প্রীতিলতা বিশ্বাস
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ উপনিবেশের অবসান হয়। বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, জাতিসংঘ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের মাধ্যমে পৃথিবীতে একটি আপাত স্বাধীন সমতার বাতাবরণ তৈরি করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির আড়ালে থেকে কাজ করতে শুরু করে। সভ্যতার চাকা ঘোরার জন্য প্রধান প্রয়োজন ছিল জ্বালানি তেলের। তাই মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের উপর আধিপত্য কায়েম করা ছিল আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রতিপক্ষ ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ রাশিয়ার রাজনৈতিক আধিপত্য, কারণ রাশিয়া নিজেও খনিজ তেলে সমৃদ্ধ। আধিপত্য কায়েম করার হাতিয়ার হিসাবে আমেরিকার সামরিক পোস্ট স্বরূপ দখলদার ইজরায়েল রাষ্ট্রকে তৈরি করা হয় প্যালেস্টাইনের জমিতে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ কোনদিন থামেনি। একের পর এক উগ্রপন্থী সংগঠনের সংখ্যা বেড়েছে।
সত্তরের দশকে আমেরিকা ব্রেটন-উডস সিস্টেম থেকে বেরিয়ে এসে সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সঙ্গে ডলারকে জুড়ে দেয়। ওপেকভুক্ত দেশগুলোও মানতে বাধ্য হয় ‘নো ডলার নো ওয়েল’ নীতি। সাদ্দাম হুসেন ইউরোপে ইউরোতে তেল বিক্রির চেষ্টা করেছিল। এরপর ইরাকের মানুষের কী অবস্থা হয়েছিল, তা আমাদের সকলের জানা। ক্রুড ওয়েলের মতো হেরোইন সারা পৃথিবীতে ডলারে বিক্রি হয়। আর কিছুদিন আগে পর্যন্ত এর সর্বোচ্চ উৎপাদক ছিল আফগানিস্থান। আফগানিস্থানে আমেরিকার সৈন্য কতদিন ছিল সেটাও আমাদের জানা।
খনিজ তেলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও অরণ্য নিধন প্রকৃতির গড় উষ্ণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া মজুদ ভান্ডারের সীমাবদ্ধতা আছে। তাই আগামী দিনের জন্য বিকল্প শক্তির সন্ধান করতেই হবে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন প্রযুক্তির উন্নতিসাধন। এই দুইয়ের জন্য প্রয়োজন বিরল খনিজ পদার্থ। মোট ১৭টি মৌল এই বিরল খনিজ গোত্রে পড়ে। চীনের কোন খনিজ তেলের মজুদ নেই। ইরানের সঙ্গে আমেরিকার বিরোধকে কাজে লাগিয়ে চীন মুদ্রার লেনদেন ছাড়া বার্টার সিস্টেমে ইরানের তেলের প্রধান খরিদ্দার। ১৯৮৭ সালেই লি শিয়াও বলেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের আছে খনিজ তেল আর আমাদের আছে বিরল খনিজ। সত্যিই তাই। চীন পৃথিবীতে বিরল খনিজের মজুদ ভান্ডার এবং উৎপাদন সব দিক দিয়েই শীর্ষ স্থানে আছে। বিরল খনিজ নিষ্কাশনের জ্ঞান এবং প্রযুক্তি দুটিতেই সে এগিয়ে আছে।
বিরল খনিজের ব্যবহার
মহাকাশ গবেষণা থেক শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম এমনকি ফ্রিজের গায়ে লাগানো চুম্বকে এবং মোটরে পর্যন্ত বিরল খনিজের ব্যবহার হয়। ব্যাটারি চালিত যানবাহনের প্রধান উপাদান বিরল খনিজ। সোলার প্যানেল যা প্রকৃতি বান্ধব শক্তির উৎস হিসাবে পরিচিত, আমেরিকার সর্বাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরির জন্য নয়শ পাউন্ডের উপর বিরল খনিজ প্রয়োজন, মোবাইল-টিভি-ল্যাপটপের স্ক্রীন, সুপার কম্পিউটার হিসাবে পরিচিত কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য বিরল খনিজ অত্যন্ত জরুরি। এমআরআই মেশিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, এমনিকি মানবদেহে ট্যাটু আঁকার জন্যও প্রয়োজন হয় বিরল খনিজের। এরপরেও বাকি থাকল আরও অনেক কিছুর উল্লেখ।
