সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
74 তম স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শোনা গেল আত্মনির্ভর ভারতে উন্নয়নের ‘কার্বন নিরপেক্ষ মডেল’ এর কথা | লে, লাদাখ এবং কার্গিলকে কার্বন নিরপেক্ষ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগের কথা ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী | পাশাপাশি লাদাখে ৭৫০০ মেগাওয়াট এর একটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করা হলো | এ ছাড়াও ছিল আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ১০০ টি শহরের বায়ুদূষণ (পড়ুন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা) কমানো, কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের উদ্যোগ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে একাধিক প্রকল্প সংক্রান্ত ঘোষণা | কিন্তু এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট আইনের সংশোধনী এনে উন্নয়নের নামে এদেশের প্রকৃতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অবাধ লুন্ঠন ও ধ্বংসের পরোয়ানা জারি করা নরেন্দ্র মোদীর হঠাৎ এহেন গদগদ পরিবেশপ্রেম প্রদর্শনের কারণ কি ? ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে মুকেশ আম্বানির জবানিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গল্প শুনলে |
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এর 43 তম বার্ষিক সাধারণ সভায় আম্বানি বলছেন– “We have a 15-year vision to build Reliance as one of the world’s leading new energy and new materials company. The New Energy business is a multi-trillion dollar opportunity for India and the world…The first three Industrial Revolutions based on fossil fuels disturbed the natural Carbon Cycle on Planet Earth. The Fourth Industrial Revolution has the opportunity to repair and restore the Carbon cycle…Substantial progress has been made on photosynthetic biological pathways to convert emissions into high value proteins, nutraceuticals, advanced materials and fuels…Reliance is committed to embracing new technologies to convert CO2 into useful products and chemicals.Transforming our energy business to tackle a big challenge before India and the World is our new growth opportunity…”
অবশ্য একা আম্বানি নন এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর তালিকায় রয়েছে গ্লোবাল থার্মোস্ট্যাট, প্রমিথিউস , ক্লাইমওয়ার্কস, শেভরন এর মতো গোটা বিশ্বের অজস্র প্রথমসারির সংস্থা যার পুরোভাগে আছেন মার্কিন ধনকুবের বিল গেটস | যিনি ‘কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং ‘ নামে একটি নিজস্ব সংস্থা তৈরি করে ইতিমধ্যেই প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বিনিয়োগ করে বসে আছেন | কিন্তু কেন এই তথাকথিত New Energy business এ এতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ? তা বুঝতে হলে আমাদের আজকের সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটটিকে সঠিক ভাবে বুঝতে হবে |
২০০৮- ০৯ থেকে চলতে থাকা ,স্থায়ী এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট সাম্প্রতিক অতীতে যে স্তরে এসে পৌঁছেছে তাতে পুঁজিবাদী শিবিরের বড় একটি অংশই মনে করছে তথাকথিত গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে থেকে এই সংকটকে মোকাবিলা করার দিন কার্যত শেষ | এই পরিস্থিতিই বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির উত্থানের বস্তুগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে | যার মূল উদ্দেশ্য জল, জঙ্গল, জমি, মাটির তলার প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমান পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা | যে উদ্দেশ্যে উন্নয়নের নামে আমাজনের অরণ্য নিধন বা EIA আইনের সংশোধনী এনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বনভূমি উজাড় করে প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনের নীলনকশা, এসবকিছুই চলছে| এপর্যন্ত আমরা প্রায় সকলেই জানি|
কেন কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং?
