বজ্রপাতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কেন?

পোস্টটি দেখেছেন: 49 সন্তোষ সেন ” বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি সে কি সহজ গান?” “কোন তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে  “বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।” “সহসা ঝঞ্ঝা তড়িৎ শিখায় মেলিল গভীর আস্য রমণী কাঁপিয়া উঠিল তরাসে  প্রলয় শঙ্খ বাজিল বাতাসে আকাশে বজ্র ঘোর পরিহাসে হাসিল অট্টহাস্য।”                                  —-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।। পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পুরাণে দেবতাদের হাতে থাকা […]

বাজ

সন্তোষ সেন

” বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি সে কি সহজ গান?”

“কোন তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে

 “বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।”

“সহসা ঝঞ্ঝা তড়িৎ শিখায় মেলিল গভীর আস্য

রমণী কাঁপিয়া উঠিল তরাসে

 প্রলয় শঙ্খ বাজিল বাতাসে

আকাশে বজ্র ঘোর পরিহাসে হাসিল অট্টহাস্য।”

                                 —-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।

পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পুরাণে দেবতাদের হাতে থাকা সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী  হল বজ্র। এই বজ্রকঠিন বাজ পৃথিবীর আকাশে এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক ঘটনা। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সেই কবে ইতিহাসখ্যাত ঘুড়ির পরীক্ষার সাহায্যে এর বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আরো এগিয়েছে। বেড়েছে বায়ু দূষণ ও পৃথিবীর তাপমাত্রা। এসবের হাত ধরে বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা কিভাবে বেড়ে গেল তার সুলুক সন্ধান করবো এই নিবন্ধে। সবার আগে বজ্রপাতের বিজ্ঞানটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

 বিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ:

ভূপৃষ্ঠের গরম বাতাস বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে এবং এই গরম বাতাস উপরে উঠে জলীয়বাষ্প- বরফের টুকরো- ঠান্ডা জলকনার সংস্পর্শে এসে ঠান্ডা হয়ে তৈরি করে মেঘপুঞ্জ। গরম বাতাস যত উপরে ওঠে মেঘ তত আড়ে-বহরে বাড়তে থাকে। লক্ষ লক্ষ বরফের টুকরোর সাথে এই মেঘের সংঘর্ষে তৈরি হয় তড়িৎ-আধান। মেঘের উপরের অংশে সাধারণত ধনাত্মক এবং নিচের অংশে ঋণাত্মক আধান তৈরি হয়। ইলেকট্রিক ইন্ডাকশন বা তড়িৎ-আবেশের ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠের উঁচু গাছ, বড় বড় বাড়ি, আলোকস্তম্ভ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, এমনকি অনেক সময় সরাসরি মাটিতে থাকা মানুষের শরীরে তৈরি হয় ধনাত্মক আধান। এই দুই বিপরীত ধর্মী আধানের মধ্যে তীব্র আকর্ষণের ফলে তৈরি হয় প্রবল পরাক্রমশালী তড়িৎ প্রবাহ, যার পরিমাণ গড়ে ৩০ থেকে ১২০ কিলোএম্পিয়ার। প্রবল তড়িৎ আধান সৃষ্টির ফলে প্রকৃতিতে যে অসাম্য বা অস্থিরতার জন্ম নেয়, তাকে সমতায় ফিরিয়ে আনে গাছপালা- বাড়িঘর ও মানুষের শরীরের মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ-প্রবাহ। এটাই প্রকৃতির নিয়ম বা খেয়াল, যা বয়ে নিয়ে আসে প্রচুর প্রাণ ও সম্পদহানি।

আর একটি বিষয়– অতি উচ্চ-বিভবের (১৩০ কোটি ভোল্টের মত) তড়িৎ-স্রোত ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রনকে যে গতিবেগ দিতে পারে তা বায়ুস্তরের অন্যান্য অনু-পরমানুকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়–অপরিবাহি বায়ুস্তরও আয়নিত হয়ে পড়ে। মেঘ থেকে মেঘে, মেঘ থেকে মাটিতে ছুটে চলে বৈদ্যুতিক শক্তি তীব্র ঝলকানিকে (lightning flashes) বগলদাবা করে। উল্লেখ্য, ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১ কিলোমিটার উচ্চতায় বজ্রগর্ভ মেঘ ঘন্টায় ৬০ কিমি বেগে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় চারশত বর্গকিমি জায়গাজুড়ে এবং তৈরি হওয়ার ছয় মিনিটের মধ্যেই দুই বিপরীত আধানের মধ্যে ঐ উচ্চ-বিভব জন্ম নেয়।

গুরুগম্ভীর বজ্রনাদের কারণ:

