আজকের প্রাসঙ্গিকতায় রবীন্দ্রনাথ

পোস্টটি দেখেছেন: 29 পুলক গোস্বামী আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজায় বাঙালি অভ্যস্ত। গানে কবিতায় তাকে স্মরণ করে রবীন্দ্র পূজায় মত্ত হয়ে উঠবে বাঙালি। আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মানবতার পক্ষে তার লেখনি কিভাবে গর্জে উঠেছিল, তাকে একবার ফিরে দেখার লক্ষ্যেই এই লেখা। সভ্যতার বিকাশে ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথের অবদান […]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুলক গোস্বামী

আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজায় বাঙালি অভ্যস্ত। গানে কবিতায় তাকে স্মরণ করে রবীন্দ্র পূজায় মত্ত হয়ে উঠবে বাঙালি। আজকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মানবতার পক্ষে তার লেখনি কিভাবে গর্জে উঠেছিল, তাকে একবার ফিরে দেখার লক্ষ্যেই এই লেখা। সভ্যতার বিকাশে ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথের অবদান কতটা তা আজ বিচার করা দরকার।

মানবিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে মানুষের সাথে প্রকৃতির এবং মানুষের সাথে মানুষের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। তিনি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে কিভাবে দেখতেন? ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ নামক রচনায় তিনি লিখেছেন–

“বাইরের জগত আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আরেকটি জগত হইয়া উঠিতেছে। তাহাতে যে কেবল বাইরের জগতের রং আকৃতি ধ্বনি প্রভৃতি আছে তাহা নহে; তাহার সঙ্গে আমাদের ভালোলাগা-মন্দলাগা, আমাদের ভয়- বিস্ময়, আমাদের সুখ- দু:খ জড়িত- তাহা আমাদের হৃদয়বৃত্তির নানা বিচিত্র রসে নানাভাবে আভাসিত হইয়া উঠিতেছে। প্রত্যেকটি ব্যক্তি মানুষের মধ্যে যে আভাসখানি দেখা দেয়, সাহিত্যে তার ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় তার অনুভূতি, সমগ্র মানব সমাজের অনুভূতির সাথে মিলিত হয়ে বিশ্ব মানবিক হয়ে ওঠে”। তাঁর মতে– সমস্ত মানুষের বিশেষ মানুষ থেকে বিশ্ব মানুষে উত্তরণ ঘটবে এবং প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষ সংবেদনশীল হবে। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ থেকে শুরু করে সমগ্র সাহিত্যকর্মে যা লক্ষ্য করা যায়। ‘বলাই’ গল্পে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক যে কত নিবিড় তা দেখা যায়। এই মানুষকে তিনি কোনোভাবেই বিভাজিত হতে দেননি জাতপাত, ধর্মের দ্বারা, এমনকি জাতীয়তাবাদের গন্ডিতে আবদ্ধ রাখতে চাননি। মানুষকে তিনি ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন আন্তর্জাতিকতাবাদ-এর পক্ষে।

১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিকতাবাদকে ত্যাগ করে জাতীয়তাবাদের গন্ডিতে আবদ্ধ হয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি। বিশ্বজুড়ে বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলি জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে কলোনি দখলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের মনে মানুষের প্রতি মানুষের এই শোষণ-নিপীড়ন, অপমান ভীষণভাবে দাগ কাটে। তিনি বলছেন– “আমি যোগ্য নই এটা বলার যে কেন ইউরোপ তার বিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে এটা করছে। তবে লোভের সংগঠিত আবেগকেই ইউরোপীয় সভ্যতার ছদ্মবেশে বিশ্বে চালান করা হচ্ছে।”

 সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের পুঁজি ভারতের উন্নতিকল্পে ব্যয় হয়নি, তাদের লোভকে পূরণ করার জন্যই রপ্তানি করা হয়েছিল এবং এ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। ভারতবর্ষের মানুষের জীবনকে কিভাবে বদলে দিয়েছে পুঁজির প্রবাহ, তাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন যে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন কিভাবে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে পেশাগত জীবন গ্রাস করছে তা বোঝাতে তিনি বলেছেন– “সমাজকে তার লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য একটি বিষয় সামনে আসছে তা হল সংগঠনের ভূমিকা। সমাজ পরিচালিত হচ্ছে সংগঠনের দ্বারা। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র অসামাজিক তাই শুধু নয় বরং উপযোগবাদ।”

