শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
“একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
………….
বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।
— শঙ্খ ঘোষ
খুদে ছেলে বাবলু মণ্ডলের স্বপ্ন সে একদিন বিরাট কোহলির মতো বিরাট বড়ো ক্রিকেটার হবে। খেলার শিক্ষক সতত উৎসাহ দেন, বন্ধুরা ভুরু নাচিয়ে পিঠে হাত রেখে বলে, চালিয়ে যা, তোর ঠিক হবে। বিস্তর ঘাম ঝরায় ছেলেটি প্রতিদিন। বিরাট সে হবেই। টিভির বিজ্ঞাপনে বাবলু দেখে, তারই বয়েসের একটি ছেলেকে স্বয়ং বিরাট স্যর কোচিং করাচ্ছে। তবে শুধুমাত্র ছেলেটি আর বিরাট কোহলি নয়, বুস্ট নামের এক পানীয়র ভূমিকা রয়েছে সেখানে। সেই পানীয়র দু ঢোক খেয়ে সমস্ত ব্যার্থতা কাটিয়ে আস্তে আস্তে সফল হয়ে উঠছে ছেলেটি। স্ট্যামিনা বাড়ছে, তীক্ষ্ণ হচ্ছে তার আই-সাইট। প্রতিদিন এক ঢোক দুই ঢোক বুস্টে চুমুক দিয়ে বিরাট কোহলি হয়ে ওঠার দিকে সে এক ধাপ, দুই ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। টিভির বিজ্ঞাপনে হাস্যময় বিরাট কোহলির জমজমাট উপস্থিতিতে বিভোর হয়ে বাবলু নিজের মনেই বলে ওঠে, বুস্ট ইস দ্য সিক্রেট অফ মাই এনার্জি। হরলিক্স, কমপ্ল্যান খারিজ হয়ে ঘরে জায়গা করে নেয় এনার্জি ড্রিংক বুস্ট। দেখার মতো বিষয় হল, এই বুস্টের বোতলের ভিতর যে উপাদান মজুত তা প্রাণহীন অজৈব পদার্থের এক উপাদেয় মিশ্রণ মাত্র। কিন্তু ছেলেটির বিশ্বাস তার মধ্যেই গোপন রয়েছে অতিলৌকিক ক্ষমতায় ভরা এক ঐন্দ্রজালিক চাবিকাঠি যার ছোঁয়ায় সে হয়ে উঠবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার। বিজ্ঞাপনও সেই কথাই বলছে।
বুস্ট নামের পানীয়ই হোক বা নাইকির জুতো অথবা ডেল কম্পানীর ল্যাপটপ, এইসবই হল পণ্য (commodity) যা বাজারে টাকার বিনিময়ে কেনা যায়। প্রথম দৃষ্টিতে এই পণ্যকে মনে হয় একটা তুচ্ছ বস্তু যা নেহাৎই সহজবোধ্য কিন্তু গভীরে গিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, এই পণ্য আসলে আধিবিদ্যক (metaphysical) রহস্যে ভরা অতি অদ্ভুত এক পদার্থ।
যতদূর পর্যন্ত সেটির একটি ব্যবহারিক উপযোগিতা রয়েছে, যে ব্যবহারিক গুণগুলির দ্বারা সে মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম এবং দ্রব্যটির মধ্যের সেই গুণগুলি আসলে মানুষেরই শ্রমের ফসল ততদূর পর্যন্ত রহস্যময়তা বলে আদপে কিছু নেই। এখন কাঠের রূপ বদলে যদি টেবিল তৈরি হয় তাহলে পরিবর্তিত বস্তু হিসেবে তা কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কাঠই থেকে যায়। এই একই কথাই খাটে বুস্ট, ল্যাপটপ বা আইফোনের অন্তর্গত প্রকৃতিজাত উপাদানগুলির ক্ষেত্রেও। কিন্তু যেই মুহূর্তে তা পণ্যের চেহারা নিয়ে বিলাসবহুল শপিংমলে চমৎকার কাচের দেয়ালের পেছনে শোভা পেতে শুরু করে তা সঙ্গে সঙ্গে যেন