সুভদ্রা চন্দ
আজকের বিশ্বে এঙ্গেলসের তাৎপর্যকে বুঝতে হলে মার্কসের থেকে পৃথক করে তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। ১৮২০ সালে ২৮শে নভেম্বর তদানীন্তন প্রুশিয়ার রাজধানী বারমেন শহরে এক শিল্পপতির পরিবারে তাঁর জন্ম হয়।
মার্ক্স এঙ্গেলসের যৌথ জীবনের প্রথম ভাগ
তরুণ হেগেলিয়ানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁদের যৌথ যাত্রা শুরু। হোলি ফ্যামিলিতে তাঁরা একসঙ্গে কলম ধরেন। তাঁরা দেখান এডগার ও ব্রুনো বাউরদের ‘সাবজেক্টিভ সোশিওলজি’ কীভাবে ‘ক্রিটিক্যাল মাইন্ডেড পিপলস’ সম্বন্ধে ভাববাদী ধারণার জন্ম দিচ্ছে। ব্রুণো বাউরদের ‘cult of individual’-এর ধারণা কার্যত দেখায় কিছু ব্যক্তি হচ্ছে ইতিহাসের জন্মদাতা। এর বিরুদ্ধে মার্ক্স-এঙ্গেলস দেখান, কোনও ব্যক্তি ইতিহাসের জন্মদাতা নয়, ইতিহাসের জন্মদাতা মেহনতী মানুষ। তাই শ্রমিকশ্রেণীকে ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে তাঁরা বৈজ্ঞানিক ভাবেই দেখান। এই সিদ্ধান্তে দুই বন্ধু দুরকমভাবে উপনীত হয়েছিলেন। মার্কস এখানে বস্তুবাদী পথ হিসেবে চূড়ান্ত করেন শ্রমিক শ্রেণীর চলমান জীবনের মধ্য, এঙ্গেলস সেখানে উপনীত হন কিন্তু অন্য দিক দিয়ে, শ্রমিক শ্রেণীর জীবন থেকে। তাঁর লেখা ‘The condition of working class in England’ এই কারণেই মার্কসীয় সাহিত্যের একটা ক্লাসিক হয়ে আজও বিরাজ করছে।
এগিয়ে চলার পরবর্তী ধাপ
শুধুমাত্র তত্ত্বের বিকাশে তারা থেমে থাকেননি, শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন কোন পথে এগোবে তাকে তাঁরা সামনে আনেন ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর’ মধ্যে এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ার মধ্যে দিয়ে। ১৮৭১ সালে প্যারিসে যখন প্যারি কমিউন ঘটে, প্যারিসের শ্রমিক শ্রেণীর ওপর ইউরোপ জুড়ে যখন বুর্জোয়া শ্রেণীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তার বিরুদ্ধে প্রচার করা এবং প্যারি কমিউন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাকে সামনে এনে তাঁরা সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের ছবিটি তুলে ধরেন।
এঙ্গেলসের তাত্ত্বিক অবদান
শ্রমিকশ্রেণীকে তত্ত্বে সুসজ্জিত করার জন্য এক বিরাট কর্মযজ্ঞ গড়ে তোলেন, মার্কসের যেমন বিরাট অবদান আছে আমরা জানি, পাশাপাশি এঙ্গেলস অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এর মধ্যে বিশেষ করে ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তিনি দেখান বস্তুজগৎ শুধুমাত্র দ্বান্দ্বিকতা পূর্ণ নয় দ্বান্দ্বিকতার উৎসও। গতির ক্ষেত্রে তিনি দেখান, গতি যান্ত্রিক হোক বা তাপগতীয় হোক তা এক উন্নত দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ। শুধু তাই নয় একরূপ দ্বন্দ্ব নতুন এক দ্বন্দ্বের জননী। ডুরিং-এর যান্ত্রিক বস্তুবাদকে সমালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ এক দ্বন্দ্ব তত্ত্বের ধারণা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের ধারণা সামনে আনেন। দর্শনকে বাস্তবায়িত হতে হলে দর্শনের যে সমাপ্তি ঘটে, তা তিনি দেখান তদানীন্তন দর্শনের বিশ্ব বিখ্যাত জগত জার্মান দর্শনের বিকাশের মধ্যে দিয়ে। তার আগেই, ‘Ludwig Feuerbach and end of classical German philosophy’ এই বইতে সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে দর্শনকে কীভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে, যা German ideology নামে বিখ্যাত। এখানে মার্ক্সের সঙ্গে এঙ্গেলস হেগেল ও ফয়েরবাককে তুলে ধরেন বস্তবাদী দ্বান্দ্বিকতার বিপ্লবী দিক দিয়ে। তাঁরা দেখান কীভাবে হেগেল দ্বান্দ্বিকতার আবিষ্কারক হয়েও ভাববাদী হয়ে যান, উল্টোদিকে ফয়েরবাক কীভাবে বস্তুবাদী হয়েও দ্বান্দ্বিকতাকে অগ্রাহ্য করেন। মার্কস এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিকতাকে বিমূর্ত থেকে মূর্তে যাত্রা করিয়ে দর্শনের সমাপ্তি ঘটান। বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রের