 বজ্রপাতের এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে অতি শক্তিশালী (১০০ কোটি জুল) বিদ্যুৎ-প্রবাহ বায়ুমন্ডলে আছড়ে পড়ে। এই শক্তিতে আঘাত করার ফলে বায়ুস্তরের তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৩০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, অর্থাৎ সূর্যের বহির্তলের পাঁচগুণ তাপমাত্রায়। এই গরম বায়ুস্তর বিস্ফোরকভাবে সম্প্রসারিত (explosively expansion) হয়–তৈরি হয় শক-ওয়েভ। অন্যদিকে আশেপাশের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বায়ুস্তর সংকুচিত হয়। বায়ুস্তরের এই তীব্র প্রসারণ ও সংকোচনের ফলে তৈরি হয় পিলে চমকে দেওয়া রণদুন্দুভি–তীব্র বজ্রনিনাদ।

বাজ

 প্রাণহানির তথ্য:

 কৃত্রিম উপগ্রহে বসানো Geostationary Lightning Mapper instruments এবং নাসা’র Lightning Imaging Sensor সহযোগে বজ্রপাত ও আলোর ঝলকানিকে সনাক্ত করা হয়। এখান থেকে জানা যায়– প্রতিবছর (বিশেষ করে  গ্রীষ্ম-বর্ষা কালে) বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান। বর্তমানে এই সংখ্যাগুলো অনেক বেড়ে গেছে। এক ঝলকে কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাক। বজ্রপাতে আমেরিকার ফ্লোরিডা বা সিঙ্গাপুর যেমন বিপর্যস্ত, তেমনি গ্রীনল্যান্ড বা উত্তর মেরুর বিস্তীর্ণ তুন্দ্রা অঞ্চল ছারখার হয়ে যাচ্ছে লাগাতার বজ্রপাতে। ভারতের বার্ষিক লাইটনিং-রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের শেষ দিনে। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে– বিগত এক বছর সময়কালে ১,৭৭১ জন মানুষ মারা গেছেন বজ্রপাতের করাল গ্রাসে। এই সময়ে শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশে প্রায় ১৫ লক্ষ বজ্রপাতের ঘটনা রেকর্ড করা গেছে। অন্যদিকে এনসিআরবি ‘র রিপোর্ট বলছে–২০০১ থেকে ২০১৮, এই সময়কালে ভারতে মারা গেছেন ৪২,৫০০ জন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২,৩৬০ জন ভারতীয় মারা যান শুধুমাত্র বজ্রাহত হয়ে, যার মধ্যে অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলের গরিব খেটে-খাওয়া প্রান্তিক মানুষ।

এই বছরের ৭ই জুন পশ্চিমবঙ্গে রেকর্ড সংখ্যক (৩৭,০৫৬ টি) বজ্রপাতের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। বজ্রপাতের ৬৩% আঘাত হেনেছে মাটিতে বাকি ৩৭% হারিয়ে গেছে আকাশে মেঘের কোলে। স্থানীয়স্তরে তৈরি বজ্রগর্ভ মেঘ জামালপুর, বলরামপুর সহ পাঁচ জেলায় ৩৩ জন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়েছে।

পরিবেশে দূষণের ভূমিকা:

জীবাশ্ম জ্বালানির অপরিমিত ব্যবহার, তথাকথিত উন্নয়ন ও বাজার-নির্ভর ভোগবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার যাঁতাকলে নির্বিচারে সবুজ বনানী ধ্বংস এবং ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলে লাগিয়ে দেওয়া আগুনের লেলিহান শিখায় পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ক্রমশই বাড়ছে। যার হাত ধরে গরম আর্দ্র বাতাস আরো বেশি বেশি করে বজ্রগর্ভ মেঘের জন্ম দিচ্ছে। বাড়ছে বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা দুই’ ই। এই বছর ৭ ই জুন বলরামপুর ও জামালপুর অঞ্চলের তাপমাত্রা রাজ্যের অন্যান্য জেলার থেকে দেড় ডিগ্রি বেশি ছিল। বজ্রপাতের বাড়-বাড়ন্তের পিছনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো– বাতাসে ভাসমান দূষিত কণার (aerosols) বাড়তি উপস্থিতি।

আ্যরোসলের ভূমিকা:

      যানবাহন ও কারখানার দূষিত কালো ধোঁয়া, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র-কয়লা খনি থেকে উড়ে আসা কয়লার গুঁড়ো, নির্মাণকাজের বিষাক্ত ধূলো-ধোঁয়া, সমুদ্রে চলাচলকারি জাহাজ থেকে উদ্গিরিত নানান ভাসমান কনা বা আ্যরোসল