বদলে যায় অতীন্দ্রিয় একটা কিছুতে। সেইসব প্রাণহীন দ্রব্যগুলির অজৈব মগজ থেকে এমন সব কিম্ভূতকিমাকার ধারণা বেরিয়ে মানুষের মনে গিয়ে অভিঘাত সৃষ্টি করে যেখান থেকে জন্ম নেয় সেই পণ্যকে ঘিরে বিরাট কোহলি বা মার্ক জাকারবার্গ হয়ে ওঠার সুতীব্র এক আকাঙ্ক্ষা। যখন এই আকাঙ্ক্ষায় ভর করে ক্রেতা তার কল্পনার জগতে মশগুল তিনি আদৌ জানতে পারেন না, যে সকল কারখানায় এই জুতো, পানীয় বা ল্যাপটপ প্রস্তুত হয় সেখানে ১৬-১৭ বছরের শিক্ষানবিশ ছাড়াও নিয়োগ করা হয় ১৮-২৫ বছর বয়সী মেয়েদের যারা সপ্তাহে প্রায় ৮৩ ঘন্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অস্বাস্থ্যকর এক পরিবেশে। অল্প জায়গার কারখানাগুলিতে প্রায় ১০০০ শ্রমিক কাজ করে সপ্তাহে ৬৮ ঘন্টারও বেশি। কারখানার জঘন্য খাবারের দাম বাদ দিয়ে তারা মজুরি পায় যৎসামান্য। শোয়ার জন্য ডরমিটরিতেই বেশিরভাগ মানুষ থাকেন। ছোট ছোট প্লাস্টিকের বালতিতে গরম জলে চলে কাকস্নান। মাসে গড়ে দুদিন ছুটি মেলে বা কখনও তাও না। কাজের সময় অন্য শ্রমিকের সঙ্গে গল্প করলে দেড়দিনের মাইনে পর্যন্ত কাটা যায়। আবার অন্যদিকে এই সকল শ্রমিকেরা যাদের শ্রমের ফসল হল এই ল্যাপটপ বা এনার্জি ড্রিংক তারাও জানতে পারেন না কে বা কারা এই ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে বসেই পৃথিবীর যাবতীয় কাজ সেরে নিচ্ছেন বা ইচ্ছেমতো যখনতখন পানীয় খেয়ে চনমনে মন নিয়ে মাঠেঘাটে ছক্কা হাঁকাচ্ছেন। দু পক্ষ থেকেই কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও সরাসরি যোগাযোগ ঘটল না। কোনও কথাবার্তা, একে অপরের প্রতি সম্মান বিনিময় তেমন কিছুই ঘটল না অথচ বাজারে সেই পণ্যটির বিনিময়ের মাধ্যমে একটি সামাজিক সম্পর্কে তারা জুড়ে গেলেন। এই সম্পর্ক অবশ্যই সামাজিক কিন্তু তা মোটেও মানুষের সঙ্গে মানুষের নয়। সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছে একটি পণ্য। নেহাতই একটি প্রাণহীন জিনিস। তবে একথা পরিস্কার যে, বাবলু সেই পানীয়টি হাতে নিয়ে বুঝতে পারে, অনেক মানুষের সম্মিলিত শ্রমের মাধ্যমেই তা তৈরি কিন্তু তাদের পরিচয় সম্পর্কে কোনও মূর্ত ধারণা বাবলুর তৈরি হয় না। হাতে পড়ে থাকে কিছু মানুষের হাতে গড়া সেই পানীয় জিনিসটি। বাবলুর চোখে এই মানুষগুলি এক বিমূর্ত জগতের বাসিন্দা হলেও বাস্তব সেকথা বলে না। কিন্তু মূর্ত দৃষ্টিতে দেখলে, এই সকল মানুষের শ্রমের যোগফল হল সমাজের সমগ্র শ্রম। যেহেতু উৎপাদকেরা পরস্পরের সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করে না, যতক্ষণ না তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় ঘটে, কাজেই প্রত্যেকটি উৎপাদকের নিজস্ব শ্রমের যে সামাজিক চরিত্র আছে তারও অভিব্যক্তি বিনিময় ছাড়া হয় না। মোদ্দা কথা এই যে, বিনিময় ক্রিয়াটি