হোমো ভার্চুয়ালিস: পর্ব ২

পোস্টটি দেখেছেন: 38 (একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির চরম বিকাশের যুগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নবতম সংযোজন হলো মেটাভার্স।এই বিষয়টি নানান দিক দিয়ে বিশদে আলোচনার দাবি রাখে, যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক।তাই এই সুদীর্ঘ লেখাটি কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে পরিপ্রশ্নের ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে পরিপ্রশ্ন পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী।আমরা আশা রাখি দুই তিন দিন […]

(একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির চরম বিকাশের যুগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নবতম সংযোজন হলো মেটাভার্স।এই বিষয়টি নানান দিক দিয়ে বিশদে আলোচনার দাবি রাখে, যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক।তাই এই সুদীর্ঘ লেখাটি কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে পরিপ্রশ্নের ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে পরিপ্রশ্ন পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী।আমরা আশা রাখি দুই তিন দিন অন্তর অন্তর এক একটি পর্ব পাঠকদের দরবারে হাজির করতে পারবো।পাঠক ও শুভ্যানুধায়ীদের সহৃদয় সহযোগিতার প্রত্যাশায় বুক বাঁধলাম আমরা।আগের পর্বের ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব )।

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

 অ্যাভাটার অপ্রাকৃতিক  অমানবিক সত্তার নিখুঁত প্রতিফলন

বৃহৎ পরাশর হোরা শাস্ত্র অনুসারে  ভগবান বিষ্ণু মহাবিশ্বের রক্ষক। যুগে যুগে তিনিই মৎস্য, বামন, রাম, পরশুরাম ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন অবতারের চেহারায় পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন। দুষ্টের দমনে যে সকল কান্ডকারখানা ঘটিয়েছেন তা সবই অতিলৌকিক।

