বিজন পাল
শিল্পভিত্তিক সমাজের বুনিয়াদ ছিল বৃহৎ শিল্প উৎপাদন। এখানে বৃহৎ শিল্পগুলিতে উৎপাদন হতো সহযোগিতামূলক। পাশাপাশি সমাজটাও চলত সহযোগিতামূলকভাবে। তখন আজকের মতো এতো বড় বাজার ছিল না। এখানে উৎপাদনশীলতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ক্রয় ক্ষমতা বাড়েনি। যদিও উৎপাদনশীলতা বাড়লেই ক্রয় ক্ষমতা বাড়েনা। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যতটা উৎপাদন হয় ততোটা যদি শ্রমজীবি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা থাকতো তাহলে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন হতোনা। তাই মধ্যবিত্তের একটা ক্ষুদ্র অংশের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো হয়ে ছিল যারা পুঁজিবাদের ধ্বজাকে বহন করে নিয়ে চলে। বৃহৎ শিল্পে শ্রমিকরা বড় বড় শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত থাকার ফলে একটা সহযোগিতামূলক সম্পর্ক সমাজের মধ্যে গড়ে উঠতো। তার প্রভাব সমাজ ও সংস্কৃতিতে পড়তো। পুঁজিবাদী উৎপাদন সামাজিকভাবে হয় কিন্তু বন্টন সামাজিকভাবে না হয়ে ভোগ দখল হয় ব্যক্তিগত ভাবে। শ্রমজীবী মানুষ উৎপাদন করে সামাজিকভাবে আবার তাকেই বাজারে এসে ক্রেতা হিসেবে ক্রয় করতে হয়। এই ক্রয় করার ব্যক্তিগত রূপটাকেই পুঁজিবাদ ব্যবহার করে। শিল্প পুঁজিবাদ সামাজিকভাবে উৎপাদন হলেও ভোগ সামাজিকভাবে হয়নি। বড় বড় শ্রমিক সংগঠনের আদর্শে সামাজিকভাবে উৎপাদন করতে গিয়ে তাদের মধ্যে একটা সহযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক আদর্শের জন্ম হয়েছিল। শ্রমিকদের যে আন্তর্জাতিক আদর্শ ছিল সেটা জাতীয় হয়ে যাবার ফলে তাদের আদর্শকে আর বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেল না।
আরেক দিকে এই শিল্পভিত্তিক সমাজে বৃহৎ শিল্পে এক ছাদের তলায় সহযোগিতামূলকভাবে উৎপাদন হলেও উৎপাদিত বস্তু পণ্য রূপ ধারণ করত সবার শেষে। উৎপাদনশীলতা যতো বাড়তে থেকেছে ততোই অতি উৎপাদনের সংকটে পড়তে হয়েছে। সঞ্চয়ন যতই বেড়েছে সংকটও ততোই বাড়তে থেকেছে। ৯০ দশকে এখান থেকে বার হবার জন্য বৃহৎ শিল্পকে টুকরো টুকরো করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উৎপাদনকে যেমন টুকরো টুকরো করে অন্তর্জাল পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া হল তেমনি মানুষকেও টুকরো করে ব্যক্তিমানুষে পরিনত করে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতা হিসাবে শামিল করলো। এখানে বাজারটাই বড় হয়ে দেখা দিল।
এর পাশাপাশি যেখানে যে উৎপাদনে খরচ কম সেখানে সেই উৎপাদন স্থানান্তরিত করা হয়েছে। প্রতিটি টুকরো উৎপাদনে পণ্য রূপের সাথে সাথে পুঁজির লগ্নির জায়গা হয়েছে। একই ছাদের তলায় বৃহৎ উৎপাদনে বিদ্যুতের খরচ যা হতো টুকরো টুকরো হওয়াতে তা অনেক গুন বেড়ে গেল। এবং পরিবহণ খরচ ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও বাড়তে থাকলো।
শিল্পভিত্তিক সমাজে বৃহৎ শিল্পকে টুকরো করার ফলে নতুন এক অর্থ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এই ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি বাজার ভিত্তিক সমাজ। এই সমাজে বাজারই মুখ্য ভূমিকায় থাকে এবং বাজারই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর আধিপত্য সমাজ জীবনে প্রভাবিত হয়। বাজার ভিত্তিক সমাজে মানুষ নিজেকে বাজারেই খুঁজতে থাকে। এক শ্রেণীর মধ্যবিত্তের হাতে অর্থের প্রবাহ ঘটিয়ে তাদের কৃত্রিম চাহিদাকে বাড়ানো হলো। সমাজের অর্থবান ও অর্থহীন সমস্ত শ্রেণিকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এদিকে পণ্য বাজারে ছেয়ে ফেলেছে। এর পাশাপাশি মানুষ নিজেকে পণ্যরূপে বাজারের উপযোগী করে নিজের গুনগত মানকে বাড়াতে ব্যস্ত। এমন এক সংস্কৃতি তৈরি হলো – যা শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো, প্রস্তুত কর বাজারের মতো করে যাতে সহজেই নিজের কৃতিত্বে অর্থ উপার্জন করা যায়। অর্থই দিতে পারে কৃত্রিম ভোগের সুখ। যতো অর্থ ততো সুখ। সহযোগিতামূলক সমাজ রূপান্তরিত হলো ব্যক্তি কেন্দ্রিক এক প্রতিযোগিতামূলক সমাজে। শিল্পভিত্তিক সমাজে যেখানে মানুষ একসঙ্গে থাকার একটা আনন্দ অনুভব করতো সেখান বাজারভিত্তিক সমাজ সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই সংস্কৃতি মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজে খাও, নিজে পরো, নিজে মাখো অন্যের জন্য ভাবার প্রয়োজন নেই। অন্যের কথা ভাবতে গেলে কৃত্রিম সুখ ভোগের থেকে বঞ্চিত হতে হবে। তোমার নিজের যা কিছু গুনগত প্রতিভা আছে তাকে বিক্রি করে তোমার কৃত্রিম চাহিদাকে মেটাও। তাদের সন্তানদেরও প্রস্তুত করতে হবে বাজারের চাহিদা মতো। পঠন-পাঠন সেই ভাবেই চলবে, যাতে তাদের গুনগত মানকে বাজারের উপযোগী করে তোলা যায়।
এখানে বাজারই প্রধান ভূমিকায় থাকছে। যেমন উৎপাদনকে টুকরো করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হল আবার বাজারকে ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে সবার সাথে যুক্ত করা হল। আজ মানুষকে বাজারে যাবার দরকার নেই, বাড়িতে বসেই সমস্ত কিছু সংগ্রহ করা যায়। এই প্রতিযোগিতামূলক বাজার অনিশ্চয়তা তৈরি করে। প্রতিনিয়ত নিজেকে যোগ্য করে উপস্থিত করতে না পারলে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাবার ভয় থাকে। আর আসে অবসাদ।