তথ্য-প্রযুক্তি-মহাশক্তি

লেখককৃত আলোচনাগুলি আরো একজন সৎ, যোগ্য লেখককে উসকে দিতে পারে ভাবনার গভীরে যাওয়ার জন্য এবং পাঠককে অস্থির করে তুলতে  পারে এজাতীয় অন্য বইয়ের খোঁজে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে বাংলা ভাষায় এজাতীয় বইয়ের সন্ধান মিলবে এমনটা বলা বাতুলতা। এক্ষেত্রে লেখক দু-একজন অগ্রগণ্যদের অন্যতম।

বঙ্কিম দত্ত

যুক্তি তক্কো গপ্পো। বইয়ের এই নাম দেখেই ছোট মাপের ১৪৩ পৃষ্ঠার বইটাকে হাতে তুলে নিয়েছিলাম। একটু ভালো করে নজর করে দেখলাম বইয়ের নামের একেবারে শুরুতে আছে প্র— প্রযুক্তি তক্কো গপ্পো। আগ্রহ বাড়ল । প্রযুক্তি থাকলে অর্থনীতি নিয়ে কথা থাকবেই । হার্ডবোর্ড বাইন্ডিং, কভার জ্যাকেট, ঝকঝকে ছাপা। প্রথমেই  মনে হয়েছিল এক জায়গায় বসে দু’-এক ঘণ্টায় চারিয়ে নেওয়া যাবে। সঙ্গে থাকলে পথ চলার একাকিত্ব কাটিয়ে বইটা অনায়াসেই সঙ্গী হতে পারে। মলাটে  ঝকঝকে ছবিসহ লেখক পরিচিতি।  উল্লেখযোগ্য যে পাঠককে সে দিক থেকেও আকর্ষণ করবে বইটা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে নেয়া গেল—  শঙ্খদীপ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭৯,  দুর্গাপুরে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে গণিতের স্নাতক। স্নাতকোত্তর কম্পিউটার বিজ্ঞানে। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বাংলা ভাষায় নবীন গল্পকারদের মধ্যে নাম  উল্লেখযোগ্য। ছোটগল্পের পাশাপাশি সমাজ ও  বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে থাকেন। সংবর্তক এবং পরিপ্রশ্ন পত্রিকার  সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। এই ভাবেই লেখক পরিচিতি দেওয়া আছে। বইটা নেবার জন্য আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। বিজ্ঞান বিষয়ে লিখছেন বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত নবীন প্রজন্মের একজন্য  গল্পকার। সংস্কৃতির আঙিনায় জল-অচল সম্পর্ক বিজ্ঞান আর সাহিত্যে। মনে মনে ভেবে নিলাম লেখকের  উল্লেখিত পরিচিতি কার্যকরী হবে আর  নিশ্চয়ই ব্যত্যয় ঘটবে এই বিদ্যমান ধারণার– বিজ্ঞান হয়তবা এই লেখার প্রতিফলনে সাহিত্যমূল‍্যেও সংস্কৃতির  জগতে স্থান করে  নিতে পারবে। সচারাচর  তা  ঘটে না এবং বিজ্ঞানকে সাহিত্যের আঙিনায় প্রবেশের অধিকার দিতেও নারাজ অনেকেই। সাহিত্য প্রেমীদের এই স্বাভিমান বিশেষত বাংলা লিটিল ম্যাগাজিন ঘরানায় বেশ স্পষ্টতই প্রতীয়মান। সাম্প্রতিক কিছু ব্যাতিক্রমী উদাহরণ এবং রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্রের মতো উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য থাকলেও ‘সংস্কৃতির দ্বিখন্ডন’ রীতিমতো স্পষ্ট।