এই অবতার থেকেই অ্যাভাটার ( avatar)  শব্দটির জন্ম যা কার্যত মেটাভার্সের বাসিন্দা। ঠিক যেমন আমরা পৃথিবীর বাসিন্দা  যদিও আমাদের পার্থিব দৈনিক লেনদেনের সঙ্গে  অ্যাভাটার সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী লেনদেনের প্রায় কোনও মিলই নেই। ইউসার ছাড়া যেমন ফেসবুক অচল, মেটাভার্সকেও সচল রাখে এই অ্যাভাটার। তথ্য বলছে, এখনও পর্যন্ত ফেসবুকের রেভেনিউকে আকাশ ছুঁইয়েছে তার ২৮০ কোটি সদা সক্রিয় ইউসার। একথা আজ অনেকেই বুঝেছেন যে  ফেসবুকে যত বেশি সংখ্যক ইউসার যত বেশি সময়ের জন্য নিজেকে  আটকে রাখবে মার্ক জাকারবার্গের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হবে ততই সমৃদ্ধ। এই একই যুক্তি খাটে মেটাভার্স ও তার সৃষ্টিকর্তাদের ক্ষেত্রেও। কেতাবি অর্থে মেটাভার্সকে দারুণ প্রযুক্তি-সম্বলিত জ্ঞানে, কলাকৌশলে যারা গড়ে তুলেছেন তাদের বলা হয় মেটাভার্স ডেভেলপার। এই মেটাভার্সে অ্যাভাটারের আনাগোনা আর তাদের অতিলৌকিক গতিবিধির পরিমাণ বেশি হলে ডেভেলপারদের সম্পদের গ্রাফ হবে ওপরের দিকে। বাস্তবে এই অ্যাভাটার রূপে গুণে ভার্চুয়াল জগতে সুন্দরতম এবং সর্বশক্তিমান এনটিটি (entity) হলেও বাস্তবে আসল পরিচয় খোঁজ করলে দেখা যাবে, গ্যাস অম্বল বা হালের ওমিক্রন আক্রান্ত তিনি রক্তমাংসের সাদামাটা এক চিন্তাগ্রস্ত বিপন্ন মানুষ। এই বিপন্নতাকে ঝেড়ে ফেলে বা বিপন্নতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে ফ্যান্টাসির জগতে নিজেকে মেলে ধরে জাকারবার্গ গোষ্ঠীর সম্পদ কয়েক গুণ  বাড়িয়ে তোলার আকর্ষণকে উপেক্ষা করা দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসল কথাটি হল, জাকারবার্গ এবং তার প্রতিযোগী ধনকুবেররা মানুষের সার্বিক সামাজিক বিকাশের বা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষপাতী তো ননই বরং মানুষকে তার প্রকৃত মানবিক সত্তা থেকে দূরে সরিয়ে  এক অপ্রাকৃতিক ফ্যান্টাসীর জগতে ঠেলে দিতে  বদ্ধপরিকর শুধুমাত্র নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে। মেটাভার্সে মানুষের বিপন্নতা কমে না বরং বেড়েই চলে চক্রবৃদ্ধিহারে। জ্ঞানগর্ভ অলঙ্কারে ভরা বক্তব্যের ঘনঘটায় তারা কিন্তু বোঝাতে হরদমই ব্যস্ত যে মেটাভার্সই হল মানুষের আগামী অস্তিত্বের অপরিহার্য এক চারণভূমি। মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয় বাজেয়াপ্ত করে ভার্চুয়াল জগতে গোটা মানবজাতিকে প্রবেশ করিয়ে তারা প্রমাণ করতে মরিয়া যে সেরা সমস্ত প্রযুক্তির প্রয়োগে মেটাভার্সের ভার্চুয়াল জীবন আগাগোড়াই বিজ্ঞানসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎ। কারণ এখানে সত্যিকারের গাড়ি বা কারখানাই নেই, অতএব ফসিল ফুয়েল এবং সেই সংক্রান্ত বিশ্ব উষ্ণায়নের কথা ভেবে অপরাধবোধ থেকেও নিস্কৃতি। তাদের মতে কায়িক এবং মানসিক শ্রমের বিচক্ষণ ব্যবহারে এখানেই মানুষ ভার্চুয়াল পণ্য তৈরি করতে তার সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাবে অ্যাভাটারের চেহারায়। অ্যাভাটারের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে নব্য সামাজিকতা, মানুষ পূরণ করে নেবে তার ভার্চুয়াল সৃষ্টিকাজ থেকে জন্ম নেওয়া নব্য ভার্চুয়াল আকাঙ্ক্ষা।  

  মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত, প্রকৃতি থেকে মানুষের দূরত্ব দিনদিন বেড়েই চলেছে, সেকথা হাড়েমজ্জায় মানুষ আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে। দিনরাতের বেশিরভাগ সময়েই অনলাইন জগতে  মানসজগতের সর্বস্ব ঢেলে ছোটখাটো সামাজিক সমস্যা থেকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সঙ্কট প্রকৃতি বিপর্যয় সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই আজ সম্পূর্ণ উদাসীন। বিপজ্জনক এই মানসিকতার চূড়ান্ত বিকাশের এক মোক্ষম অনুঘটক হল এই মেটাভার্স। জাকারবার্গরা ভালোই বুঝেছেন, প্রকৃতিবিমুখ, অবৈজ্ঞানিক চিন্তায় ভরপুর মানুষের আজকের মন মেটাভার্সের দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়ার জন্য আদর্শ অতএব এই সুযোগ হাতছাড়া করা অলাভজনক। সুচতুর পরিকল্পনায় আজকের দিনে মানবমন একমাত্রিক চিন্তায়, একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও অনন্য এক প্রজাতি হিসেবে মানুষ বিকশিত হয়েছিল প্রকৃতির সাহচর্যে সহযোগিতা এবং বস্তুগত উৎপাদনের সুদীর্ঘ পরম্পরায়।

মানুষ ও প্রকৃতি ( ছবিটি এঁকেছেন Nunzio Paci)