বিরল খনিজের মজুদ
ব্যাবহারের তালিকা থেকে এটা পরিষ্কার যে আগামীদিনে বিরল খনিজের চাহিদা আরও বাড়বে এবং বিরল খনিজের দখলদারি নিয়ে আগামী বিশ্বের মাথাব্যথার শেষ থাকবে না। তাই দেখে নেওয়া প্রয়োজন, পৃথিবীর কোন্ দেশে বিরল খনিজের মজুদ কতটা। শীর্ষে থাকা চীনের মোট মজুদের পরিমান ৪ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২ সালের হিসাব অনুসারে বার্ষিক উৎপাদন ২ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। দ্বিতীয় স্থানে আছে ব্রাজিল, ২ কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৬ সাল থেকে বছরে ৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা। ৬৯ লাখ মেট্রিক টন মজুদ নিয়ে ভারত আছে তৃতীয় স্থানে। চতুর্থ স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়া খুব একটা পিছিয়ে নেয়। তার মজুদের পরিমাণ ৫৭ লাখ মেট্রিক টন। যার মধ্যে ২০২৪ সালে উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার মেট্রিক টন। রাশিয়া আর ভিয়েতনামের নিজেদের মজুদ ঘোষণা নিয়ে বেশ রহস্যময় আচরণ করে। রাশিয়া প্রথমে তার মজুদ ১ কোটি মেট্রিক টন বলে ঘোষণা করে। পরে বলে ওটা ভুল হয়েছে, আমাদের মজুদ ৩৮ লাখ মেট্রিক টন। ভিয়েতনামে সরকারি দফতর থেকে ঘোষণা করা হয় তাদের মজুদ ২ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন। এরপরে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বরখাস্ত করে ঘোষণা করা হয় তাদের মজুদ মাত্র ৩৮ লাখ মেট্রিক টন। পরে ওই অফিসাররা গ্রেফতারও হয়ে যান। তাহলে বোঝা যাচ্ছে বিরল খনিজের মজুদ নিয়ে এক ধরণের লুকোছাপার বিষয় আছে আন্তর্জাতিক মহলে। এবার আসি আমেরিকার প্রসঙ্গে। মজুদের দিক থেকে তার অবস্থান সপ্তম। ১৯ লাখ মেট্রিক টন। তবে আমেরিকা প্রতি বছর উৎপাদন করে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ নিষ্কাশনের জ্ঞান ও প্রযুক্তি দুটিই তার হাতে আছে।
বিরল খনিজের মজুদ ভান্ডার হিসাবে হিমালয়ের একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা আছে। তিব্বত থেকে শুরু করে মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত প্রায় ১০০০ কিমি দীর্ঘ অঞ্চলে হালকা রঙের গ্রানাইট পাথরের নীচে রয়েছে নিওবিয়ম, ট্যানটেনাম, লিথিয়াম, যা গ্রীন এনার্জি-প্রযুক্তির জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। হিমালয়ের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই তৈরি হয়েছে এই বিরল খনিজের মজুদ। ভারতীয় প্লেট আর ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের ঘর্ষণের ফলেই হিমালয়ের পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন বিরল খনিজের এক বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এই দীর্ঘ হাজার কিমি জুড়ই রয়েছে ভারত ও চীনের সীমান্ত বিতর্ক। লাদাখে চীন অনেকটাই ভারতের দিকে এগিয়ে এসেছে, এবং ২০২০ সালের গালওয়ানের কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলিনি।
ইউরোপের অবস্থা
