ক্লাইমেট সায়েন্সে প্রথমবার নোবেল—সমাজ বিজ্ঞানে এর তাৎপর্য

পোস্টটি দেখেছেন: 30 সন্তোষ সেন ২০২১ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার — নোবেলের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা, এই প্রথম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া হলো জলবায়ু বিজ্ঞান ও কমপ্লেক্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্যও তিনজন বিজ্ঞানীকে। নোবেলের অর্ধেক পেলেন Syukuro Manabe এবং Klaus Hasselmann, আর বাকি অর্ধেক গেল Georgio Parisi-এর ঝুলিতে। এই তিনজন বিজ্ঞানির সংক্ষিপ্ত পরিচয়–সিউকুরো মানাবে […]

সন্তোষ সেন

২০২১ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার — নোবেলের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা, এই প্রথম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া হলো জলবায়ু বিজ্ঞান ও কমপ্লেক্স সিস্টেমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্যও তিনজন বিজ্ঞানীকে। নোবেলের অর্ধেক পেলেন Syukuro Manabe এবং Klaus Hasselmann, আর বাকি অর্ধেক গেল Georgio Parisi-এর ঝুলিতে।

এই তিনজন বিজ্ঞানির সংক্ষিপ্ত পরিচয়–সিউকুরো মানাবে আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ জলবায়ু- বিজ্ঞানী; ক্লাউস হ্যাসেলম্যান জার্মানির “ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ মেটেরিওলজি”-এর গবেষক অধ্যাপক। এই দুই বিজ্ঞানীর অবদান– পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূ-উষ্ণায়নকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি সহকারে বোঝার জন্য একটি বস্তুগত মডেলিং তৈরি করা। ১৯৭০ সালেই বিজ্ঞানী “মানাবে”; এবং “ওয়েদারল্যান্ড” জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মডেল প্রথম সামনে আনেন (যদিও ওয়েদারল্যান্ড এরমধ্যে মারা গেছেন)। এই দুই বিজ্ঞানীর বস্তুগত মডেল জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সমুদ্রের ইকোলজিকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলো।

বিজ্ঞানীদের মতে– মানাবে হলেন ক্লাইমেট মডেলিংর জনক, যিনি তাঁর কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের “জিওফিজিক্যাল ফ্লুইড ডাইনামিকস” গবেষণাগারে। তিনি ঐ সময় নোবেল পদকে ভূষিত না হলেও পরবর্তী কালে তাঁর ক্লাইমেট মডেলিংয়ের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছেন।

অন্যদিকে জার্মানির বিজ্ঞানী হ্যাসেলম্যান তাঁর সামুদ্রিক-বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন জলবায়ু-বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার জন্য। নোবেল কমিটির মতে এই দুই বিজ্ঞানীর প্রধান অবদান হলো- আজকের বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রকৃতির এলোমেলো ঘটনার কারণে নয়, বরং তা অনেক বেশি করে মনুষ্যসৃষ্ট, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করা। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি– জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-উষ্ণায়নের কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানীমহলে দীর্ঘদিন ধরে এক বিতর্ক জারি ছিল, এর কারণ কি শুধুই প্রাকৃতিক, নাকি মানুষের নানান কার্যকলাপ দায়ী এর পিছনে? এই বিতর্কের বোধহয় এবার অবসান হলো।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (ব্যাঙ্গালোর)-এর “সেন্টার ফর অ্যাটমসফেরিক এন্ড ওসেনিক সায়েন্স”- এর অধ্যাপক বালা গোবিন্দ্স্বামী, যিনি বিজ্ঞানী মানাবের সাথে কাজ করেছেন এবং IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) -এর কার্যকরী দলের অন্যতম সদস্য বিজ্ঞানী, তিনি কী বলছেন শোনা যাক। তাঁর মতে– আমরা যদি ২০২১ সালের অগাস্টে প্রকাশিত আইপিসিসির ষষ্ঠ রিপোর্টকে গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দ্বর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূ-উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান ভিলেন মানুষ এবং মানুষের পরিবেশ ধ্বংসকারী নানান কাজকর্ম।

