বঙ্কিম দত্ত
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর সন্ত্রাসমুক্ত কাশ্মীরের বিশ্বাস আক্রান্ত। পহেলগাঁওতে ২৬ জন পর্যটকের নৃশংস হত্যাকান্ড ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের বিবেককে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদীরা বেছে বেছে হিন্দু পর্যটকদের গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। আক্রমণে বাধা দিতে গিয়ে গুলিতে নিহত হয়েছেন একজন মুসলমান ঘোড়াচালক। আহত অনেক পর্যটককেই আঞ্চলিক মুসলমান অধিবাসীরা পিঠে বহন করে বা ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্রুত নিয়ে গেছেন। অন্যথায় মৃতের সংখ্যা বাড়তো। পর্যটকদের আপ্রাণ সহযোগিতার জন্য কাশ্মীরি সমাজের বিভিন্ন ভূমিকার কথা জানতে চাইলে জানা যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদীদের বিরোধিতায় দিনরাত বিক্ষোভ জানাচ্ছে কাশ্মীরের অধিবাসীরা। একথা জানাতে বাধ্য হয়েছে বড় ও প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াও যারা গোদী মিডিয়া হিসাবে বেশী পরিচিত এবং সংবাদকে যারা স্টোরি বলে । মুসলিম মৌলবাদজারিত এই সন্ত্রাসবাদ আপন নিয়মেই এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মৌলবাদের আগুণে ঘি ঢেলেছে। ঘৃণা ও অন্ধবিশ্বাস যুক্তিহীন আবেগ হয়ে আছড়ে পড়ছে মুসলিম ধর্মালম্বীদের প্রতি। অকুস্থল কাশ্মীর ও কাশ্মীর রাজ্য মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য হওয়ায় তাদের ভিলেন চিহ্নিত করতে অসুবিধা হচ্ছে না। কাশ্মীরের জনজীবন আপাতত বেশ কিছুদিনের জন্য হ’লেও সামরিক বাহিনীর ঘেরাটোপে ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের চোখ রাঙানী নীরবে মনে নিতে বাধ্য। সমাজ ও রাজনীতি এই ঘটনায় স্বভাবতই মুখর । ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিবেশী দেশগুলোও পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্বীকার করেছে উপমহাদেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর জন্য পাকিস্তানকে আমেরিকার অর্থসাহায্য বরাদ্দের কথা । ভারত প্রতিবাদ ও প্রতিশোধস্বরূপ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে। সিন্ধুনদীর জল দেওয়া বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনার ঘনঘটায় আপাতত বেশ কিছুদিন দেশের রাজনীতির কার্পেটের তলায় চালান হয়ে যাবে কাশ্মীরিদের জল,মাটি,বাতাস ও মানুষের দু:খ-কষ্টের রোজনামচা। ধারা ৩৭০ হারিয়ে(৫ অগষ্ট ২০১৯) কাশ্মীরের মানুষের ও কাশ্মীরের পরিবেশের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশের খাতাটা বন্ধ রাখতে হবে কাশ্মীরবাসিকে। এক পারস্পরিক অবিশ্বাসের লালন ৩৭০ ধারাকে বারবার মনে করাবে।
“কাশ্মীর সমস্যার সমাধান নয়, ৩৭০ রদ হলো সমস্যাকে নতুন ভাষা দেওয়া।”—এক কাশ্মীরি সাংবাদিকের ডায়েরি থেকে । অনুচ্ছেদ ৩৭০ ছিল :
জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন, রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান ও আইন যেখানে কেন্দ্রীয় আইন সরাসরি প্রযোজ্য হতো না (সীমিত ক্ষেত্রে ছাড়া)।বহিরাগতদের স্থায়ীভাবে বসবাস, জমি কেনা নিষিদ্ধ ছিল। অনেক কাশ্মীরি এই রদকে “সংবিধানিক বিশ্বাসভঙ্গ” হিসেবে দেখছেন। সামান্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের একটা অংশ একে “সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদ” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
পর্যটনের উত্থানে হোটেল, হোমস্টে বেড়েছে, কিন্তু মালিকানায় বহিরাগতদের দখল। স্থানীয় গাইড, শিল্পীরা বলছেন, “আমাদের হাতে টাকা আসে না, মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যায়।”
গণতান্ত্রিক ভাষ্য হিসাবে যে প্রশ্ন প্রথমেই ওঠা দরকার তা হ’লো
সাধারণ কাশ্মীরির চোখে ৩৭০ রদ : “স্বাধীনতা” নাকি “অধিকারহরণ” ?