ইউরোপ বিরল খনিজের মজুদ ও তা নিষ্কাশনের জ্ঞান ও প্রযুক্তি সব দিক থেকেই পিছিয়ে আছে। রাশিয়াকে তারা কোনভাবেই ইউরোপের অংশ হিসাবে মনে করেনা। আবার ইউক্রেনের সম্ভাব্য মজুদ আমেরিকা কব্জা করতে চলেছে। গ্রীনল্যান্ডের বরফের নীচে অবশ্য ১৫ লাখ মেট্রিক টনের একটি মজুদ পাওয়া গেছে। ইউরোপের নর্ডিক দেশগুলির সঙ্গে গ্রীনল্যান্ডের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুর মিল আছে। সেই হিসাবে আশা করা যেতে পারে, ভবিষ্যতে ইউরোপেও বিরল খনিজের একটা মজুদ ভান্ডার তৈরি হতে পারে। ইতিমধ্যে ১০ লাখ মেট্রিক টনের সন্ধান পাওয়া গেছে সুইডেনে। তবে নিশ্চিতরূপেই ইউরোপ এখন পুরোপুরি আমদানি নির্ভর এবং ভবিষ্যতেও কিছুটা পিছিয়েই থাকার সম্ভাবনা।
নব্বই শতাংশের উপর চীন কর্তৃত্ব করবে আর সপ্তম অবস্থানে থেকে আমেরিকা যে আঙুল চুষবে না, সেটা তারা জেলেনেস্কিকে দিয়ে ধরে বেঁধে এবং নানান চাপ দিয়ে চুক্তি সই করিয়ে নেবার মরীয়া প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে ইউক্রেনের সম্ভাব্য খনি অঞ্চলের অনেকটা রাশিয়া অধিকার করে নিয়েছে।
মিয়ানমার
আমরা সবাই জানি বর্তমানে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত। মিয়ানমারে বিরল খনিজের কোন সরকারি ঘোষণা নেই। অথচ মিয়ানমার বিরল খনিজের উৎপাদনে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে আছে। রয়টার বলছে, মিয়ানমার চীনে বিরল খনিজ রপ্তানি করে বছরে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। চীন নিজে উৎপাদনে শীর্ষ স্থানে থাকার পরও কেন মিয়ানমার থেকে আমদানি করে? সেকথায় পরে আসছি। মিয়ানমারে যে শুধু বিরল খনিজ পাওয়া যায় তা নয়, এখানে সোনা সহ আরও অনেক খনিজই পাওয়া যায়। মিয়ানমার এখন আফিম চাষ এবং হেরোইন উৎপাদনে পৃথিবীতে শীর্ষ স্থানে আছে। এখানে ২৫টি উগ্রপন্থী দল সক্রিয় অবস্থায় আছে। ৩০০টির বেশি খনি আছে মাত্র ৭০০-৮০০ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে। এই খনি অঞ্চল ও আফিম চাষের উপর কব্জা করে আছে এক একটি সশস্ত্র বাহিনী, যার কিছু সংখ্যক আছে সামরিক জুন্টা বাহিনীর ছাতার তলায়, কিছু আছে ইউএনএ বা ন্যাশানাল ইউনিটি গভার্নমেন্টের ছাতার তলায়। রাখাইন অঞ্চলে বিরল খনিজের ভারী আকারে মজুদ থাকার সম্ভাবনা আছে, যে রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের মেরে তাড়ানো হয়েছে। চীন, আমেরিকা তো বটেই, রাশিয়া ও ভারতও এখানে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত। সম্পদের আধিক্যই আজ মিয়ানমারের পরিবেশ ও মানুষের বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে।
ভারতের বিরল খনিজ
ভারত বিরল খনিজের মজুদের দিক থেকে পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে আছে। এই বিরল খনিজের মজুদ মূলতঃ রয়েছে উপকূল অঞ্চলে। কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো উপকূলীয় অঞ্চলে মোনাজাইট নামক ফসফেট খনিজ পাওয়া যায়। যা থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম এবং পৃথিবীর বিরল উপাদান ধারন করে। জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, জম্মুর রিয়াসি জেলায় সালাল-হাইমানা এলাকায় লিথিয়ামের মজুদ থাকতে পারে।
দৌড়ে এগিয়ে ব্রিক্স