এরপর আসি ইতালির রোমে অবস্থিত sapienza বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Georgio Parisi-এর অবদান প্রসঙ্গে। কমপ্লেক্স সিস্টেম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত পারিসি আবিষ্কার করলেন– ক্ষুদ্রতম অনু থেকে বৃহত্তম গ্রহ উপগ্রহ সহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা এবং ব্যবস্থার অধীনে; এই ব্যবস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্যুতি একটি পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অধীনে কাজ করে।

পদার্থবিদ্যায় এবারের নোবেল পুরস্কারের তাৎপর্য:

বিজ্ঞানী মানাবে এবং হ্যাসেলম্যান-এর তৈরি জলবায়ুর বস্তুগত মডেল কাজে লাগিয়েই বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা ও গতিবিধি, সমুদ্র জলের উচ্চতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, অল্প সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, বরফের দ্রুত গলন, শক্তিশালী সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির পূর্বাভাস আগেই দেওয়া সম্ভবপর হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে এই পূর্বাভাসগুলি ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মানাবে প্রথম দেখিয়েছিলেন– বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়লে পৃথিবীর মাটি ও সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বাড়বে। এক দশক পর হ্যাসেলম্যান বললেন— “আবহাওয়ার এলোমেলো চরিত্র সত্ত্বেও জলবায়ুর মডেলের ওপর ভরসা রাখা যায়।” জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মানুষের কার্যকলাপের ভূমিকার চিত্রগুলোকেও তিনি নির্দিষ্ট করেন। অন্যদিকে ইতালির বিজ্ঞানী পারিসি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা নিউট্রন, প্রোটন নিয়ে করা গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করলেন একটা বস্তুগত গাণিতিক মডেল যার সাহায্যে পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত, জীববিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স এবং মেশিন লার্নিং-এর জটিল বিষয়গুলো বোঝা ও তাদের একসূত্রে গাঁথা সম্ভব হয়েছে।

তাহলে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানীর কাজগুলোকে একসূত্রে গাঁথলে যা দাঁড়ায় তা হলো—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একদিকে আছে অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার জগৎ (microsystems) এবং অন্যদিকে আছে সরাসরি দৃশ্যমান বৃহদাকারের বিশ্বশক্তিগুলো (macrosystems), যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে এক গভীর আন্তঃসম্পর্ক ও যোগসূত্র আছে। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবৎ বস্তুসমূহের মধ্যে দৃশ্যমান আপাত বিশৃংখলার মধ্যে আদতে রয়েছে এক শৃঙ্খলা এবং পরস্পর নির্ভরতা। সেই শৃঙ্খলার সূত্রটিই খুঁজে পেয়েছেন পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী। এই সূত্রের সাহায্যেই ব্যাখ্যা করা যায় প্রকৃতির জটিল শক্তিসমূহকে, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনকেও। তাহলে নোবেল কমিটি কি এই শৃঙ্খলাসূত্রটিকেই মান্যতা দিলেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণবিক জগতের সাথে বৃহৎ বিপুলাকার জগতের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের উৎসাহিত করলেন? আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব পরবর্তী অনুচ্ছেদে।

খোপে খোপে পুরে দেওয়া বিমুর্ত বিজ্ঞানের চালচিত্র:

আমাদের আলোচিত নোবেল পদকে ভূষিত তিন বিজ্ঞানীর কাজকর্ম ও পরিবেশ-বিজ্ঞানে তাঁদের অবদান মূলত নব্বইয়ের দশকে। সময়টা খেয়াল করুন– উদার লিবারেল অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করেছে গোটা বিশ্ব। এই লিবারেল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে পুঁজির মালিকরা বড় বড় কারখানাগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন, সরকারি বদান্যতায় বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে হয় তুলে দেয়া হলো বা দেশের সম্পদকে কর্পোরেটদের হাতে জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হলো। ভার্টিকেল ডিভিশন অফ লেবার-এর মধ্য দিয়ে একদিকে সংগঠিত শ্রমিক বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হলো। অন্যদিকে আউটসোর্সিং-এর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রকরণকে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। পেট্রোলিয়াম অর্থনীতি ও অটোমোবাইল শিল্পের আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে সারা বিশ্বকে কার্বনের জালে আবদ্ধ করা হলো। চড়চড় করে বাড়তে থাকল পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ও সাথে মুনাফা বৃদ্ধির হার। বিশ্ব বাজারকে আরো প্রসারিত করার জন্য বিজ্ঞানকে নানান শাখা উপশাখায় বিভক্ত করা হলো। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শতখানেক বিভাগ। যারা আপাত বিচ্ছিন্ন অথচ পরস্পর সম্পর্কিত বিজ্ঞানের নানান বিষয়ে কাজ করলেও তাদের মধ্যে কোন যোগসূত্র রাখা হলো না।

ইন্টিগ্রেটেড বা সামুদিক ব্যবস্থার পরিবর্তে নিয়ে আসা হল বিভাজনের নীতি। চিকিৎসা বিজ্ঞানকেও ভেঙ্গে ফেলা হলো নানান বিভাগ উপবিভাগে। আপনি পেটের রোগে ভুগলেও আপনাকে দৌড়াতে হবে একাধিক বিশেষজ্ঞের কাছে, করাতে হবে অপ্রয়োজনীয় গাদা গাদা মেডিকেল টেস্ট। ফুলে-ফেঁপে উঠল ওষুধ ও চিকিৎসা প্রযুক্তির বাজার। ঘটিবাটি, জমি বাড়ি বিক্রি করেও মানুষ বাধ্য হলেন স্বাস্থ্যখাতে আরো বেশি বেশি খরচ করতে। অথচ অসুখ নির্মূলের বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনা হলো না। আজ প্রকৃতির পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বজুড়ে একটি সামগ্রিক ব্যাবস্থা ও পরিকল্পনার অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। অথচ বিজ্ঞানকে নানান টুকরো টুকরো শাখা উপশাখায় ভেঙে কার্যকারণ সম্পর্ককেই হাওয়া করে দেওয়া হলো। এই ডিভিশনের মধ্য দিয়ে পণ্য উৎপাদন ও তার বাজার কিন্তু অনেকগুন বেড়ে গেল, অথচ পরিবেশ মেরামতির কাজ সম্ভব হলো না।

অন্যদিকে ১৯০০ শতকের প্রথমার্ধেই চলে এসেছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় “অনিশ্চয়তার সূত্র”, যার সাহায্যে মূর্ত বিজ্ঞানকে করা হলো বিমূর্ত। সবকিছুকে ঠেলে দেওয়া হলো অনিশ্চয়তার গর্ভে। বিজ্ঞান নতুন করে ভাববাদী জগতে প্রবেশ করল। করোনাকালীন পরিস্থিতিতেও আমরা দেখলাম–এই ভাইরাস প্রতিরোধের ওষুধ, ভ্যাকসিন বা নিয়মকানুন মেনে চলার ক্ষেত্রে হাজারটা মতবাদ। স্থায়ী বা নির্দিষ্টকরণের পরিবর্তে সবকিছুতেই অনিশ্চয়তা। এক কথায় বিজ্ঞান হয়ে পড়ল পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির হাতিয়ার। কর্পোরেটের স্বার্থে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসে যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞানকে করা হলো ফেটিশাইড।

বিপর্যস্ত ইকোলজি:

মূলত নব্বইয়ের দশক থেকেই একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকলো আইপিসিসির জলবায়ু রিপোর্ট। বিশেষ করে পঞ্চম ও অতি সম্প্রতি প্রকাশিত ষষ্ঠ রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে পৃথিবীবাসীর জন্য ভয়ঙ্কর বিপদবার্তা। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব যাকে বলেছেন–" রেড কোড ফর হিউম্যানিটি"। জলবায়ু সংক্রান্ত এইসব নানান রিপোর্ট থেকে এখন এটা জলের মতো স্পষ্ট যে– বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-উষ্ণায়নের পিছনে প্রধান ভিলেন মানুষের লোভ-লালসা। কতিপয় দেশি-বিদেশি হাঙ্গর বহুজাতিক কোম্পানি তাদের পাহাড়প্রমাণ মুনাফার স্বার্থে নির্বিচারে ধ্বংস করছে জল জঙ্গল জমিন। প্রতিনিয়ত লুঠ হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ।

ফিনান্স-পুঁজির যুগে কাল্পনিক অর্থনীতি ( fictitious capital)-এর ফুলে-ফেঁপে ওঠা ফানুস যেকোন সময় ফেটে যেতে পারে। তাই পুঁজি খুঁজছে নতুন নতুন বিনিয়োগের জায়গা। প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস করে বেশি বেশি ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বিশ্ব বাজার দখলের প্রয়োজন হয়ে পড়ল পুঁজির মালিকদের। তাই এখন নতুন করে তাদের শ্যেণ দৃষ্টি পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের জমি (land)-এর উপর। দলিত-আদিবাসী- মুসলিম জনজাতিদের উচ্ছেদ করে জমি দখলের প্রচেষ্টা চলছে সমানতালে। কৃষকদের উচ্ছেদ করে জমি দখল করাটাও ফিনান্স- পুঁজির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাই শুধুমাত্র কর্পোরেটের স্বার্থেই কৃষক ও জনগণের স্বার্থবিরোধী নয়া কৃষি আইন প্রয়োগের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে আমাদের দেশে। এই কালা আইন বাস্তবায়িত হলে একদিকে যেমন কৃষকদের দুর্দশা বাড়বে, বাড়বে খাদ্যশৃঙ্খলে বিপর্যয়, এমনকি দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট।

অন্যদিকে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। অর্থাৎ এক কথায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের একটা বড় অংশকে পণ্য সর্বস্ব বিশ্ববাজারে টেনে এনে পুঁজির মুনাফার হারকে বজায় রাখতে নির্বিচারে চলছে প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস। যার হাত ধরে সামগ্রিক প্রাণীজগৎ সহ মানবসভ্যতা গণবিলুপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। তাই নোবেল কমিটিকেও ভাবতে হচ্ছে নতুন করে। জলবায়ু এবং কমপ্লেক্স সিস্টেমস ও তাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপনকারী তিনজন বিজ্ঞানীকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রদান বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয় ও তার প্রধান কারণকে মান্যতা দিতে হলে নোবেল কমিটিকে তো দাঁড়াতে হবে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের বিশ্বব্যবস্থায় বিরুদ্ধে, দাঁড়াতে হবে পুঁজির মুনাফা বৃদ্ধির হারকে বজায় রাখার ফিন্যান্স- পুঁজির মরিয়া প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। এই কাজ নোবেল কমিটি করবে না, বা পারবে না ঠিকই। কিন্তু এবারের নোবেল মানুষের সামনে একটা বিষয়কে হাজির করে দিল, তা হলো আরো বেশি বেশি মানুষ ভাবতে বাধ্য হবেন—জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-উষ্ণায়নের কারণ অনুসন্ধানে ও তার সমাধানের দিশা খুঁজতে।

উপসংহার:

আগে অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ ছিল না। উদারনৈতিক যুগেই তা নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে পুঁজি ও তার মালিকদের উদারনৈতিক কাজকর্মকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে। ১৯৬৮ সালে সুইডেনের সেন্ট্রাল ব্যাংকের ৩০০ তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেয়। ১৯৬৯ সালে প্রথম অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। আর ১৯৭০ সালে ডলারকে সোনা থেকে মুক্ত করা হয় এবং ধীরে ধীরে তেলের সাথে ডলারের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