যে বিষয়টি তেমন ভাবে আলোচিত হয় নি বা গুরুত্ব পায় নি তা হলো ক্রমবর্ধমান পরিবেশ সংকট, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মুখে লুন্ঠন কর্মসূচিগুলোর লাগাতার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী শিবিরের অন্য একটি অংশ বহুদিন ধরেই মনে করছে শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে আর দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না | ফলে তারা মূলত পরমাণু বিদ্যুৎ এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্পের অনুসন্ধান করছিলো | বলাবাহুল্য পরমাণু বিদ্যুৎ তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে | কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কিছুটা সরে আসার ফলস্বরূপ বিগত দু দশকে শক্তি উৎপাদন অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ হয়েছে | অর্থাৎ কিছু পরিমান শক্তি উৎপাদনের জন্য যে পরিমান শক্তি ব্যয় করতে হয় তার পরিমান বেড়েছে বহুগুন | ফলাফল সুলভ ও সস্তা শক্তি উৎপাদনের যুগের পরিসমাপ্তি | বিনিয়োগের ক্ষেত্রের অভাবে জমে থাকা পুঁজির পাহাড় আর অতি উৎপাদন জনিত সঙ্কটের পাশাপাশি এটিও আজকের অর্থনৈতিক সংকটের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ন কারণ |
এর নিরিখেই পুঁজিবাদ বুঝে নিয়েছে পরমাণু বিদ্যুৎ হোক বা অন্যান্য অপ্রচলিত শক্তি উৎস, কোনোটাই জীবাশ্ম জ্বালানির অনুপস্থিতিতে তার বিকল্প হিসেবে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখতে পারবে না | তাই অপ্রচলিত শক্তির পাশাপাশি জোর দেওয়া হচ্ছে এমন প্রযুক্তির ওপর যাকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত রেখেও পরিবেশ সমস্যার আপাত সমাধান হিসেবে দেখানো যেতে পারে | জৈবপ্রযুক্তির গবেষণা পুঁজির হাতে তুলে দিয়েছে তেমনই এক প্রযুক্তি -কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং | দাবী করা হচ্ছে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে নাকি আর নতুন করে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের প্রয়োজনই পড়বে না | বায়ুমণ্ডলের কার্বনডাইঅক্সাইড থেকে জ্বালানি তৈরি হবে আবার জ্বালানি পুড়লে কার্বনডাইঅক্সাইড হয়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাবে | গড়ে উঠবে এক কৃত্রিম কার্বন চক্র | এভাবেই নাকি বর্তমান পরিবেশ সংকটের সমাধান করা সম্ভব হবে |
কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং এর পিছনে আসল গল্প:
বলা বাহুল্য এই দাবী একই সাথে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর | বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি উপাদান ,প্রতিটি চক্র পরস্পরের সাথে এমন গভীর আন্তঃসম্পর্কে অভিলিপ্ত হয়ে আছে যে এই উৎপাদন কাঠামো বজায় রেখে কোনোভাবেই কোনো একটি চক্র কে স্বতন্ত্রভাবে “repair and restore ” (মুকেশ আম্বানির ভাষায়) করা সম্ভব নয় এই মূলগত সত্যটিকেই এরা গুলিয়ে দিতে চাইছে | পরিবেশ সংকটের সামগ্রিক, আন্তঃসম্পর্ক যুক্ত চেহারাটিকে আড়াল করে এমনভাবে সুকৌশলে প্রচার চালানো হচ্ছে যাতে প্রতিপন্ন হয় কার্বন এমিশনই পরিবেশ সংকটের একমাত্র রূপ যার সমাধান হয়ে গেলেই আর পরিবেশ নিয়ে চিন্তার কিছু থাকবে না | উদ্দেশ্য ‘পরিবেশবান্ধব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের’ সোনার পাথরবাটি সামনে রেখে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, এই প্রযুক্তির ব্যবহার অনিবার্য প্রতিপন্ন করে এক ঢিলে দুই পাখি মারা | একদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও কার্বন এমিশন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এই মিথ্যা প্রচার কে অজুহাত হিসেবে সামনে রেখে তথাকথিত উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমান অরণ্য নিধনকে জনমানসে বৈধতা দেওয়া | অন্যদিকে এই ধরণের প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে আরও বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরী করা | এই দুটো বিষয়ই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য আজ একান্তভাবে প্রয়োজনীয় |
তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কে রক্ষা করার স্বার্থে পরিবেশবান্ধব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভুয়ো অবাস্তব দাবীকে সামনে রেখে ওরা আজ পৃথিবীর বুকে সবুজের প্রয়োজনীয়তাকেই কার্যতঃ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে | আসলে আজকের অর্থনৈতিক সঙ্কটের নিরিখে পরিবেশ সঙ্কটকেও পুঁজি দেখছে তাদের বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা হিসেবেই। এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে না পারলে মানব সভ্যতা তথা প্রাণ প্রতিবেশ এর ওপর এই নেমে আসা এই অভূতপূর্ব আক্রমণকে কিন্তু আমরা কোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে পারবো না |