লেনিনের সময় শিল্পের ফিনান্সিয়ালাইজেশন ঘটে। ব্যাংক পুঁজি ও শিল্পপুঁজির মিলনে তৈরি হয় ফিনান্স পুঁজি। বর্তমান সময়ে পুঁজির বিস্তার এবং সঞ্চয়নের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। ফলে পুঁজির লোভকে  আরো সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে বিশ্বায়নের জয়যাত্রা হয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সংগঠনগুলি আরো বেশি বৃহৎ এবং অসামাজিক হয়ে উঠেছে। আজ ব্যাংক ও বাজারের মিলনে তৈরি হয়েছে বিশ্ব পুঁজিবাদ। এর জন্য বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো হয়েছে। ডিজিটাল জগতের বিকাশ ঘটেছে মোবাইল, কম্পিউটার, নেট ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে। মানুষকে আরও টুকরো টুকরো করে হীনমন্য অন্তঃসারশূন্য মানুষে পরিণত করা হয়েছে। প্রকৃতি থেকে মানুষকে সরিয়ে এনে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এককে পরিণত করা হয়েছে। সংগঠনগুলি হয়েছে বৃহৎ এবং দানবীয়, অন্যদিকে মানুষ হয়েছে ক্ষুদ্র, আণুবীক্ষণিক। আজ মুনাফার জন্য উৎপাদনের গুরুত্ব নেই। রিয়েলাইজেশনের জগত হল মুনাফার লক্ষ্য। তাই দ্রুত রিয়ালাইজেশনের জন্য www.com ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্য ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর পূর্বেই অর্থের প্রবাহ মালিকের হাতে চলে যাচ্ছে। পুঁজির টার্নওভার বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। মানুষ শুধুমাত্র একজন পণ্যের উপভোক্তায় পরিণত হয়েছে। উপযোগবাদের জয়জয়াকার। নতুন নতুন চাহিদা তৈরি করে সংগঠনগুলি মুনাফাকে বাড়িয়ে তুলছে, অন্যদিকে মানুষে মানুষে সম্পর্ক চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে পৌঁছেছে। ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে মানুষ আজ কীটাণুতে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি তার কাছে ভোগ্যবস্তু। সে যে প্রকৃতির সন্তান তা ভুলে গিয়ে সে আজ প্রকৃতির প্রভু। এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন।

রাশিয়া ভ্রমণে গিয়ে সে দেশের মানুষের বিশ্বকর্মার বিশাল কর্মযজ্ঞ কে দুহাত তুলে বাহবা দিলেও ছাঁচে গড়া মানুষ তৈরীর পদ্ধতিকে তিনি মনুষ্য ধর্মের বিরোধী বলে চিহ্নিত করেছেন। তাই ওই পূর্বে উল্লেখিত একই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-

” সাহিত্যের বিষয় মানব হৃদয় এবং মানব চরিত্র। কিন্তু মানব চরিত্র এটুকুও যেন বাহুল্য বলা হইল। বস্তুত বহি: প্রকৃতি এবং মানব চরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষা রচিত সেই চিত্র এবং সেই গান ই সাহিত্য।”

আজ ভাষার মধ্যে বিশ্বমানবতার চিত্রটি কলুষিত। প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের সেই গান আজ স্তিমিত। উৎপাদন জগতের সহযোগিতা ক্রমশ: লোপ পাচ্ছে। বিপরীতে বাজারি মানসিকতার বিকাশ ঘটছে। সাহিত্যে ভাষায় তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে। আজ নতুন সমাজ গড়ে তুলতে বিশ্ব মানবিকতার বিকাশ ঘটাতে রবীন্দ্রনাথ খুবই প্রাসঙ্গিক। তাইতো তিনি লিখেছেন-

“ভগবানের আনন্দ সৃষ্টি আপনার মধ্য হইতে আপনি উৎসারিত; মানবহৃদয়ের আনন্দ সৃষ্টি তাহারি প্রতিধ্বনি। এই জগত সৃষ্টির আনন্দ গীতের ঝংকার আমাদের হৃদয় বীণাতন্ত্রীকে অহরহ স্পন্দিত করিতেছে; সেই যে মানব সংগীত, ভগবানের সৃষ্টির প্রতিঘাতে আমাদের অন্তরের মধ্যে সেই যে সৃষ্টির আবেগ; সাহিত্য তাহারই বিকাশ। বিশ্বের নিশ্বাস আমাদের চিত্ত বংশীর মধ্যে কি রাগিনী বাজাইতেছে সাহিত্য তাহাই স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে। সাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের নহে, তাহা রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী। বহি:সৃস্টি যেমন তার ভাল মন্দ তাহার অসম্পূর্ণতা লইয়া চিরদিন ব্যক্ত হইবার চেষ্টা করিতেছে, এই বাণী ও তেমনি দেশে দেশে, ভাষায় ভাষায় আমাদের অন্তর হইতে বাহির হইবার জন্য নিয়ত চেষ্টা করিতেছে।”

এখানে ভগবান প্রকৃতিরই এক রূপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্পিনোজার ভগবানই রবীন্দ্রনাথের ভগবান, ঠিক যেমন আইনস্টাইনের কাছেও তাই ছিল। পন্যের আবেশে মোহিত আজ মানব সমাজ। পণ্যের মধ্যে সুখ খুঁজতে ব্যস্ত। সৃষ্টি নেই, সৃজন নেই। তাই সৃষ্টির আনন্দ তার কাছে অধরা। এখানেই আজ রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক। তাকে পাথেয় করে এক উচ্চতর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে মানবিকতার জয়ধ্বজাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। এই হোক আজকের শপথ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top