পণ্যগুলির মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে, এবং সেগুলির মধ্য দিয়ে উৎপাদকের মধ্যে পরোক্ষভাবে যে সম্পর্ক স্থাপন করে, একমাত্র সেই সম্পর্কের সাহায্যেই ব্যক্তির শ্রম সমাজের শ্রমের অংশ হিসেবে নিজেকে জাহির করে। সুতরাং উৎপাদকের কাছে একজনের শ্রমের সঙ্গে বাকি সকলের শ্রমের যোগসূত্র ল্যাপটপ বা এনার্জি ড্রিংক তৈরিতে ব্যস্ত মানুষগুলির মধ্যে প্রত্যক্ষ সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে দেখা দেয় না, বরং দেখা দেয় সেগুলি প্রকৃতই যা সেই হিসেবেই, মানে, ব্যক্তিদের মধ্যে বস্তুগত সম্পর্ক এবং বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে। এই সত্যকে আড়াল করে মনোরম বিজ্ঞাপনে মিথ্যে প্রচার করে সারা পৃথিবী জুড়ে যে কোটি কোটি পণ্য ডালা সাজিয়ে বসেছে তার জন্যই তো মানুষ ভিড় করছে বাজারে। পণ্যকে ঘিরেই মানুষের উত্তুঙ্গ আবেগ, তাকে ঘিরেই যেন সামাজিক সম্পর্কগুলির পুনরুৎপাদন। মাটি, জল, উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ, মানুষের যাবতীয় সম্পর্ক, প্রেম, ভালোবাসা, ধর্ম সবকিছুই পণ্য বানিয়ে তোলার প্রয়াসে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সমগ্র মানবসমাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এই পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা। এই বিজ্ঞাপন আমাদের মনোভূমির বিস্তৃত অঞ্চল দূষিত করেছে। বিরামহীন বিজ্ঞাপনে এইসব পণ্যের আক্রমণ আমাদের তাড়িয়ে বেরায় মাঠে ঘাটে বন্দরে, ব্যক্তিগত পরিসরে, শৈশব থেকে বার্ধক্যে, ভোর থেকে রাত, সোম থেকে রবি, মায়ের কোল থেকে শ্মশান পর্যন্ত। পণ্যের দিকে ছুটে যাওয়ার এই আচরণ কিন্তু মোটেও মানবপ্রকৃতির প্রতিফলন নয়। আরও আরও ভোগ করার এই প্রবণতা মানুষের জন্মগত হতে পারে না। বস্তুত, এই ঝোঁক কেবলই পণ্য নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষাতে সীমাবদ্ধ নয়, এটা এক ধরনের সংস্কৃতি, একটা অভ্যাস, একটা তৈরি করা ভ্রান্ত বিকৃত জীবনবোধ। এই জীবনবোধে বিশেষ দিনে মন্দির মসজিদে যে নিবিড় ভক্তি নিয়ে মানুষ ভিড় করে ঠিক তেমনই অদম্য এক মোহের তাড়নায় পণ্যের ওপর বিশেষ ছাড় উপলক্ষে সে ছুটে যায় বিশ্ব-বাজারের দিকে।

বাবলু যখন বুস্ট নামের এনার্জি ড্রিংকে চুমুক দেয়, তার মনে বিরাট বড়ো ক্রিকেটার হওয়ার যে গভীর আস্থা ঝিলিক মেরে ওঠে ঠিক সেরকম অনুভব দেখা দেয় তার মায়ের মধ্যেও যখন তিনি ঠাকুরঘরে বসে ঈশ্বরের মূর্তির সামনে প্রণাম করে বলে ওঠেন, সবই তোমার ইচ্ছে ভগবান। অতএব ঈশ্বরের মহিমা যেমন রহস্যময়, পণ্যের মহিমাও তুলনামূলক কম রহস্যময় নয়। ঈশ্বর মানুষের মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন, পণ্য মানুষের হাতে গড়া অথচ এই দুটি মানুষকেই নিয়ন্ত্রণ করছে কোনও এক অতিলৌকিক ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতায় যার কোনও ব্যাখ্যাই নেই ঈশ্বর এবং পণ্যভক্ত মানুষের কাছে।
