সাধন কুমার ঘোষ: ইতিহাসের পাতা জুড়ে শোনা যায় অস্ত্রের ঝনঝনানি। শৌর্যবীর্যের সেইসব কাহিনী, গৌরবগাঁথা, যুদ্ধের মাহাত্ম্য শৈশব থেকেই শিশুমনে গেঁথে দেওয়া হতে থাকে। সাম্রাজ্য বিস্তারের বীরত্বব্যঞ্জক বর্ণনায়, শত্রু দেশের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ে দেশপ্রেমের বন্যায় হাজার হাজার মানুষের হত্যা, অত্যাচার,বিভৎসতার,বৈধতার যুক্তি সাজানো হয়। সাহিত্য, নাটক, সিনেমাতেও বীর সেনানীর জয়জয়কার। সর্বাধুনিক ট্যাঙ্কের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে শত্রু শিবির ধ্বংস করে দেওয়ার দৃশ্য, বিমান হানায় জনপদ তছনছ করে দেওয়ার ধারাবিবরণী টিভির পর্দায়, সিনেমায় আমাদের মনে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। আমাদের চেতনা এক পরাবাস্তব জগতে বিচরণ করতে থাকে, আমদের বোধ বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে অনুভব করতে অক্ষম হয়ে পড়ে কিসের জন্য এই যুদ্ধ, কার স্বার্থে এই হাজার হাজার সেনানীর, সাধারন মানুষের প্রাণ বলিদান, কেন এই যুদ্ধের খোরাক হতে হয় উভয় পক্ষের সাধারণ মানুষদেরই। আসলে আমাদের বুঝতেই দেওয়া হয় না সাধারণ মানুষের স্বার্থে যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের উপর। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে অভিনব লড়াই চালিয়েছিলেন এক আমেরিকান সৈনিক। তিনি আমেরিকান সেনাবাহিনীতে কারও যোগ দিতে না চাওয়ার অধিকারের স্বপক্ষে দাবি করেছিলেন।
“Corporal Desmond Thomas Doss” ২য় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু তিনিই একমাত্র সৈনিক যিনি যুদ্ধের সমগ্র সময়কালটিতে অস্ত্র ধরতে অস্বীকার করে একটিও গুলি ছোঁড়েন নি। তিনি বন্দুক বহন করতেও অসম্মত হন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু সৈন্য হত্যা করতে অস্বীকার করায় তাঁকে সতীর্থদের বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়, তাঁকে ভীতু বলেও সাব্যস্ত হতে হয়।এজন্য তাঁকে কোর্ট মার্শালের হুমকির মধ্যেও পড়তে হয়। যুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিশোধের দামামা অনবরত বাজতে থাকে, তারমধ্যে তিনি ছিলেন এক ব্যাতিক্রমী চরিত্র। অথচ এই যুদ্ধে তিনি কম বিপদের মধ্যে পড়েন নি,জাপানি গ্রেনেডের মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। তাঁর পায়ের কাছে গ্রেনেড পড়ে বিস্ফোরনের ফলে আক্ষরিক অর্থেই তিনি উড়ে গিয়েছিলেন। গোলার টুকরো তাঁর পা থেকে হিপ এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হয়ে যায়,নিজের ক্ষত নিজেই শুশ্রুষা করেন।স্লিপার বুলেটে তাঁর বাহু ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।তাঁর ব্যাক্তি জীবনে যুদ্ধের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনাও তাঁকে তাঁর স্থির সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও সরাতে পারে নি।
সারা যুদ্ধে যিনি একজন শত্রু সৈন্য হত্যার কথাও ভাবতে পারেন নি তিনিই কিন্তু বিপদাপন্ন সৈন্যদের প্রাণ বাঁচাতে, সে শত্রু পক্ষের হোক বা যাঁরা তাঁকে বিদ্রুপ করেছিল,তাদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেননি। জাপানের Okinawa-র যুদ্ধে আমেরিকান বাহিনী পর্যুদস্ত হলে আহত সেনাদের ফেলে পশ্চাদপসরণ করে, কিন্তু Desmond আহতদের ফেলে পালাতে অস্বীকার করেন। তিনি Haekeaw Ridgeএর খাড়া পর্বত গাত্র থেকে অসাধ্য সাধন করে একক প্রচেষ্টায় প্রায় ৭৫ জন আহত সৈন্যকে নীচে নামিয়ে আনেন,তাদের আঘাতের প্রাথমিক শুশ্রুষা করে প্রাণ বাঁচান। অসম সাহসিকতার এই কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি এক অবিস্মরণীয় মানবিকতার নিদর্শন রেখে গেছেন। যাদের তিনি প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তার মধ্যে শত্রু পক্ষের কয়েকজন জাপানী সৈন্যও ছিল।
Mel Gibson পরিচালিত Desmond এর জীবনী অবলম্বনে নির্মিত কাহিনী- চিত্রে এ ঘটনা চিত্রিত হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান এ কাজের জন্য ১২ ই অক্টোবর(১৯৪৫) তাঁকে আমেরিকার সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান Medal of Honor দিয়ে ভূষিত করেন। কিন্তু যুদ্ধের নামে মানুষকে হত্যার জন্য অস্ত্র ধরার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কোনো স্বীকৃতি তিনি পাননি। বস্তুত কোনো রাষ্ট্রই তাঁর এই অবস্থান সমর্থন করবে না। Desmond Doss তাঁর নিজের মতো করে পৃথিবী থেকে চিরতরে যুদ্ধ দূর করার যুদ্ধ চালিয়ে ২০০৬ সালের ২৩ শে মার্চ চিরবিদায় নিয়েছেন। তাঁর পুত্র Jr. Doss বলেছেন তাঁর বাবা মানুষের প্রতি যে প্রকৃত ভালোবাসা দেখিয়ে গেছেন সেটা শুধু সতীর্থ নয় শত্রু সৈন্যদের প্রতিও সমানভাবে প্রযুক্ত ছিল। পৃথিবী থেকে যদি কোনোদিন যুদ্ধ চিরতরে বিদায় নেয় সেদিন এই স্বপ্নদর্শীর অস্ত্রহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা সার্থক হবে।
ডেসমন্ড ডস কে নিয়ে টিভি শো
এই লেখাটি পরিপ্রশ্ন পরিবারের সদস্য সাধন কুমার ঘোষ লিখেছেন। টেকনিক্যাল মিশটেক এর কারণে ওনার নামটি আসে নি। আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। দেশে দেশে যুদ্ধ উনমাদনা ও যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে রাখার চক্রান্তের আবহে এই লেখাটি সত্যি খুব জরুরী। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
Desmond Doss এর একটি ইন্টারভিউও আমরা জুড়ে দিয়েছি।