বইয়ের কথায় আসা যাক। বইয়ের দু-একটি লেখা পড়া শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা যাবে যে এক লহমায় পড়ে ফেলার বই এটা নয়। অনেকগুলি প্রবন্ধের সংকলন এই বইটি। পরিসরে কোন প্রবন্ধই দশ-বারো পাতার বেশি নয়। তবু পাঠকের যাত্রা বিষয়ের এমন এক রাস্তায় যা এযাবত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় অজানা এবং লম্বা-চওড়া এই রাস্তা গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। বিষয়গুলি এমন যে তার সম্পর্কে   আমজনতার জানা বোঝা অনেক কম। সামাজিক আলোড়নতো আরো কম।  অবশ্যই বিষয়গুলির বৈশিষ্ট্য এমন যে, তা আমাদের প্রাত্যহিকীতে জড়িয়ে আছে সকাল-সন্ধ্যা  এবং  যাপনকে করছে বহুলভাবে প্রভাবিত। লেখক নিজেও যে এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন তা বোঝা যায় প্রবন্ধের শুরুতে ‘যা বলতে চাই’ শিরোনামের অধীনে তাঁর স্বীকারোক্তিতে।  সে বয়ানের কয়েকটি বাক্য  উল্লেখ করার  প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম— ‘একুশ শতকে প্রাত্যহিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রভাবকে কোনভাবেই আজ অস্বীকার করা চলে না। অথচ প্রযুক্তিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মানুষের বহুল ব্যবহারের আড়ালে যে বৃহত্তর জগত প্রতিমুহূর্তে কাজ করে চলেছে, সে  ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষই হয় সম্পূর্ণ উদাসীন বা জানতে অনিচ্ছুক। নতুন এই জীবনচর্চা আমাদেরকে, বিশেষ করে আগামী প্রজন্মকে কী  ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা গভীরে জানলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। অতএব সে সম্পর্কে  মানুষকে বিশদে না জানালেই নয়’। লেখককের সদিচ্ছাকে পুরোপুরি সম্মান জানিয়েও বলতে হচ্ছে যে বিশদে জানানোর ব্যাপারে তাঁর অভিপ্রায় যতটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ততটা কাজে রূপান্তরিত হয় নি এই বইতে । হবার কথাও নয়। প্রত্যেকটি বিষয়ে এরকম একশ তেতাল্লিশ বা তার বেশি পৃষ্ঠা নিয়ে আলোচনা আজ খুবই জরুরী। লেখককৃত আলোচনাগুলি আরো একজন সৎ, যোগ্য লেখককে উসকে দিতে পারে ভাবনার গভীরে যাওয়ার জন্য এবং পাঠককে অস্থির করে তুলতে  পারে এজাতীয় অন্য বইয়ের খোঁজে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে বাংলা ভাষায় এজাতীয় বইয়ের সন্ধান মিলবে এমনটা বলা বাতুলতা। এক্ষেত্রে লেখক দু-একজন অগ্রগণ্যদের অন্যতম।

নজর করা যাক  প্রবন্ধের শিরোনামগুলির দিকে। মোট আঠারোটি প্রবন্ধ রয়েছে। অন্তত কয়েকটি শিরোনামের উল্লেখ থেকেই আপাতত বুঝে নেওয়া সম্ভব যে এ বিষয়ে মস্তিষ্কচর্চায় আগ্রহীরা,  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে নূন্যতম ভাবুকরা  ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সামাজিক ভূমিকা নিয়ে চিন্তিত যে সমস্ত ব্যক্তি ও সংগঠন আছেন এই বই তাদের অবশ্য পাঠ্য।  না পড়লে অবশ্যই পিছিয়ে পড়তে হবে।

প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম— অমলকান্তি : রোদ্দুর থেকে রোবট। পরের প্রবন্ধটি ক্ষমতার চাবিকাঠি : তেল নয় বিগ ডেটা। তারপর— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : ক-য়ে কৃত্রিম, ব-য়ে  বুদ্ধি। চতুর্থটির শিরোনাম— ভাবের ঘরে চুরি : নজরদারির সাতকাহন। অন্য আরেকটি— গপ্পো  ও তক্কো  যুক্তি : যাহা বিজ্ঞান তাহাই কি প্রযুক্তি। রয়েছে একটি প্রবন্ধ, সবুজ প্রযুক্তি : মৃতপ্রায় ধনতন্ত্রের সঞ্জীবনী। ঠিক তার পরেরটাই– কোয়ান্টাম কম্পিউটিং : বিড়াল থেকে  কিউবিট। শেষের দুটি প্রবন্ধের  শিরোনাম যথাক্রমে প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি: প্রকৃত মানুষ প্রকৃত পৃথিবী ও অমলকান্তি : রোবট থেকে রোদ্দুর। সবকটির শিরোনাম উল্লেখ করা হলো না। আশা করা যায় বুঝে নেওয়া যাবে সময়ের  ত্রিমাত্রায় প্রবন্ধগুলির বিষয়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা।