আমরা আগেই বলেছি বিশ্বজুড়ে ডলারের প্রভাবের সাথে সাথে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ও পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েই চলল। প্রকৃতি-পরিবেশ সহ মানুষকে বিপর্যস্ত করার এই অর্থনীতি কোন ধরনের বিজ্ঞানের মধ্যে পড়ে তা আমাদের জানা নেই।

আসলে আজকের পুঁজিবাদে অর্থনীতিটা বড় হয়েছে প্রকৃতিকে ক্ষুদ্র করার মাধ্য দিয়েই। সেই অর্থের প্রবাহকে জীবন্ত করে, প্রকৃতিকে মৃত করে তুলছে। তাই জলবায়ু কেন্দ্রীক নোবেল প্রাইজ আর অর্থনীতির নোবেল পরস্পর দুটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া। এই স্ববিরোধী অবস্থান নোবেল কমিটি ঘোচাবে কি করে?

“মিনিস্ট্রি অফ আর্থ সায়েন্স” এর প্রাক্তন সচিব এম রাজিভান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন–“বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জ্বলন্ত সমস্যা হলো জলবায়ু পরিবর্তন। দুর্ভাগ্যজনক হলো এখনো সরকার, রাষ্ট্রনায়করা এবং জনগণের একটা অংশ এই বাস্তবতাকে বুঝতে পারছেন না। যদিও দ্রুত এই ভাবনার পরিবর্তন হচ্ছে। পদার্থবিদ্যায় এবারের নোবেল আরো বেশি করে জনগণকে ভাবতে বাধ্য করবে এই বিষয়ে।” মিস্টার রাজিভান, আপনি কিন্তু সোচ্চারে বলতে পারলেন না যে, জনগণের এই একটা অংশ মূলত কর্পোরেট বাহিনী এবং তাদের মুনাফার স্বার্থেই প্রকৃতি পরিবেশ ও মানব সভ্যতা দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। যদিও আইপিসিসির ফাঁস হয়ে যাওয়া একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে– একদল বিজ্ঞানী স্পষ্ট বলছেন যে ভূ-উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বিপাকীয় ফাটলের সমাধান বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় আদৌ সম্ভব নয়। তাই সমাধানের দিশা খুঁজতে হবে পণ্য সর্বস্ব ভোগবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং পুঁজির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের দুষ্টচক্রের বাইরে বেরিয়ে। ভাবতে হবে মানুষের ন্যুনতম প্রয়োজনে জনকল্যাণমুখী, পরিবেশবান্ধব, সহযোগিতামূলক এক বিশ্বব্যবস্থার কথা। অর্থাৎ বিপাকীয় ফাটলের সমাধানে “প্রোডাকশন এন্ড রিপ্রোডাকশন অফ রিয়েল লাইফ”- এই শ্লোগানকে অত্যন্ত জোরের সাথে সামনে আনতে হবে সকল রাজনৈতিক দল ও প্রকৃতি প্রেমিক মানুষকে। আর এই কাজ বাস্তবে করা সম্ভব– টুকরো টুকরো করে দেওয়া ফেটিশাইড বিজ্ঞানকে এক ইন্ট্রিগেটেড ব্যবস্থায় নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রো সিস্টেমের সাথে বৃহৎ জাগতিক ম্যাক্রো সিস্টেমের মেলবন্ধন ঘটানোর মধ্য দিয়েই। নতুন নতুন ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফা বাড়িয়ে নিয়ে চলার স্বার্থে নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে সমাজের স্বার্থে , প্রকৃতির কল্যাণে। এটাই এবারের পদার্থবিদ্যায় তিনজন বিজ্ঞানীর নোবেল প্রাপ্তির প্রধান এবং অন্যতম তাৎপর্য।

তথ্যসূত্র:
https://www.nobelprize.org/prizes/physics/2021/press-release/

Monthly Review–online publication.

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।

Contact: santoshsen66@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top