“৩৭০ ছিল আমাদের সঙ্গে ভারতের ‘চুক্তি’। এটা উঠে যাওয়া মানে আমাদের সম্মতি না নিয়েই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া,” বলেছেন শ্রীনগরের এক কলেজ শিক্ষক।
বাস্তবিকই বহিরাগতরা এখন জমি কিনতে পারবেন—এই ভয়ে অনেক কৃষক জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। “দাম বাড়ানোর লোভে কিছু লোক জমি বিক্রি করছে, কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা নিজের গ্রামে পরবাসী হবো না তো?”—কুলগামের এক যুবকের প্রশ্ন। ১৫ বছরের বসবাস বা সরকারী চাকরি থাকলেই কাশ্মীর রাজ্যে ডোমেসাইল সার্টিফিকেট পাওয়া যাচ্ছে যা ধারা ৩৭০ আগে ছিল না। ২০২২ পর্যন্ত ৩.৪ মিলিয়ন ডোমেসাইল সার্টিফিকেট ইস্যু হয়েছে।
আগে রাজ্য সরকারি চাকরিতে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ছিল। এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে, তাই স্থানীয় যুবাদের দাবি—”আমাদের জন্য রিজার্ভেশন কমছে।”
পর্যটনের উত্থানে হোটেল, হোমস্টে বেড়েছে, কিন্তু মালিকানায় বহিরাগতদের দখল। স্থানীয় গাইড, শিল্পীরা বলছেন, “আমাদের হাতে টাকা আসে না, মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যায়।”
অ্যাপেল বাগানের সংকট ধীরেধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। কাশ্মীরের বিখ্যাত আপেল চাষীরা চিন্তায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চুক্তি চায়, কিন্তু ছোট চাষীরা বলছেন—”এখন আমাদের জমিও কিনে নেবে, ফসলের দামও ঠিক করবে কোম্পানি। এটা উন্নয়ন নাকি নতুন কলোনিয়ালিজম?”
সবচেয়ে বড় বিপদ পরিবেশের। পাহাড়-নদী-জঙ্গল কাশ্মীরে এখন “বিনিয়োগের সম্পদ”। বিধিনিষেধর বাধা না থাকায় খুল্লাম-খুল্লা এই বিকিকিনির হাট। উদাহরণ বেটাবনি কেস। ডাল লেকের কাছে বেসরকারি রিসোর্ট নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের প্রতিবাদ। “এরা পাহাড় কেটে কংক্রিটের জঙ্গল বানাচ্ছে, আমাদের ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে,” বলেন একজন পরিবেশকর্মী।
কেন্দ্রের কঠোর নিয়ম শিথিল করা নতুন নীতিতে কাশ্মীরে খনিজ উত্তোলন, রাস্তা নির্মাণের নিয়ম সহজতর হয়েছে। কাশ্মীরের মাটির নীচে অত্যন্ত মূল্যবান ও ইলেকট্রনিক শিল্পে বিশেষ কার্যকরী সিরিয়াম ও অন্যান্য ‘বিরল মৃত্তিকা মৌল’ রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ—”পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন চলে না।” কিন্তু তাই চলছে। সবাই চুপ। সংসদে আলোচনা নেই। ৩৭০ ধারা রোধে সমর্থনকারী লাদাকবাসীর স্বায়ত্বশাসন ও পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে বর্তমান কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতারণা প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ।
ভোটের গণতন্ত্রে এসব অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলগুলির কণ্ঠস্বরও সরব নয়। ২০১৯-পরবর্তী সময়ে মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাহর মতো নেতাদের গ্রেপ্তার বা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন—”আমাদের ভোট আছে, কিন্তু ভোটে কী পরিবর্তন আসে?” চেকপোস্ট, ইন্টারনেট শাটডাউন, রাস্তায় সেনা টহল—এগুলো এখন দৈনন্দিন রুটিন যা বাড়বে ক্রমাগত । এক যুবকের কথায়—”আমরা কারাগারে বাস করছি, শুধু দরজাটা খোলা।”
উন্নতির আশা যে স্বল্প কাশ্মীরবাসী করেছিলেন তারাও আশঙ্কিত। যুবসমাজের মধ্যে বিভাজন ঢুকছে। কিছু যুবক বলছেন—”ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্টদের সঙ্গে কাজ করলে আয় বাড়ে।” অন্যদের মত—”এটা ধীরে ধীরে আমাদের পরিচয় মুছে ফেলার প্রক্রিয়া।”
নতুন প্রতিরোধ তৈরী হচ্ছে নতুন দিশায়। স্বাধীনতার হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ প্রতিবাদ তুলছে শিল্প-সাহিত্যে। কাশ্মীরিরা তাদের ক্ষোভ ফুটিয়ে তুলছেন নানা পন্থায় । এক কবির কবিতার লাইন—
“তোমরা আমাদের পাহাড় দাও, কিন্তু জমি কেড়ে নাও।
আমাদের লেকের জল দেখার অধিকারও এখন পর্যটকের?”
দেশের অন্যসব অংশের মতো কাশ্মীরেও “কার উন্নয়ন, কার স্বার্থ” এই প্রশ্ন জোরাল হয়ে উঠছে।
ধারা ৩৭০ রদের পর কাশ্মীরের মাটি ও মানুষের ওপর যে পরীক্ষা চলছে, তা “উন্নয়ন” নামক এক বহুমাত্রিক খেলার মাঠ। প্রশ্ন হলো—এই খেলায় স্থানীয় কাশ্মীরবাসী৷ খেলোয়াড় নাকি খেলার মাঠের ফুটবল? কাশ্মীরিরা চায় না তাদের ভবিষ্যৎ দিল্লি বা মুম্বাইয়ের বোর্ডরুমে ঠিক করা হোক। তাদের কথা শোনার জায়গা তৈরি না করলে, শান্তি কাগজে-কলমে থাকবে, বাস্তবে নয়।
প্রবন্ধটি নিয়ে আপনার মতামত জানান। নিচে মন্তব্য করুন।