ধারণাকে সামনে আনেন ‘ইউটোপিয়া এন্ড সাইন্টিফিক সোশালিজম’ বইটির মাধ্যমে। কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিকদের সীমাবদ্ধতাকে তিনি তুলে ধরেন। তাঁদের সমাজতান্ত্রিক ধারণা যে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত তা বোঝাতে গিয়ে ব্যক্তি মালিকানার ইতিহাসকে তুলে ধরেন এবং দেখান এর থেকে কিভাবে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি হচ্ছে। এই বিষয়ে ‘The origin of the family private property and the state’ বইটি বিখ্যাত। তার আরও এক অনবদ্য বই হচ্ছে ‘The peasant war in Germany’ ।
আজকের দিনে মার্কসবাদীদের চোখে মার্ক্স এঙ্গেলসের মধ্যের তফাৎ
১) মার্কসের মৃত্যুর পর মার্কসের পুঁজি গ্রন্থের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খন্ড প্রকাশ করেন এঙ্গেলস। মার্কস যে নোটবুক রেখে গিয়েছিলেন তার থেকে রসদ নিয়ে। কিন্তু পুঁজির তৃতীয় খন্ডে ক্রেডিট সম্পর্কে মার্কস যা লিখেছিলেন আর এঙ্গেলস যেভাবে তা ব্যখ্যা করেছেন, তার মধ্যে তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। মূলত ‘credit fictitious capital’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মার্কস বলেছিলেন- “it lies outside the scope of our plan to give an analysis of credit system and the instruments this creates, as credit money etc”। এঙ্গেলস এই analysis-এর জায়গায় detailed analysis বসান। মার্কসের ‘whole plan of capital’ ছিল ‘general analysis of capital’ এবং এর বাইরে credit system কে রাখার কথা মার্কস বলেছিলেন, কারণ তা আলাদা করে ব্যাখ্যা করার দরকার মার্কস বুঝেছিলেন। আজকের বিশ্ব পুঁজিবাদে তো দেখাই যাচ্ছে ক্রেডিট এমন একটা জায়গায় গেছে যেখানে ডলারকে পর্যন্ত সোনার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী fictitious capital-এর এত রমরমা। মার্কসের সময় paper money সোনার সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রকৃত মূল্যের একটি খুঁটির সঙ্গে আটকে যাওয়ার ফলে fictitious capital অহেতুক বেশি ফেঁপে উঠলে সোনা তাকে টেনে নামিয়ে সমতা বিধান করত। কিন্তু ১৯৭১ সালে ব্রেটন উডস চুক্তি ভেঙে সোনার থেকে ডলারকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে যে fictitious রূপকে যথেচ্ছ বাড়ানো হয়েছে এই সন্দেহ তখন মার্কস করেছিলেন এবং যা capital এর সাধারণ রূপের সাথে খাপ খায় না।
২) ‘The origin of the family, private property and the state.’ এই বইটি মূলত এঙ্গেলস লিখেছেন লুইস হেনরী মরগানের ‘এনসিয়েন্ট সোসাইটি’ সংক্রান্ত মার্কসের নোটস থেকে। সেখানে জেন্ডার ইকুয়ালিটির প্রশ্নটা সামনে আনা হয়েছে সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এমন কি প্রূধোর “নারী স্বাধীনতার” বিপক্ষের অবস্থানকে সমালোচনা করে সমাজতান্ত্রিক পথের অনুসন্ধান দেওয়া হয়। কিন্তু এঙ্গেলস এই বইটিতে “with the deterministic framework ” যা বলতে চেয়েছেন তা “did not do justice to the subtlety of Marx’s notes on Morgan”। মার্কস কখনওই জেন্ডার রিলেশনকে আদর্শ করণ করতে চাননি। তিনি হেগেলের dualities and contradiction কে প্রত্যেকটি সমাজের স্তরেই ব্যবহার করেছেন, সে সমাজ যতই প্রাচীন হোক। আসলে মর্গান যে ইরিকাস সম্প্রদায়ের উপর লেখাটি তৈরি করেছিলেন, সেখানে মর্গান জেন্ডার রিলেশনকে আদর্শায়িত করে দেখেছিলেন, যা এঙ্গেলসের উপর ছাপ ফেলে।
বোঝা যায় মার্ক্স-এর প্রয়াণের পর বৌদ্ধিক নিঃসঙ্গতা এঙ্গেলস এর কাজে কিছুটা বাধা হয়েছিল। মার্ক্সের অসম্পূর্ণ লেখাগুলিকে পরিনতি দেবার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলি নেওয়ার কাজটা তাঁকে একাকী করতে হয়েছিলো যার ফলে আজকের প্রেক্ষিতে কিছু সিদ্ধান্ত ভুল বলে মনে হচ্ছে।
মার্কসবাদ সঠিক অর্থে বুঝতে হলে এই তফাত গুলিও জানা দরকার।
তথ্যসূত্র–
1- ‘Karl Marx’s Ecosocialism’ by Kohel saito
2- ‘Marx at the Margins’ by Kevin B Anderson