জ্ঞানত, মানুষই একমাত্র প্রজাতি যে তার চারপাশের প্রাকৃতিক সমস্ত উপাদান পঞ্চেন্দ্রিয়র সাহায্যে পরিপাক করে চিন্তার মাধ্যমে একটা সাধারণ ধারণা তৈরি করতে পারে। এখানে পরিপাক শব্দটি খাবার পরিপাক অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

 প্রকৃতি প্রাণকে ঘিরে বিস্ময়কর সব শিল্পসৃষ্টির কারিগর মানুষের চিন্তার সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যের মধুর সম্পর্কটি নিয়ে  চমৎকার ব্যাখ্যা করেছিলেন হল্যান্ড দেশের দার্শনিক বারুচ স্পিনোজা (১৬৩৩-১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দ)। স্পিনোজার মতে সামগ্রিকভাবে প্রকৃতিই একমাত্র তার গুণ হিসাবে চিন্তার অধিকারী (nature as a whole posseses thinking)। বিচ্ছিন্ন কোনও অংশের এই গুণটি নেই।

রুশ দার্শনিক ই ইলিয়েঙ্কভ ( E Ilyenkov)  তার ডায়ালেক্টিকাল লজিক (Dialectical Logic)  বইতে লিখেছেন,

The soul ‘body’ that thinks from the necessity build into its special ‘nature'( i.e. into its specific structure) *is not the individual brain at all,* and not even the whole man with a brain, heart and hands, and all the anatomical features peculiar to him. Of necessity, according to Spinoza, only substance posses thought. Thinking is a necessity premise and indispensable condition( sine qua non) in all nature as a hole. (1)

 যেমন একখণ্ড মাটির তাল চিন্তা করতে পারে না কিন্তু যা চিন্তা করতে পারে এমন কিছুর গঠনে মাটির তালটি যদি অংশ নেয় তাহলে বলা যায় মাটির তালটিও চিন্তা করতে সক্ষম। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও আসলে ব্যাপারটা হল এইরকম। প্রথমে মাটির তালটিকে গুঁড়ো করা হল৷ তারপর সেখানে একটি গাছের চারা লাগানো হল এবং পরে সেটিকে মানু খাবার হিসেবে গ্রহণ করল। অতএব এইভাবে মাটির তালের মধ্যে বস্তু সংবেদী শরীরের বস্তুতে রূপান্তরিত হল। মানেটা দাঁড়ালো,  অসংবেদনশীল বস্ত থেকে সংবেদনশীল পদার্থের রূপান্তর ঘটল। এই রূপান্তর মস্তিষ্কের বিকাশ এবং গভীর চিন্তারই সহায়ক। অসংবেদনশীল বস্ত হিসেবে এই মাটির তাল মেটাভার্সের  ফ্যান্টাসি  জগতের ভার্চুয়াল পণ্য নয় বা  তাকে আত্তীকরণ করা মানুষ  অ্যাভাটারের  মহাজাগতিক শরীর  নয় , বাস্তবে এর ব্যবহারযোগ্য অস্তিত্ব রয়েছে শতকরা  একশোভাগ।

 পরিপুষ্ট সবুজ বনস্পতি, আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক রঙিন  পাখি, উত্তাল নীল সমুদ্র এমনকি আশপাশের অন্যান্য মানুষ, মানুষের শরীরের আভ্যন্তরীন মাইক্রোবসের জগত (gut microbiome)  বস্তুত এই সবই আগাগোড়াই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল হিসেবে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষের বিকাশ। মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক প্রসঙ্গে স্পিনোজার তত্ত্বকে দার্শনিক কার্ল মার্ক্স ( Karl Marx) আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য এবং চিন্তার বিকাশে শ্রমের অপরিহার্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করে।

 মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীরা বস্তুজগতের বিভিন্ন উপাদান আক্ষরিক অর্থে পরিপাক করে তাদের শরীরের অংশ করে নেয়।  যেমন গাছের সালোকসংশ্লেষ বা প্রাণীদের খাদ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। জিরাফ যখন লম্বা গলা উঁচিয়ে গাছের পাতা চিবিয়ে খায় তা পরিপাকের পর শরীরের অংশ হয়ে যায়। সেখানে এটি সম্পূর্ণ এক জৈবিক প্রক্রিয়া। মানুষের ক্ষেত্রে এই বস্তুজগতের পরিপাকের কিন্তু  অন্য মানে। সেক্ষেত্রে বাহ্যিক পরিবেশ মানুষের ভাবগত অজৈব প্রকৃতির (spiritual inorganic nature)  একটা অংশ হয়ে জায়গা করে নেয়। প্রকৃতির ওপর মানুষের এই বোধগম্যতা পরিপাকেরই এক রূপ যেখানে বস্তুর আদৌ কোনও রুপান্তর ঘটে না। প্রকৃতিজাত যে বস্তুর ওপর ভিত্তি করে মানুষের বোধ তৈরি হচ্ছে সেই বস্তু নিজের জায়গাতেই থাকে, স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে বাহ্যিকভাবে মানুষের চেতনা নিরপেক্ষভাবে তা অবস্থান করে। মস্তিষ্কের ব্যবহারের মাধ্যমে সেই বস্তুকে কেন্দ্র করে মানুষের বোধগম্যতা আসলে তার মনেরই এক ধরনের সম্প্রসারণ। বলা যেতে পারে মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়র আয়ত্তে যে পরিবেশকে সে জেনে বুঝে নেয় বা যে পরিবেশের ওপর মানুষের বোধগম্যতা কাজ করে বস্তুত তাই হল মানুষের সম্প্রসারিত মন (extended mind)। ঠিক একইভাবে এই বোধগম্যতাকে কাজে লাগিয়ে শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে যে নতুন ব্যবহারযোগ্য বস্তুর সৃষ্টি হল তা তাদের দেহগত শ্রমেরই সম্প্রসারণ কারণ শ্রম সেই সৃষ্টিরই অন্তর্ভুক্ত। সে অর্থে  সমগ্র প্রকৃতিই  হল মানুষের সম্প্রসারিত দেহ (extended body) এবং উৎপাদিত বস্তুটি  সম্প্রসারিত দেহের উন্নততর এবং আকাঙ্ক্ষিত রূপ যেখানে মানুষের শ্রম অঙ্গীভূত। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মানুষের চাকা আবিস্কার মূলত প্রতিকূল পরিস্থিতি, পরিবেশ ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফসল। মনে করা হয়, গাছের গোল গুঁড়ি গড়িয়ে যেতে দেখে চাকার ধারণা আসে মানুষের মাথায়। তারা শ্রম দিয়ে গুঁড়িটি পাতলা করে কেটে তার মাঝখানে ছিদ্র করে লাঠির মতো কিছু দিয়ে চাকতি দুটিকে যুক্ত করে গড়ে তুলেছিল আদিম গাড়ি। ঠিক এইভাবেই পরবর্তীকালে পঞ্চেন্দ্রিয়র আয়ত্তে পরিবেশকে জেনে বুঝে পরিবেশের ওপর বোধগম্যতাকে কাজে লাগিয়ে শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে মানুষ টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিস্কার  করে। গ্যালিলিও এর আরো উন্নতি সাধন করেন। নিজের তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েই আবিষ্কার করেছিলেন বৃহষ্পতির চারটি উপগ্রহ।

উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হল যে, এই ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষ প্রকৃতিকে পরিবর্তন করার মধ্যে দিয়ে নিজের প্রকৃতিকেও পরিবর্তন করে এবং তার তৈরি করা নতুন বস্তুজগতে মানুষ নিজেকে নিজেরই পরিবর্তিত প্রতিলিপি হিসেবে দেখতে পায়। অতএব একটি হল প্রকৃতির ওপর বোধগম্যতা আর অন্যটি হল প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে উৎপাদন ।  উৎপাদনের আগে প্রকৃতির ওপর বোধগম্যতা হল মানুষের সম্প্রসারিত মন আর উৎপাদনের পরে উৎপাদিত বস্তুটি হল সম্প্রসারিত দেহ।  এই দুটিই একসঙ্গে মানুষের সম্প্রসারিত সত্তা (extended self) গঠন করে। প্রকৃতির গভীরে মনের সম্প্রসারণ, বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ, নতুন ধারণা অর্জন এবং সেখান থেকে সামজিক জ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমেই  চাকা , দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা হালের কম্পিউটার আবিস্কার। এই সবকিছু আবিস্কারের মধ্যে দিয়ে আবার মানুষ নিজের প্রকৃতিকে বদলায়, নিজেরই উত্তরণ ঘটায়, নিজেরই সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে  পৃথিবীকে দেখতে পায়।  তার পূর্ব্ববর্ত্তী সত্তা সম্প্রসারিত হয়ে এক উন্নততর মানবিক সত্তার জন্ম দেয়। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য ছাড়া মানবিক সত্তার এই বিকাশ কোনওভাবেই সম্ভব নয়।

 আজকের পৃথিবী এক কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন। মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর কথোপকথনের মাধ্যমে বিবর্তনের দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া পার করে একজন পরিপূর্ণ সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদের আজ প্রধান কর্তব্য প্রকৃতির পুনরুদ্ধার। সেই লক্ষ্যে প্রকৃতির অজানা রহস্যগুলির উন্মোচন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া মানুষের গুরুদায়িত্ব। এর জন্য দরকার প্রকৃত অনুসন্ধিৎসা, অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, সহযোগিতাপ্রবণ মনন। অথচ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি  মানুষের প্রকৃতিমুখী এই আকাঙ্ক্ষা এবং অনুসন্ধিৎসাকে অবদমিত করে, মানুষের একে অপরের প্রতি সহযোগিতার মানসিকতাকে দুরমুশ করে  অমানুষী প্রাণীর মতোই আহার নিদ্রা মৈথুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে কেবলমাত্র মানুষের জৈবিক সত্তার বিকাশ ঘটিয়ে অবাধ প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করিয়ে যেন-তেন প্রকারেণ অর্থ উপার্জনকেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে প্রতিস্থাপিত করেছে। মেটাভার্স অজানাকে জানার মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তববিমুখ, প্রকৃতিবিমুখ তো বটেই বরঙ বিমূর্ততার চূড়ান্ত এক জগতে পর্যবসিত করার  সুপরিকল্পিত সুবৃহৎ নকশা।  Bloomberg.com-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে,

To understand why Mark Zuckerberg thinks “the metaverse” is the next frontier, consider the case of Sam Peurifoy. The 27-year-old chemistry PhD from Columbia University left his job at Goldman Sachs at the height of the pandemic and is now seeking out his fortune in crypto by playing video games. He has recruited dozens of people from Mexico to the Philippines to a “Guild” that plays under the command of “Captain” Peurifoy. In exchange, he ponies up the funds needed to enter Axie Infinity, a game where players collect Smooth Love Potion — a digital token that can potentially be converted into real money. (2)

 এখনও পর্যন্ত Smooth Love Potion নামের এই ডিজিটাল টোকেনকে  বাস্তবে অর্থে রূপান্তরিত করা যায়। এটি এমন ধরনের  অর্থ যা স্পর্শযোগ্য, ভার্চুয়াল নয়।  স্যাম পিউরিফয়ের (Sam Peurifoy) মতো উচ্চ শিক্ষিত ছেলেরা উজ্জ্বল ভবিষ্যত তোয়াক্কা না করে প্রায়ান্ধের মতো ছুটে চলেছে এই অর্থের পেছনে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় এতদিনের আমাদের সুপরিচিত এই স্পর্শযোগ্য অর্থও পরিণত হতে চলেছে ভার্চুয়াল মুদ্রায় যা তৈরি করতে চলেছে আগামীর অর্থনীতি। এই নতুন অর্থনীতির ভিত্তি আগাগোড়াই স্পেকুলেশন। উল্লেখিত প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে,

what Peurifoy and his Guild are now doing on Axie offers an early glimpse into this future. It’s not quite “Ready Player One” — Steven Spielberg’s dystopian sci-fi adventure based on Ernest Cline’s book, or even “Snow Crash,” the 1992 Neal Stephenson novel that coined the term “metaverse.” Rather, it’s an online arena where “decentralized finance,” or DeFi, reigns — fusing together cryptocurrencies, blockchain technology, non-fungible tokens and video gaming. (3)

