 হীরা-মানিক জ্বলে

উপক্রমণিকা অংশের বিস্তৃতি ও গভীরতা খুব বেশী। সে বিষয়ে  মননশীল আলোচনায় লেখার স্থান ও লেখকের সামর্থ্য উভয় বিচারেই ঘাটতি থাকায় কিছু উদ্ধিতির আশ্রয় নিতে হ’লো :

” রামচন্দ্রকে বিষ্ণু- অবতার বলিয়া প্রতিপন্ন করা প্রচলিত রামায়ণের প্রধান উদ্দেশ্য বোধ হয় কিন্তু প্রথমে উহার সেরূপ উদ্দেশ্য ছিল এরূপ বলিতে পারা যায় না”।

” মনুসংহিতায় রাম [ও] কৃষ্ণের নাম-গন্ধও নাই। অতএব রামায়ণ ও মহাভারতে রাম, কৃষ্ণ, পরশুরামাদির যে ঐশী শক্তি বর্ণিত হইয়াছে, তাহা মনুসংহিতা সঙ্কলনের কল্পিত হইয়াছে বোধ হয়”।

মনুসংহিতার বিশ্লেষণ উপক্রমণিকায় বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে উপস্থিতি। প্রায় ২০০ বছর আগে বাঙলায় সামাজিক অবস্থার অতি দুর্দশা  দেখে বিদ্যাসাগর ইত্যাদি অন্য অনেকের মতোই তিনিও ছিলেন অত্যন্ত দুঃখিত।

একদিকে প্রাচীনত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একদল মানুষের আপ্রাণ চেষ্টা, অন্যদিকে  দেশের মানুষকে ব্রিটিশ রাজের  রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে কেরানি বানানোর জন্য পরিকল্পনা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আধুনিক শিক্ষা অনুরাগী মানুষের জ্বালা তিনিও অন্তরে বহন করতেন। এমনকি মনুসংহিতার মধ্যেও যেটুকু সেই সময়কালে মানুষের জন্য হিতাকাঙ্ক্ষা ছিল, তাঁর বিচারে তিনি সমকালীন (১৯ শতক) সময়ে তার অভাব দেখেছেন–” সে সময়ের হিন্দুসমাজ সর্ব্বাংশে বিশুদ্ধ ছিল না–কিন্তু– এক্ষণকার অপেক্ষা উত্কৃষ্ট ছিল। উহার [হিন্দু সমাজের] কি অধোগতিই না আসিয়াছে।  এখন বিধবা-বিবাহ রহিত, আসবর্ণ-বিবাহ রহিত, গান্ধর্ব-বিবাহ রহিত, স্বয়ংবর-বিবাহ রহিত, বাল্যবিবাহের প্রাদুর্ভাব ও কৌলিন্য-প্রথার পৈশাচী কান্ড”।

তবে মনুবাদীদের উল্লাস থমকে যেতে বাধ্য যখন মনুসংহিতা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন–” ব্রাহ্মণের প্রভুত্ব একেবারে গগন স্পর্শ করিয়াছিল “।

শূদ্র পুরুষের সঙ্গে ব্রাহ্মণ কন্যার বিবাহ (প্রতিলোম বিবাহ) কঠোর সামাজিক শাসনের মুখোমুখি হ’তো। তাদের সন্তান চন্ডাল হবে এমনটাই ছিল নির্দেশ। এই সন্তান সম্পত্তির অধিকার পেত না এবং সমাজে প্রবলভাবে নিগৃহীত হতো।

এই গ্রন্থে ষড় দর্শন আলোচনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আলোচনা পর্বে তিনি এই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে এই সমস্ত ‘ সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ’ দার্শনিকরা, যারা ” তত্ত্বানুসন্ধানের প্রকৃত পথালম্বনপূর্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞানমার্গে বিচরণ করিতে পারিতেন,  তবে…  ভারত-ভূমিও ইউরোপ- ভূমির ন্যায় এ অংশে ভূস্বর্গ পদে অধিরূঢ হইতেন…”। এর কারণ তাঁর মতে একজন পথপ্রদর্শকের অভাব। তিনি লেখেন–

 ” একটি বেকন্-একটি বেকন্- একটি বেকন্ তাহাদের আবশ্যক হইয়াছিল”।

 বিজ্ঞান দর্শন: বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে

বেকন্ এর উল্লেখ, অর্থাৎ ফ্রান্সিস বেকন্-কে আলোচনায় টেনে আনাটা অক্ষয়কুমার দত্তের বিজ্ঞানমনস্কতার স্পষ্ট প্রমাণ। বেকন বিজ্ঞানী ছিলেন না। প্রচলিত অর্থে অক্ষয়কুমারও নন। বেকন্,  বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সত্যে উপনীত হওয়াকে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেন। অর্থাৎ আরোহী (inductive) পদ্ধতি তাঁর কাছে ছিল সত্যে পৌঁছানোর রাস্তা। অক্ষয়কুমার দত্তের আগ্রহও সেই পথেই। নানা পথ পরিক্রমা সেরে তিনি এখানে এসে পৌঁছান। প্রকৃতি সম্পর্কে কোনরকম আগে থেকে ঠিক করা চিন্তা প্রনালীর বিরোধী ছিলেন বেকন্। তিনি ছিলেন,  ‘স্থূল অভিজ্ঞতাবাদী’ (জে. ডি. বার্নাল)।

অক্ষয়কুমার দত্তের এপথের যাত্রায় উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ও সেসময়কার জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’ ছেড়ে আসা। পরিনতিতে আমরা পাই হাওড়া জেলার বালি শহরে গঙ্গার ধারে তাঁর বসতবাটি ও তার অন্তর্গত ‘শোভন উদ্যান’ যা বিজ্ঞানের একটি সংগ্রহশালা ও নানা বিরল গাছের উদ্যান হিসাবে সুপরিচিত ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহীদের কাছে (বর্তমানে বিলুপ্তির দোরগোড়ায়) । মৃত্যুর সময় পর্যন্ত এই বাড়িতেই তিনি ছিলেন। বাঙলার নবজাগরণের প্রায়-বিস্মৃত এই সেনানীকে ‘বাঙলায় এম্পেরিসিস্ট বিজ্ঞানচর্চার জনক’ হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং অক্ষয়কুমার দত্তের বসতবাটিকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আশীষ লাহিড়ী এই অসময়ে আমাদের কৃতজ্ঞ করছেন। অক্ষয়কুমার দত্তের মতো বিরল ব্যক্তিত্বকে বিস্মরণ জাতি হিসাবে লজ্জার একথা বলাটা বাহুল্য হবে না।

তথ্যসূত্র :

১) অক্ষয়কুমার দত্ত এবং উনিশ শতকের বাংলায় ধর্ম ও সমাজচিন্তা — অসিতকুমার ভট্টাচার্য।

২) আঁধার রাতে একলা পথিক— আশীষ লাহিড়ী।

৩) জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা (৭৩ তম বর্ষ, পঞ্চম – ষষ্ঠ সংখ্যা)।

৪) পরিপ্রশ্ন পত্রিকা (২য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top