নব্বইয়ের দশকে নাইকি একটি পণ্যকে নারীবাদের প্রতীক হিসেবে প্রচার করেছিল। সেই পণ্যের পায়ে গলিয়ে নেওয়ার সঙ্গে নারীবাদের সম্পর্কের রহস্যময়তার আড়ালে সচেতনভাবে গোপন করা হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার কারখানায় সেই পণ্য প্রস্তুতকারক নারীদের অবর্ণণীয় কাজের অবস্থা। যে ফুটবল তৈরি করতে পাকিস্তানের শিশু শ্রমিকদের চূড়ান্ত শোষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা ঢাকা পড়ে যায় ক্রেতা যখন মোটা টাকার বিনিময়ে চমৎকার দেখতে সেই ফুটবলটিকে ততোধিক চমৎকার দোকান থেকে কিনে নিয়ে যান। পৃথিবীর প্রত্যেকটি পণ্য, তা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ায় সেলোফেনে মোড়া সুস্বাদু মাংসই হোক বা আইফোন, সেই পণ্য উৎপাদনের নেপথ্যে থাকে মানুষের ব্যক্তিগত শ্রমের অমানবিক শোষণ এবং শ্রমিকের নিবিড় সমাজ বিচ্ছিন্নতাবোধ। কিন্তু ঝকঝকে বিজ্ঞাপনে সেইসব পণ্যকে সুদর্শন সেলেব্রিটিদের হাতে ধরিয়ে তাকে ফেটিসাইস (fetishize) করে দেখানো হলে স্বভাবতই তার নেপথ্যে থাকা শোষণ মানুষের বোধগম্য হয় না। সেই পণ্যটি কিনে নেওয়ার মধ্যেই যেন সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। ২০১১ সালে আমেরিকান টিনেজারদের অনেকেই ভেবেছিল নাইকির জুতো পরে তারা মাইকেল জর্ডনের মতো উড়ে গিয়ে বাস্কেটের ভিতর বলটিকে পুরে দেবে অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। তেমনই তো দেখানো হয়েছে বিজ্ঞাপনে। দশ বছর পরে হোয়াইট হ্যাট জুনিয়র নামের একটি অ্যাপের বিজ্ঞাপনেও তো দাবি করা হয়েছে এই অ্যাপের সাহায্যে কম্পিউটার কোডিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শিখে তারা অচিরেই বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গ হয়ে উঠতে পারেন।
এই অ্যাপের বিজ্ঞাপনে ‘learn math visually’ কথাটি প্রচার করে গ্রাফিক্সের সাহায্যে সরল সমীকরণ সমাধান শেখানোর কৌশল ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। এমন নয় যে এই পদ্ধতিটি ব্ল্যাকবোর্ডে চকের সাহায্যে কোনও বিদগ্ধ শিক্ষক শেখাতে অপারগ। অঙ্কের মাস্টারমশায়ের কথা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে গণিতজ্ঞ হতে দরকার গণিত বিষয়টির প্রতি ভালোবাসা এবং কঠোর অনুশীলন। এখানে মাস্টারমশাই ও ছাত্রের সম্পর্কে কোনও পণ্যের ভূমিকা নেই। কিন্তু হোয়াইটহ্যাট জুনিয়র অ্যাপের প্রচারকদের কথা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গের মতো ধনকুবের হতে কিনতে হবে অর্থের বিনিময়ে এই অ্যাপটি। এই বিনিময় সংগঠিত হলেই ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক। এখানে