  ‘অমলকান্তি’ প্রথম ও শেষ প্রবন্ধের শিরোনামের প্রথম শব্দ। অমলকান্তি বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে স্বল্প পরিচিত পাঠকের কাছেও ইত:মধ্যেই সুপরিচিত তার জীবনের আকাঙ্ক্ষার ধারাপাতে। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। ‘প্রযুক্তি তক্কো গপ্পো’ এই প্রবন্ধ সংকলন-এর এক প্রবন্ধ থেকে আর এক প্রবন্ধে অমলকান্তির হাত ধরেই পাঠক এগিয়ে যান অনুভবের পর্ব থেকে পর্বান্তরে। আজকের অমলকান্তিরা রোবট  হবার ভাবনায় জারিত হয় সমাজ ও পরিবারের আবহাওয়ায়, এক রাজনৈতিক অভি। যন্ত্রনাবিদ্ধ  লেখক এগিয়ে চলেন অমলকান্তিদের মলিন কান্তি খুঁজতে খুঁজতে।  প্রবন্ধ সংকলন শেষ হয় নিঃশেষিত রোবট অমলকান্তির রোদ্দুর হয়ে উঠতে  চাওয়ার ফিরতি আকাঙ্ক্ষায়।

একটা প্রবন্ধের বিশদ উল্লেখ বইটির প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়াবে ভেবে রাখছি। ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল রোদ্দুর হতে পারেনি তার বন্ধুরা ডাক্তার মাস্টার হয়েছে যেমনটি তারা চেয়েছিল। অমলকান্তি কাজ পেয়েছিল অন্ধকার এক ছাপাখানায়। সেখানে রোদ্দুর আসতো না।’

 প্রথম লেখাটির প্রথম অনুচ্ছেদ। এই অমলকান্তি আজকের অমলকান্তি না হয়েও এখনো এমন অমলকান্তিরা নিশ্চয়ই আমাদের চারপাশে আছেন যারা মেঘ রৌদ্র বৃষ্টিকে আপন করে নিতে চায়। এসব নিয়ে আপন মনে থাকে অনেক অনেকটা জায়গা। পরের অনুচ্ছেদেই লেখক এর কথায়, ‘অমলকান্তির বন্ধু  আত্মীয়-স্বজন তাকে দেখে কষ্ট পায় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা অমলকান্তি আসলে কী চায়। তার শ্রেষ্ঠ কাজের জায়গাটি ঠিক কী। এই সমস্যার সমাধানে মানুষের বুদ্ধি হার মানলেও সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। পরবর্তী প্রজন্মের অমলকান্তির হাতে রাখির মত পরিয়ে দেওয়া হবে একটি বায়োমেট্রিক সেন্সর। জানলার দিকে তাকিয়ে রোদ্দুরমাখা বালির উপর চড়াই   পাখির স্নান দেখে অমলকান্তির বেড়ে যাওয়া রক্তচাপ হৃদস্পন্দন তার মস্তিষ্কের ভিতের নিউরনের যোগাযোগ, এমনকি চোখের সমুজ্জ্বল ভাব থেকে তার শরীরী আবেদনের খুঁটিনাটি মেপে নেবে এই বায়োমেট্রিক সেন্সার। বন্ধুদের জানিয়ে দেওয়া হবে;   অমলকান্তি আসলে রোদ্দুর হতে চায়’। তবে অমলকান্তিদের আকাশ মেঘলা থাকে যন্ত্রের সঙ্গে পাওয়া যান্ত্রিক সিলেবাস, মূল্যায়ণ ইত্যাদির ত্রহ্যস্পর্শে। প্রবন্ধে তার উল্লেখ নেই। অন্যত্র তার আভাষ আছে।