 বজ্রপাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। “এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড পলুশন রিসার্চ” থেকে জানা যাচ্ছে–আ্যরোসল বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে দিয়ে বজ্রগর্ভ মেঘের জন্ম দিচ্ছে অনেক বেশি হারে। অথচ বাতাসে আ্যরোসল বা ভাসমান দূষিতকণার পরিমাণ কম থাকলে পরিষ্কার জলীয়কনা আশেপাশের জলীয়বাষ্পকে টেনে নিয়ে আকারে বড় হয় এবং বৃষ্টি হয়ে ধরণীতে ঝরে পড়ে, সম্ভাবনা কমে বজ্রপাতের। MIT ‘ র বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন–বিশ্বজুড়েই বজ্রপাতের ঘটনা ২০২০ সালে ২৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

          MIT ‘ র বিজ্ঞানী অধ্যাপক Tim Cronin বলেছেন–“দূষণ দূর করতে পারলে বজ্রপাতের  সংখ্যা ও তীব্রতা নিঃসন্দেহে কম হবে”। তিনি অন্ততঃ সঙ্গতভাবেই বলেছেন–আধুনিক(!) মানুষ দম্ভভরে প্রকৃতির বুকে পদাঘাত করে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে দেখা যায়নি।

 সম্ভাবনা ও সমাধান:

 সম্প্রতি “জিওফিজিক্যাল রিভিউ লেটার” জার্নালে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে– একটি শক্তিশালী বজ্রপাতের মধ্যে ১৩০ কোটি ভোল্ট তড়িৎ-বিভব তৈরি হয়, যা দুই গিগা ওয়াট (২০০ কোটি ওয়াট) তড়িৎ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এরকম একটি তীব্র বজ্রপাতের ক্ষমতা একটি শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও বেশি। সূর্য থেকে আগত মহাজাগতিক রশ্মির সাথে মিউঅন কনার (muon particles) বিক্রিয়ায় যে শক্তি ক্ষয় হয়, তাকে কাজে লাগিয়ে “টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, মুম্বাই” এই হিসেব-নিকেশ করেছে। প্রযুক্তিগত এই জটিলতায় না গিয়েও বলা যায়– এই বিপুল বিশাল পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তিকে সংরক্ষিত করতে পারলে কয়লা বা জীবাশ্ম জ্বালানি না পুড়িয়েই পৃথিবীর শক্তি-সংকট কে সমাধান করার উপায় চলে আসবে হাতের মুঠোয়। দুঃখের বিষয় বজ্রপাতে তৈরি হওয়া এই অতি উচ্চ-বিভবের বিদ্যুৎ শক্তিকে বেঁধে ফেলার মত কোন প্রযুক্তি বিজ্ঞানীরা এখনো করায়ত্ত করতে পারেন নি।

অতকিম??

আসুন, এই অনাগত ভবিষ্যতের আশায় বুক বেঁধে বর্তমান বিপর্যয়ের সমাধানের পথ খুঁজি। বজ্রাহত হওয়া থেকে মানুষকে বাঁচাতে কী কী  করিতে হইবে এবং কী কী করিতে হইবে না, সেই সম্পর্কে জনসচেতনা বাড়াতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনকে সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে।  “দামিনী, লাইটনিং অ্যালার্ট” মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে (যা বর্তমানে সরকারি অপদার্থতা ও উদাসীনতার কারণে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়) বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা আধঘণ্টা আগেও পৌঁছে দেওয়া যায় মাঠে-ঘাটে চাষের কাজে নিযুক্ত, নদী বা  সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া, জঙ্গলে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে যাওয়া, বা গোচারণে ব্যস্ত মানুষগুলোর কাছে। এতে করে প্রাণহানির সংখ্যা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। অবশ্য অতি সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে লাইটনিং সেন্সর বসানোর কাজ শুরু হয়েছে।

নির্মীয়মান অট্টালিকা বা বহুতলে বজ্র-প্রতিরোধী ডান্ডা (lightning arrester) বসিয়ে বজ্রপাতকে অনেকাংশেই আটকে দেওয়া যায়। এইক্ষেত্রে বজ্র-রোধী পরিবাহির মাথায় লাগানো spikes বা সূঁচাল অংশে জমা হওয়া ধনাত্মক আধানকে মাটি থেকে ধেয়ে আসা ইলেকট্রনের স্রোত প্রশমিত করে। মনে রাখা দরকার উলুধ্বনি বা শঙ্খধ্বনি দিয়ে বাজকে প্রতিহত করা যায় না, বজ্রপাত ঘটবে তার নিজস্ব বিজ্ঞান মেনেই। পরিশেষে বলবো– এসব ব্যবস্থা ও উদ্যোগের পাশাপাশি বায়ু দূষণ ও বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে লাগাম টানুক রাষ্ট্রনায়করা। মানুষ বাঁচুক– বাঁচুক প্রকৃতি পরিবেশ।।

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।

Contact:  santoshsen66@gmail.com

2 thoughts on “বজ্রপাতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কেন?”

    1. Of course. But to maintain green earth we have to stand against the greeds of the corporates. For their Himalayan profit they are destructing jol jongol jomin and all natural resources. There is no solution in the production circuit. We have to think about reproduction of natural live.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top