শিক্ষকের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় এই অ্যাপটি। শুধু তাই নয়, এই অ্যাপটি তৈরি করতে ডিজিটাল শ্রমিকদের যে পরিমাণ শ্রমের অতিশোষণ জড়িয়ে আছে তা সেই অ্যাপ মোবাইলে ইন্সটল করলে আদপেই ধরা পড়ে না, অথচ তাদের সকলের সঙ্গেই অ্যাপ ব্যবহারকারী কত ছেলেমেয়েরা এক পরোক্ষ সামাজিক সম্পর্কে যুক্ত হয়ে পড়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বাদ দিয়েই। কেবলমাত্র অর্থের বিনিময়ে পাওয়া সেই অ্যাপের মাধ্যমেই। এ এক আশ্চর্য সামাজিক সম্পর্ক! পুঁজিবাদের অন্তর্গত এই ভূতগ্রস্ত অযৌক্তিক বাজারি চাহিদা জাত আত্মসাতের দর্শনের সঙ্গে মানবসমাজের শাশ্বত স্বভাবের কোনো সম্পর্কই নেই।
পণ্যেরা যদি কথা বলতে পারত, তাহলে তাদের মধ্যে কথোপকথন অনেকটা এইরকম হতো। ধরা যাক, করোনাকালে কালোবাজারে রাখা একটি ভ্যাকসিন ও একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের মধ্যে কথাবার্তা চলছে যাদের বাজারদর মানুষের বিপন্নতার সঙ্গে সমানুপাতিক। ভ্যাক্সিন বলল, আমাদের ব্যবহার মূল্য মানুষকে কাছে টেনে আনার মতো একটা জিনিস হতে পারে কিন্তু বস্তু হিসেবে তা আমাদের কোনও অংশই নয়। যা আছে তা কেবলই বিনিময় মূল্য। ভাই অক্সিজেন, নিজেদের চোখে আমরা বিনিময় মূল্য ছাড়া কিছুই নই। পণ্য হয়ে যেভাবে বাজারে আমাদের টাকার বিনিময়ে আদান-প্রদান হচ্ছে তাতে তারই তো প্রমাণ। একথা শুনে অক্সিজেন বলে ওঠে, কেন ভাই ভ্যাক্সিন, ব্যবহার মূল্য নেই কেন বলছ। কত লোক তোমাকে রক্তে প্রবেশ করিয়ে স্বস্তির শ্বাস নিচ্ছে আর আমাকে সেই শ্বাসপ্রক্রিয়ায় মিশিয়ে অক্সিজেনের অভাব মেটাচ্ছে। এ তো আমাদের ব্যবহারই হল আর তা আমাদের ব্যবহার মূল্য আছে বলেই। তাই না? ভ্যাক্সিন উত্তরে বলে, ব্যাপারটা কী জানো, আমরা পণ্য হিসেবে আমাদের মালিকের কাছে কোনও ব্যবহার মূল্য নই, যদি তাই হতো তাহলে থোড়াই আমাদেরকে বাজারে রেখে আসত। সে তো নিজের কাজেই ব্যবহার করতে পারত। কেবলমাত্র যে সকল মানুষ আমাদের মালিক নয় তাদের কাছেই আমাদের ব্যবহার মূল্য আছে। সুতরাং আমাদের হাত বদল হতেই হবে আর এই হাত বদলই হল আমাদের বিনিময়। এই বিনিময়ের ভিতরেই আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। আমাকে কালোবাজারি করে যে বিপুল অর্থ আমার মালিক অর্জন করল সেই টাকার বিনিময়ে তোমাকে কিনে আবার সে হয়ত কালোবাজারে ছড়িয়ে দেবে পুনরায় হাত বদলের জন্য। মানুষের ব্যবহারের জন্য আমাদের যতই চাহিদা থাকুক যতক্ষণ না আমাদের বাজারে বিনিময় হচ্ছে আমরা অব্যবহৃত অবস্থায় দোকানেই পড়ে থাকব। জেনে রেখো ভাই অক্সিজেন, এই একই নিয়মে আমাদের মতোই যেকোনও পণ্যকে ব্যবহার মূল্য হিসেবে কাজে লাগার আগে মূল্য হিসেবে তাকে বিক্রি হতেই হবে।