একবার পিছনে ফিরে তাকানো যাক। আমরা উল্লেখ করতে পারি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রের এক অধ্যাপকের  কথা— তিনিই প্রথম ভাবেন এমন  মেশিনের কথা যাতে বহু সংখ্যা নিয়ে গণনার কাজটা সুসংহত ভাবে করা যাবে। তথ্যকে প্রথমে সংখ্যায় রূপান্তরিত করা এবং তারপর এই সংখ্যার সাহায্যে মেশিনকে নিয়ন্ত্রণ করা ও প্রয়োজন মত ব্যবহার করা।  এই গণিতজ্ঞ চার্লস ব্যাবেজ। যন্ত্রের নামকরণ কম্পিউটার নয়, তিনি করেন  ‘এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন’ ।  ভুলের সম্ভাবনা আর অতিরিক্ত শ্রম, জটিল গণনার ক্ষেত্রে  দুটোই কমে আসবে, এমনটাই ছিল তার ভাবনার প্রত্যয়ে।  তিনি বুঝেছিলেন যে মেশিনকে সঠিক ইনস্ট্রাকশন দেওয়ার জন্য একটা নতুন ভাষা চাই। সেই ভাষার উদ্ভাবনও করেছিলেন তিনি। এই ভাষার বর্ণমালা তিনি গড়ে তুলেছিলেন সংখ্যা অক্ষর তীর চিহ্ন আর নানা ধরনের প্রতীক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। এইসব সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে মেশিনটিকে নির্দেশ করা হত। সমকালীন কম্পিউটার   প্রযুক্তির ভাষায় আজ তাকেই আমরা বলি প্রোগ্রামিং ।  এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন যান্ত্রিক শক্তিতে চালিত এক মেশিন। তবে আজকের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স কম্পিউটারটি আসতে ১৯৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বিভাগের অধীনে থাকায় যুদ্ধকালীন গোপনীয়তায় এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন এর বিবর্তনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস আজও অনেকটাই গোপনীয়তার আড়ালে। জানা গেছে যে অ্যালান টুরিং, ক্লদ শ্যানন আর জন ফন নিউম্যান এই তিন বিজ্ঞানীর মুখ‍্য ভূমিকার কথা। ‘ইলেকট্রনিক বর্ণমালা’ অর্থাৎ ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের ডিজিটাল ব্যবস্থাটি যা ০ আর ১ এই বাইনারি সিস্টেমে পরিচালিত তা গড়ে ওঠে এই সময়েই। ইলেকট্রিকাল নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর এন্ড ক্যালকুলেটর (ENIAC)  নামে খ্যাত যন্ত্রটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি, গোলন্দাজ বাহিনী যাতে লক্ষ্যভেদ করার ব্যাপারে আরো দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারে! অন্য অনেক প্রযুক্তির মতই কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশে যুদ্ধের ভূমিকা প্রত্যক্ষ। লেখক ‘প্রযুক্তি  তক্কো গপ্পো’ প্রবন্ধ সংকলনে এই বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন। আজকের অর্থনীতির গোলন্দাজরা কীভাবে বহু মানুষের উপর মুনাফার বোমা নিক্ষেপ করছেন, কম্পিউটার প্রযুক্তির বিভিন্ন বিবর্তিত রূপ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে, সে ব্যাপারেও অত্যন্ত গুরুতর একাধিক মন্তব্য ও আলোচনা রয়েছে বইতে ।

