নারী-শক্তি : মৃন্ময়ী ভেঙে চিন্ময়ী

পোস্টটি দেখেছেন: 71 অনিরুদ্ধ দত্ত রাজস্থানের পিপিলান্ত্রি গ্রাম। অন্য আর পাঁচটা  গ্রামেরই মত। হয়তো ঠিক বলা হলো না। কারণ তা অন্তত একটা বিষয়ে স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে পেরেছে। এই গ্রামে কন্যা সন্তানের জন্ম এক আনন্দের আবহ তৈরি করে। উৎসব হয় গ্রামজুড়ে। প্রতি কন্যা সন্তান জন্মালে লাগানো হয় একশো এগারোটা গাছের চারা। প্রধানত ফলের ও নানা ঔষধি […]

পিঞ্জরা তোড়'

অনিরুদ্ধ দত্ত

রাজস্থানের পিপিলান্ত্রি গ্রাম। অন্য আর পাঁচটা  গ্রামেরই মত। হয়তো ঠিক বলা হলো না। কারণ তা অন্তত একটা বিষয়ে স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে পেরেছে। এই গ্রামে কন্যা সন্তানের জন্ম এক আনন্দের আবহ তৈরি করে। উৎসব হয় গ্রামজুড়ে। প্রতি কন্যা সন্তান জন্মালে লাগানো হয় একশো এগারোটা গাছের চারা। প্রধানত ফলের ও নানা ঔষধি গাছ থাকে এই রোপনে। পরিবারটির হাতে গ্রামের মানুষ সকলে মিলে তুলে দেন অর্থসাহায্য –সন্তানকে নির্দিষ্ট বয়সের আগে বিয়ে দেওয়া যাবেনা এবং তাকে বিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণ করাতে হবে এই শর্তে। নবজাতক কন্যার নামে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে কিছু অর্থ রাখা হয় গ্রামবাসীদের দেওয়া অর্থ থেকে । গ্রামটি আজ সবুজে মোড়া। গাছের পরিচর্যা করেন সকলে মিলে, প্রধানত মহিলারা।

গাছগুলো যেন তাদের সন্তান। নারী ও প্রকৃতির সাদৃশ্য এই গ্রামে কোন তত্ত্বকথা নয়, বাস্তবের অনুশীলন। দিন যাপনের কষ্টকর প্রাত্যহিকতায় পরিবারেরই সন্তান গাছগুলি-পরিবারকে সাহায্য করে, পরিবার থেকে সাহায্য নেয়। জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্বে- ছন্দে গ্রামের অরণ্যভূমি সংরক্ষিত, সম্প্রসারিত ও স্বাস্থ্যবান থাকে। আশ্রয় পায় কীটপতঙ্গ থেকে ছোটবড়ো প্রাণী, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় আর তাই বৈচিত্র‍্যের বর্ণময়তায় চিত্রিত হয় উদ্ভিদজগত।

             আকাশে মেঘ জমে, বৃষ্টি নামে, মাটির নীচে আশ্রয় পায় জল,জলাশয়ের আবাসিকরা প্রাণপ্রাচুর্যে ঘোষনা করে প্রকৃতিতে তাদের প্রয়োজনীয় অস্তিত্ব।  বাতাস নির্মল হয়ে প্রাণকে করে সজীব। ধরিত্রী আহ্বান করে নতুন প্রাণকে।

                স্পষ্টতই এই প্রজনন আর পুনরুত্পাদনে নারীরা কেবল জৈবিক তাড়নাতেই সক্রিয় থাকে এমনটা নয়। জীবিকা নির্বাহে সামাজিক ভূমিকার মাধ্যমেও উৎপাদন আর পুনরুৎপাদন চলে। জীবনের স্থায়িত্ব আর প্রগতি এই প্রজনন আর  পুনরুত্পাদনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে। প্রকৃতির প্রতি বিরূপতা ও বিরোধের অবসান নারী অবদমন আর প্রান্তিকীকরনের বিরুদ্ধে নারী শক্তিকেই উজ্জীবিত করে। যে পুরষতন্ত্র  নারী অবদমনের রূপকার, তাই রচনা করে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার এক বৈরী  সম্পর্কের দীর্ঘ যাত্রা। এখানে, এই পিতৃতন্ত্রে, পুরুষের ঐহিক জ্ঞানই মানুষের জ্ঞানের একমাত্র প্রতিফলন।  জীববিজ্ঞানে নারী ও পুরুষের যে প্রভেদ, পুরুষতন্ত্র সেই প্রভেদকে বিভেদে রূপান্তরিত করে।  প্রকৃতিকে অপ্রাকৃতিক করাই এই তন্ত্রের যাত্রা মুখ। তাই বৈষম্যহীন প্রভেদে তা আটকে থাকতে পারে না। একটা জীব- কোষের ভিতরে দৃষ্টি ফেলা যাক, প্রভেদ স্পষ্ট হবে। তবে তা কোন বিভেদের সূচক নয় যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞান তা আবরিত করে রাখে নারী অবদমনের আচ্ছাদনে । শক্তির উৎস হয়েও নারী তাই পুরুষতন্ত্রের প্রবল প্রতিপত্তির শিকার।