 ক্রিপ্টোকারেন্সি (cryptocurrency) , ব্লকচেন টেকনলোজি (blockchain technology)  এবং নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (non-fungible token, NFT) সমৃদ্ধ  আগামীর এই নতুন অর্থের জগৎই হল মেটাভার্সকে সচল রাখার জ্বালানি।  মানুষের ধ্যানজ্ঞান কব্জা করে নতুন এই অর্থের জগতকে মানুষের কাছে অপরিহার্য করে তোলাই হল মেটাভার্সের নেপথ্যে বর্তমান পুঁজিবাদের আসল লক্ষ্য। এনএফটি (NFT) ও মেটাভার্সের মধ্যের মিথোজীবী সম্পর্কে অন্য একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে,

ক্রিপ্টোকারেন্সি

NFTs are capable of disrupting the traditional social network paradigm of user interaction, socialization, and transaction in the metaverse… NFTs will also play an integral role in identity, community and social experiences in metaverses… NFT avatars represent a player’s real or imagined self. Players can use NFT avatars as access tokens to enter and hop between different locations within the metaverse. In this case, NFT avatars serve as an extension of our real-life identities, where we have full ownership and freedom to curate and build our virtual identities in the metaverse. (4)

এই মেটাভার্স আপাত দৃষ্টিতে ভিডিও গেমের এক ভার্চুয়াল জগৎ হলেও বস্তুত  এই ভিডিও গেম তথাকথিত সকল প্রচলিত ভিডিও গেমের থেকে গুণগতভাবে আলাদা। ভার্চুয়াল জগতে শত্রুকে মেরে গোটা কয়েক এনএফটি হস্তগত  করে নেওয়ার অপার স্বাধীনতার মধ্যেই আড়াল করা আছে এক বিপজ্জনক অর্থনীতি ও এই অর্থনীতির ভিতর নেশাগ্রস্ত মানুষের অলীক রোমন্থন।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত

তথ্যসূত্র –

1. Dialectical Logic, Evald Ilyenkov, Akar Books, P – 42

2. Into the Metaverse: Where Crypto, Gaming and Capitalism Collide By Charlie Wells and Misyrlena Egkolfopoulou,

https://www.bloomberg.com/news/features/2021-10-30/what-is-the-metaverse-where-crypto-nft-capitalism-collide-in-games-like-axie?utm_medium=cpc_search&utm_campaign=NB_ACQ_DSAXX_DSATESTTCPAXX_EVG_XXXX_XXX_COALL_EN_EN_X_BLOM_GO_SE_XXX_XXXXXXXXXX&gclid=Cj0KCQiAlMCOBhCZARIsANLid6bGyBQPwX4OUtkjxl42yWbnO4iGFLeHrTXkf-AI4TJDp6N6ATW5POMaAm3vEALw_wcB&gclsrc=aw.ds8

3. ibid

4. Why NFTs Are The Keys To Accessing The Metaverse,

https://www.binance.com/en/blog/nft/why-nfts-are-the-keys-to-accessing-the-metaverse-421499824684903085

3 thoughts on “হোমো ভার্চুয়ালিস: পর্ব ২”

  1. Highly confusing. Writer needs to further crystallize the thinking.
    Logical derivations of points are inadequate, needs further improvement.

    1. Thanks a lot for your valuable comment.. If you can please elaborate concretely which part is confusing and which part needs improvement? I will see to that.. Otherwise the comment seems to be utterly confusing to me.. I hope you are reading it As a continuation of part 1 will end with another 4 parts coming shortly… I have already provided you my email address.. If you please share your thoughts in little more detail.. Thanks again..

    2. Please read the next parts. I think your confusions will be cleared and if you want you may contact the writer directly to have a fruthfull discussions.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top