এবার পণ্যকেন্দ্রিক এই সামাজিক সম্পর্কের বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে একটু কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যাক। কল্পনায় জায়গা করে নিক স্বাধীন ব্যক্তিদের এক সম্প্রদায়ের ছবি। সেখানে আলাদা ব্যক্তির শ্রমশক্তি সম্প্রদায়ের সম্মিলিত শ্রমশক্তি হিসেবে সচেতনভাবে প্রযুক্ত। এই মানুষগুলির শ্রম ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক। জনহীন দ্বীপে রবিনসন ক্রুসোর মতো ব্যক্তিগত শ্রম নয় যা তার কেবলমাত্র নিজের ব্যবহারের বস্তুর জন্যই প্রয়োগ করা হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের মোট উৎপাদ হল সামাজিক উৎপাদ। এই উৎপাদের একটা অংশ ব্যবহার করা হয় উৎপাদনের উপায় হিসেবে যা সামাজিক থেকে যায়, আর অন্য অংশটি সেই সম্প্রদায়ের সকল মানুষের জীবনধারণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলত তাদের মধ্যে এই অংশটির ভাগ-বাঁটোয়ারা প্রয়োজন। এই ভাগ-বাঁটোয়ারা কি সকলের জন্য সমান হবে? তা মোটেও নয়। এর রকমফের হবে সম্প্রদায়টির উৎপাদনী সংগঠন এবং উৎপাদনকারীদের অর্জিত ঐতিহাসিক বিকাশের মাত্রা অনুযায়ী। জীবনধারণের উপায়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত উৎপাদকের অংশ নির্ধারিত হয় তার শ্রম সময় দিয়ে। সেক্ষেত্রে শ্রম সময় দুটো আলাদা ভূমিকা পালন করে। একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিকল্পনা অনুসারে তার বন্টন সম্প্রদায়টির বিভিন্ন ধরনের করণীয় কাজ ও বিভিন্ন চাহিদার মধ্যে একটা উপযুক্ত অনুপাত রক্ষা করে চলে। অন্যদিকে, তা অভিন্ন শ্রমে প্রতি ব্যক্তির অংশের এবং ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য নির্দিষ্ট মোট উৎপাদের অংশে তার ভাগের পরিমাপ হিসেবেও কাজ করে। সেখানে তাদের শ্রম এবং শ্রমজাত দ্রব্য এই উভয় বিষয়েই ব্যক্তিগত উৎপাদকের সামাজিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ সরল এবং সহজবোধ্য, এবং তা শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রে নয়, বন্টনের ক্ষেত্রেও। প্রকৃতির থেকে কতটুকু গ্রহণ করে কতটুকু অংশ ফিরিয়ে দিলে সামাজিক সম্পর্কের সঙ্গে প্রকৃতিরও পুনরুৎপাদন সম্ভব এবং যার মধ্যে দিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্কের পুনরুৎপাদন ঘটবে তার সবই থাকবে সামাজিক পরিকল্পনার আওতায়। এই সামাজিক পরিকল্পনায় মানুষের আকাঙ্ক্ষা কোনও ঐন্দ্রজালিক পণ্যের দিকে ধাবিত নয়, কারণ বিনিময়ের জগৎ থেকে বেরিয়ে ব্যবহারিক চাহিদাই এখানে মূল। মানুষের হাতে গড়া দ্রব্য মানুষেরই নিয়ন্ত্রণে, উল্টোটা নয়। বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রেখে জৈবিক সত্তা থেকে বেরিয়ে মানবিক সত্তার পূর্ণ বিকাশ এমন সমাজেই তো সম্ভব। এমন এক সমাজ যেখানে সাহিত্য, শিল্প এবং বিজ্ঞান হাতে হাত মিলিয়ে চলবে প্রত্যেক মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিয়ে তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশের সমষ্টিগত লক্ষ্যে।