 প্রজনন প্রক্রিয়ায় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে তৈরি হয় জাইগোট, নতুন দেহকোষ। নিষেকের সময় পুরুষ দেহ থেকে আসা শুক্রাণুর কেবলমাত্র নিউক্লিয়াস অংশটি নতুন দেহকোষ অর্থাৎ জাইগোট গঠনে অংশ নেয়। একটা দেহ-কোষ আবাসে যেসব অঙ্গাণু থাকে তার অন্যতম প্রধান মাইটোকন্ড্রিয়া। নিউক্লিয়াসের বাইরে কোষের সাইটোপ্লাজম অংশে তা থাকে।  মাইটোকন্ড্রিয়া কোষের শক্তিঘর। কারণ এর মধ্যে থাকে এডিনোসিন ট্রাই ফসফেট (এ টি পি) যা  শক্তি উৎপাদন করে খাদ্যবস্তুর মধ্যে আটকে থাকা সৌরশক্তি থেকে। শরীরে শক্তি উৎপাদনে এটিপির ভূমিকাকে ‘এনার্জি কারেন্সি’-ও বলে উল্লেখ করা হয়। বিদ্যুৎ তৈরীর কারখানায় যেমন কয়লা শক্তি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরী করে টারবাইন, খাদ্যের শক্তি  শরীরের উপযোগী করার টারবাইন এটিপি। মাইটোকন্ড্রিয়ায় থাকা ক্রোমোজোমের DNA (ডিঅক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)-কে মাইট্রোকন্ডিয়াল ডিএনএ (mt-DNA) বলে।

তাই স্পষ্টতই প্রাণের যাত্রা হল যে জাইগোটটির মধ্যে দিয়ে তার নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ থাকে তার অর্ধেক আসে বাবার জনন কোষ শুক্রানু থেকে, বাকি শতকরা 50 ভাগ অর্থাৎ অর্ধেকটা মায়ের জনন কোষ ডিম্বাণু থেকে। কিন্তু সাইটোপ্লাজমে থাকা মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ – এর শতকরা 100 ভাগই আসছে মায়ের দেহ থেকে কারণ পুরুষ জনন কোষের সাইটোপ্লাজম অংশ জাইগোট গঠনে কাজে আসে না। তাই অপত্যের (offspring) দেহকোষের শক্তিঘর তৈরি হতে মায়ের সহযোগিতা (অতি সামান্য দু’একটা প্রাণীর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাদ দিলে) এক এবং একমাত্র ভূমিকা নেয়। সেই অর্থে সন্তানের দেহে শক্তি সরবরাহের ‘লাইফ লাইনটি’ চালু থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এটিপি একমাত্র মায়েরই শক্তি পরম্পরায় পাওয়া। প্রাণের উত্পাদন ও পুনরুত্পাদন এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের শক্তিরঅংশ হয়ে ওঠে সকল প্রাণ। ডিম্বাণু সৃষ্টির রূপকার নারী তাই ‘শক্তিরূপেন সংস্থিতা ‘।

                   শক্তির এই সংস্থান-কেই এদেশে আজ ব্রাহ্মণ্যবাদ মৃন্ময়ী মূর্ত্তিতে আটকে রাখতে চাইছে। ‘পিঞ্জরা তোড়’ জাতীয় নারীমুক্তির আন্দোলন তাকে দিতে চাইছে চিন্ময়ী রূপ। ব্রাহ্মণ্যবাদী অবস্থান তথা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ওঠা বিশ্বজোড়া আওয়াজ প্রকৃতি সংহারের বিরুদ্ধে স্বভাবতই তার বর্শামুখ উদ্যত রাখছে। পিপিলান্ত্রি গ্রামের পথ মিলে যাচ্ছে আন্দোলনের এই রাজপথে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top