প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি: প্রকৃত মানুষ, প্রকৃত পৃথিবী শিরোনামে একটি প্রবন্ধ এই সংকলনে আছে। রোদ্দুর হতে চাওয়া অমলকান্তি রোবটের খোলস ছাড়িয়ে রোদ মাখা সবুজ প্রান্তরে আবার অমলকান্তি হয়ে উঠতে চায়। কেন চায় তা বুঝতে প্রবন্ধগুলি ধারাবাহিকক্রমে পড়তে পড়তে এগোতে হবে। লেখক এর জবানিতে, ‘অমলকান্তি কল্পনা করে, সমস্ত দেশের আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ সাবমেরিন এবং মেরিন টেকনোলজিকে যুদ্ধ থেকে বের করে এনে  সঠিক-সুপরিকল্পিত সামুদ্রিক চাষের কাজে লাগানো হচ্ছে। ফিরে আসছে অক্সিজেনের মূল স্তম্ভ  অ্যালগি জগৎ। দু’লক্ষ কোটি ডলারের মতো বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রকৃতিকে বাঁচানোর কাজে নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তির গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত মানবমন। আবার ক্রমশ সবুজ হয়ে উঠছে পৃথিবী’। লেখক জানেন এই অপ্রাপ্তির মূলে আছে ধনতন্ত্র নামক একটি আর্থিক উৎপাদন ব্যবস্থা যা শুধু অন্ধভাবে ক্রমাগত পুঁজি সঞ্চয়নের রাস্তায় এগোতে চায়। আর সেই লক্ষ্যে একদিকে চলে শ্রমিক শোষণ অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদের নির্দয় নিঃশেষকরণ। তাই এই প্রবন্ধেই লেখক অন্য এক জায়গায় লিখছেন, ‘ধনতন্ত্রের নিজগুণে তৈরি আজকের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সামাল দেওয়ার নামে জিও- ইঞ্জিনিয়ারিং এর নিত্য নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন বাজার তৈরি করে ডলারের মূল‍্যক্ষয়কেই সামাল দেওয়া হয়’। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট  ট্রাম্পের অপসারণের পর আজকের বাইডেন- নীতিগুলি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।

আর এসব উল্লেখের মধ্যে দিয়ে ‘প্রযুক্তি তক্কো গপ্পো’ হয়ে উঠেছে সমসাময়িকতার এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দলিল। যদিও তা পরিসরে সংক্ষিপ্ত কিন্তু  চিন্তার রসদে  তা ভরপুর।

‘ ইনফর্মেশন এজ ‘ -এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তাৎপর্য কী? আসলে তা রাশিকৃত তথ্যকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়ে নানা পদ্ধতিতে বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী বিবর্তিত চেহারায় সেই তথ্যের ব্যবহার সম্পন্ন করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষ ভূমিকা। প্রবন্ধ সংকলনের পাঠপথে এগিয়ে পাঠক বারবার শিহরিত ও আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন কোন সন্দেহ নেই। এই সব সম্ভাবনার মুখোমুখি হয়েছে অমলকান্তিও, এই বইয়ের পর্ব-পর্বান্তরে। কিন্তু ভবিতব‍্য বলে মেনে না নিয়ে ভেবেছে, বিশ্লেষণ করেছে, সঞ্চয় করেছে সাহস এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বপ্নকে ধরে রেখেছে অন্তরের  অন্ত:স্থলে।  অমলকান্তির  ভাবনা মেলে ধরছি লেখকের কথায়— ‘অমলকান্তি লক্ষ করে জানলা গলে সকালের রোদ্দুর এসে ছুঁয়েছে তার শরীর। এই রোদ্দুরে স্নান করেই তো ‘ভিনসেন্ট ভ্যান গগ’ ক্যানভাস ভরিয়ে তুলতেন কত রকমের সূর্যমুখীতে। অমলকান্তি রোদ্দুরের দিকে এগিয়ে যায়। রোদ্দুর থেকে শক্তি নিয়ে গাছেরা, প্রাণেরা পল্লবিত হয়, বিকশিত হয়। অমলকান্তির  সে কারণে রোদ্দুরকে বড় ভালো লাগতো। তাই অমলকান্তি রোদ্দুর হতেই চেয়েছিল। মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনতে সে অনুভব করে নিবিড় দায়বদ্ধতা। নতুন এক অনুভবে, সংকল্পে বিভোর হয়ে এই মুহূর্তে নিজেকে আবক্ষ মেলে ধরে  সহজলভ্য রোদ্দুরে’। (অমলকান্তি : রোবট থেকে রোদ্দুর)

বইটির বহূল প্রচার একান্ত কাম্য।

প্রযুক্তি তক্কো গপ্পো

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

সোপান

মূল্য : ২০০ টাকা

(এই পুস্তক পর্যালোচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সুখপাঠ’ ডিজিটাল ম্যাগাজিনে। বইটির প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বকে মাথায় রেখে পরিপ্রশ্ন ওয়েব ম্যাগাজিনে আমরা এই লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করলাম – সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যবৃন্দ)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top