২০০৯ সালে ব্রিক্স প্রথম গঠিত হয়। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা এর প্রাথমিক সদস্য হলেও মধ্যপ্রাচ্য এবং লাতিন আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশও এর সদস্য হতে শুরু করেছে। প্রাথমিক সদস্যদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মজুদের বিষয়ে আগে বলা হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার মজুদ ৮ লক্ষ মেট্রিক টন। এবারে তাহলে সরল যোগের নিয়মেই বোঝা যাচ্ছে যে, ব্রিক্স গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি পৃথিবীর মোট বিরল খনিজের ৯০ শতাংশের মালিক। আর সেখানে চীন রয়েছে শীর্ষ স্থানে। যেহেতু এই খনিজ নিষ্কাশন সংক্রান্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে চীন সেই ৮০র দশক থেকে গবেষণা করছে। তাই এখানে টেক্কা দেবার মতো কেউ তার ধারে কাছে নেই। এই জ্ঞান সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও চীন ভীষণ সতর্ক। তাই বিরল খনিজ রপ্তানি সংক্রান্ত নানা বিষয়ে চাপানো আছে অনেক নিষেধাজ্ঞা।
আমেরিকার মাথাব্যথা ও সক্রিয়তা
নব্বই শতাংশের উপর চীন কর্তৃত্ব করবে আর সপ্তম অবস্থানে থেকে আমেরিকা যে আঙুল চুষবে না, সেটা তারা জেলেনেস্কিকে দিয়ে ধরে বেঁধে এবং নানান চাপ দিয়ে চুক্তি সই করিয়ে নেবার মরীয়া প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে ইউক্রেনের সম্ভাব্য খনি অঞ্চলের অনেকটা রাশিয়া অধিকার করে নিয়েছে। ইতিমধ্যেই আমেরিকা গ্রীনল্যান্ড কিনে নেবার কথা বলেছে এবং সেখানে নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। কানাডা, যার মজুদ ৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন, তাকে ট্রাম্প আমেরিকার সঙ্গে জুড়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে। এছাড়াও ২০০৭ সালেই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের প্রভাবকে আটকানোর জন্য আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে একটি জোট তৈরি করে। এটি মূলতঃ সামরিক জোট। লক্ষণীয় বিষয় হল বিরল খনিজের মজুদের নিরিখে বিশ্বে তৃতীয় ভারত ও চতুর্থ অস্ট্রেলিয়া এই জোটের অংশীদার। সেই হিসাবে আমেরিকা প্রকারন্তরে বিরল খনিজের একটি বড় অংশের উপরেই খবরদারি করার সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
বিরল খনিজ ও পরিবেশ
এই প্রসঙ্গটি বোঝার জন্য মিয়ানমারকেই বেছে নেওয়া ভালো। চীন একাই মিয়ানমার থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আমদানি করে। চীন নিজে মজুদের শীর্ষে থাকার পরও কেন আমদানি করে? কারণ চীনের পরিবেশ। বিরল খনিজের মাইনিং সবই হচ্ছে ওপেন পিট মাইনিং। ওপেন পিট মাইনিংয়ের জন্য অঞ্চল বসতিশূণ্য করতে হবে। তারপরেও এর দূষণের প্রভাব পড়বে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের উপর। পাহাড় অঞ্চলে মাইনিং হলে ধ্বসের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ভূগর্ভস্থ জলকে অম্লীয় (acidic)করার সম্ভাবনা থাকে। নিজের দেশের দূষণ থেকে মুক্তি পেতে চীন মিয়ানমার থেকে বিরল খনিজ আমদানি করে। এখন আমদানির হিসাবটা সরকারি এবং বৈধ। কিন্তু চীন-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে উগ্রপন্থী দলগুলির অবৈধ খনিজ পাচারের লেনদেনও হয়। এই সুযোগটা নিতে পারে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের অস্থিরতাকে পুঁজি করে। কারণ উগ্রপন্থী দলগুলির অস্ত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য দেশের খনিজ বিক্রির অর্থই একমাত্র উৎস। চীন, রাশিয়া, আমেরিকা প্রত্যেকটি দেশ চাইবে নিজের নিজের দেশের পরিবেশকে বাঁচিয়ে বৈধ অবৈধ যেকোন ভাবেই হোক বিরল খনিজ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আমদানি