লেখক পরিচিতি:
লেখক তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী। ছোট গল্প, সমাজ- বিজ্ঞান, পরিবেশ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে নানান নিবন্ধ লেখেন নিয়মিত।
Contact:
দারুন ও সময়োপযোগী লেখা। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সত্যজিত। আমাদের অন্য লেখাগুলি পড়ুন, মতামত দিন।
সামন্ততান্ত্রিক গুরুদের সংস্কার ও ভেদশিক্ষার ফলে তাদের ছাত্ররা সামন্ততন্ত্রের দোষ আবরণ করতে এতটাই সক্রিয় হয়েছিলেন যে গোটা সমাজটাই আরো খণ্ডিত হয়েছিলো।অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের গুরুরা যন্ত্রের উদ্ভাবনার মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন,কিন্তু তাদের সফল ছাত্রদল বৈজ্ঞানিক প্রগতিশীলতার আবরণ(প্রযুক্তি) দিয়ে সমাজের খণ্ডগুলোকে শুধুমাত্র আড়ালটুকুই করেছেন কয়েক যুগ ধরে,জুড়তে পারেন নি।তাই আজকের বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের পণ্য উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত আর বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনই আধুনিক জীবনধারার প্রস্তাবক,নির্দেশক ও বিচারক।অর্থাৎ সামন্তপুঁজি চেহারা পাল্টে বেনিয়াপুঁজিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে,যেখানে দৃশ্যতই ‘গুরু’ এবং ‘ছাত্র’ উভয়েই নিখাদ পণ্য।কারণ বেনিয়াপুঁজির বিকাশের জন্য সমাজে ভেদভাবনার প্রসারএকান্ত দরকার,তাই সংস্কারকর্মে দক্ষ ‘গুরু’ প্রয়োজন আর এহেন গুরুদের নামমাহাত্ম্য প্রচারের জন্য ‘দোষ আবরণশীল’ ছাত্রও আবশ্যিক।ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ভারতভূখণ্ডে ‘বণিকের মানদণ্ড’কে ‘রাজদণ্ডরূপে’ প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য টমাস বেবিংটন মেকলে নামক ‘গুরু’কে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর প্রস্তাবিত সংস্কার এবং শিক্ষানীতি অনুসরণ করে পরবর্তী কয়েকশো বছর ধরে গোটা ভারতীয় সমাজটাই বিশ্বের বৃহত্তম ‘বাজারে’ পরিণত হয়েছে।কথাটা দুঃখের হলেও সত্যি যে অধিকাংশ শিক্ষিত ভারতীয়ই এখন কোনো না কোনো ভাবে পণ্যসংস্কৃতির ধারক,বাহক ও প্রচারক অর্থাৎ ‘গুরুর দোষাবরণশীল’,যারা আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়ে নিজেদের ক্রীতদাসত্ব জাহির করতে সদাতৎপর।ফলত শিক্ষিত দেশবাসীদের অধিকাংশই বাজারী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে একে অপরের মূল্যায়ন করে আর অর্থোপার্জনই তাদের শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।