করতে। সেক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তির বাতাবরণটি নষ্ট করা বিশেষ প্রয়োজন। ভারতের উপকূল ও মিয়ানমারে যদি বিরল খনিজ থাকতে পারে তাহলে একই ভূমিরূপের বাংলাদেশে কেন নয়? সেই হিসাবে বাংলাদেশেও বিরল খনিজ থাকার সম্বাবনা আছে। যদিও সরকারি স্তরে কোনো ঘোষণা নেই। ভারতের ক্ষেত্রে যদি আমরা উপকূল অঞ্চলে থাকা বিরল খনিজ তুলতে যায়, তাহলে জল ও বায়ু দূষণের সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে হবে বিপুল সংখ্যক মৎসজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার কী হবে? এইখানেই হিমালয় জুড়ে যে বিরল খনিজের উপস্থিতি আছে সেই প্রসঙ্গ চলে আসবে। সীমান্ত নিয়ে বিতর্কের যদি রাজনৈতিক সমাধান হয়েও যায় তাহলেও কি হিমালয়ের খনিজ উত্তোলন ভারতের ভৌগলিক গঠনকে আদৌ অক্ষুন্ন রাখতে পারবে? আমরা বাস করি হিমালয়ের ঢালের দিকে, যার জন্য স্বাভাবিক ভাবে নদী প্রবাহ আমাদের উর্বর সমভূমি দান করেছে। কিন্তু ওই একই কারনে ভারতের দিকে হিমালয় ধ্বস প্রবণ। আর হিমালয় ও তার বনভূমি নষ্ট হয়ে গেলে ভারতের উত্তরাঞ্চল শীতল মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই এই হিমালয় প্রসঙ্গে ভারতের একই সঙ্গে ব্রিক্স ও কোয়াডের সদস্য থাকাটা খুবই স্ট্র্যাটিজিক।
আগামী পৃথিবীর জ্বালানি শক্তি হতে চলেছে বিরল-খনিজ। শুধু জ্বালানি নয়, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়নেরও প্রাণভোমরা এই বিরল খনিজ। যা সম্ভাব্য ভারী মাত্রায় সঞ্চিত রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। এই সঞ্চয় কি ভারতীয় উপমহাদেশের পরিবেশ ও মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনতে চলেছে? বিগত ৭৫ বছরে আমরা দেখেছি জ্বালানির মজুদ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য কখনও শান্ত থাকতে পারেনি। এখানেও সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের ছাত্র-যুব বিদ্রোহ ও তার পরবর্তী ঘটনা, পাকিস্তানের বালুচ উপজাতির বিদ্রোহীদের ট্রেন হাইজ্যাক, এবং ভারতের পহেলগাঁও হত্যাকান্ড—সবই পরস্পরকে দোষারোপ করে পরস্পরের বিরুদ্ধে আস্তিন গোটানোর অনুঘটক হিসাবে কাজ করছে। এবং দেশের জনগণ সব সমস্যা ভুলে শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভাজনকে স্থায়ী শত্রুতাররূপ দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠছে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে যে দেশের সম্পদ লুটের জন্য আভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য আদর্শ অবস্থা।
পরিশেষে
লড়াইটা শুধু পৃথিবীর মাটিতে থেমে নেয়। চীন ও রাশিয়া ২০২৭ এর মধ্যে যৌথ মহাকাশ স্টেশন তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আমেরিকাও একটি সংস্থা খুলেছে যেখানে বিভিন্ন কোম্পানি এবং দেশ অংশগ্রহণ করতে পারবে। বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহের কাছে একটি গ্রহানুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে বিপুল পরিমান খনিজের সন্ধান মিলেছে। হয়তো দেখা যাবে কিছুদিনবাদে ভারতও এই দৌড়ে সামিল হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দায়িত্ব পুরোপুরি ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মহাকাশে বিরল খনিজের সন্ধানে গবেষণা চলবে। আর আমরা খেয়ে, না খেয়ে হিন্দু-মুসলমান তর্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকব!