সুপর্ণা দে
চারিদিকে দেওয়াল লিখন ,ঝলমলে পোষ্টার –নারী শক্তির বিকাশ “বাংলা নিজের মেয়েকে চায়”। পিতৃতন্ত্রের শাসনে লিঙ্গ বৈষম্যের জগতে এ যেন এক বসন্ত বিকেলের রঙিন ছবি। বর্তমানে ভারতবর্ষের একটি মাত্র রাজ্যে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী আর ঝলমলে বিজ্ঞাপনে , নারীশক্তির বন্দণা । এ রকম সময়ে একজন সংস্কৃতিমনস্ক কেন্দ্রিয়মন্ত্রী তাঁর সংস্কৃতিক চেতনার হাত ধরে বলেছেন “মেয়েরা পরের ধন,বিদায় করে দেবো “- দেশের রুচিশীল জনগনের কাছে প্রশ্ন কেন এই কুরুচিকর রাজনৈতিক খেলা । একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে যদি এরকম কুরূচিসম্পন্ন মন্তব্য শুনতে হয় তাহলে এদেশের সাধারণ মেয়েদের সম্মান কোথায় ?
“বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” শ্লোগানধারীদের এ রকম কুরুচিসম্পন্ন মন্তব্যের পেছনে রয়েছে ভোটের যুদ্ধে গদি দখলের লড়াইয়ের নোংরা রাজনৈতিক খেলা । গদি দখলের যুদ্ধে মিডিয়াকে হাতের মুঠোয় এনে নারীকে দাঁড় করানো হয়েছে মহাভারতের যুদ্ধের মতো শিখন্ডীর জায়গায় । নারীত্বকে ঢাল করে যুদ্ধের আসর সাজানো হয়েছে , কতখানি অপমান , কতখানি লজ্জ্বার । রাজনৈতিক মতাদর্শকে সরিয়ে রেখে ভাবুনতো একজন নারী যখন রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরুষের সাথে লড়াই করছে তখন আধুনিক সংস্কারমুক্ত ধ্যানধারণাকে বিসর্জন দিয়ে বলা হচ্ছে —মেয়েরা পরের সম্পদ, বিদায় করে দেব । মেয়েদের সম্পত্তির সাথে তুলনা করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে মহামান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মহাশয়।
ভারত একটি বহুত্ববাদী দেশ । ভারতের বৃহত্তর সমাজে যে সব বিশ্বাস ও চিন্তন বদ্ধমূল হয়ে আছে তার মধ্যে মনুস্মৃতির ধারাবাহিকতা ভীষণভাবে বিদ্যমান । হিন্দুত্ববাদের অন্যতম ধারকগন নারীকে পণ্য ও সম্পত্তির বেশি কিছু ভাবতেই পারেন না। তাদের পুরুষসত্ত্বা নারীকে চিরকাল দ্বিতীয় সারিতে ঠেলে দেয় , লাঞ্ছিত –অপমানিত করে । পিতৃতন্ত্র নারীকে রাখতে চায় পুরুষের অধীনে , শিক্ষা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে । একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই ভয়ঙ্কর লিঙ্গ বৈষম্য মনু্স্মৃতির ধারাবাহিকতাকে শিরোধার্য করে আজও আমাদের সমাজে টিকে আছে। পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা সেই সম্পত্তির মিথ্যা সম্মানদান ও নোংরা রাজনৈতিক খেলায় প্রতিনিয়ত সম্মানের চেয়ে অসম্মানই করে চলেছেন –মুখোশের আড়ালে হিংস্র মুখগুলি বরবার জেগে ওঠে। উগ্র ব্রাহ্মণত্ববাদ ও নারীবিদ্বেষী সমাজ প্রতিনিয়ত নারীকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে । একটা বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে আছে কেন্দ্রিয় মন্ত্রীমহাশয়ের চিন্তনে –যে নারী দূ্র্বল , নারী পণ্য ।
লিঙ্গবৈষম্যের দেশে ,নারী সম্বন্ধে এরকম কুৎসিত মন্তব্যকারীরা সিংঘু টিকরি সীমান্তে মহিলাদের হাতে যখন স্টিয়ারিংয়ের ছবি দেখে তখন , গেল! গেল! বলে গর্জে ওঠে । যে মাটিতে মেয়েদের জন্মাতে পারাটুকুকে নিশ্চিত করতে আইন করতে হয় সেই মাটিতে খোলা আকাশের নীচে কৃষকের পরিচয়ে অগুনতিক মহিলার দাপিয়ে বেড়ানোটাকে মেনে নিতে পারেনি। অন্তঃসারশূণ্য দাম্ভিক রাষ্ট্র জানতে চায়- মহিলাদের লড়াইয়ের ময়দানে রাখা হয়েছে।

কেন ? নিজেদের ভয় পাওয়া চেহারাটা ঢাকতে পিতৃকূল বিনয়ের সাথে জানতে চায় – নারীরা ওখানে কেন ? প্রতি নিয়ত যাদের যৌন নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়, যাদের দিকে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেওয়া হয়, যাদের দুবেলা মার খেতে খেতে বাঁচতে হয়, সমাজের দুই তৃতীয়াংশ কাজ করেও এক তৃতীয়াংশ অধিকার যাদের প্রতিষ্ঠা পায়নি এ যাবৎকাল পর্যন্ত–তারা সবসময় অনুগ্রহের পাত্র ,দূ্র্বল ,পণ্য। ট্রাক্টর চালিয়ে লিঙ্গবিভেদকে চুলোয় পাঠিয়ে মেয়েরা যখন চাষীর পরিচয়ে , জমির অধিকারে গর্জে ওঠে, তখন মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মনে প্রশ্ন জগে- নারীরা ওখানে কেন ? প্রতিদিনের এই ঘটনাগুলি খালি চোখে বিশ্লেষণ না করে একটু মানবিক হোন ।
আসলে আপনাদের চিন্তার গভীরে , মুখোশের আড়ালে , মননে – ঘুনপোকার মতো বাসা বেঁধে আছে – নারী পণ্য, নারী সম্পত্তি, নারী commodity । পিতৃতন্ত্র নানাভাবে মেয়েদের second sex করে রেখেছে। আসলকথা হল বর্তমানে সংসদীয় রাজনীতিতে নারী প্রচারের মাধ্যম I ’বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও ‘ শ্লোগানধারীরা মেয়েদের যদি এতটা সম্মানীয় স্থানে রাখে তাহলে কৃষক আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার জন্য পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করা হল কেন ? আর কতদিন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার দলিলকে শিরোধার্য করে আমরা নিজেদের অপমানিত করব । আর কতদিন কোন রায় ,কোন আইনকে প্রমান করতে হবে নারীরা কারোর সম্পত্তি নয় । আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের আড়ালে লুকিয়ে আছে লিঙ্গ বৈষম্যের চোরাবালি , নারীবিদ্বেষ, পিতৃতন্ত্রের অলিখিত কদর্য দলিল ।

ভোটের বাজারে ঝলমলে বিজ্ঞাপন আছে , তীর্যক মন্তব্য আছে – নিরাপত্তা নেই। নারীবিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্য ,পুরুষের লালসা, পিতৃতন্ত্রের সুচতুর উৎকন্ঠায় মানুষ হিসাবে নারীর স্বীকৃতি প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের ১৯ বছরের তরুনী কেন লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হয়েছিল । কেন সরকার দলিত নির্যাতিতার পাশে না থেকে উচচ বর্ণের নির্যাতনকারীদের সাহায্য করেছিল । যোগী প্রশাসন অত্যাচারীকে আড়াল করতে বলেছিল- প্রতিবাদকারীদের জীভ কেটে নেওয়া হবে , তাদের ওপর যৌন নির্যাতন করা হবে । এই যোগী সরকারই কিছুদিন আগে বাংলার মাটিতে এসে নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন , বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে নারীরা নিরাপদ নয়। ধর্ষণ ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া যাদের স্বভাবজাত তারাইতো মেয়েদের কে পণ্য- সম্পত্তি বলতে পারে। শুধুমাত্র মেয়েরা নয় , লিঙ্গবৈষম্যের এই ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলা দলিতবিরোধী, নিম্নবিত্ত শ্রেণী বিরোধী- যোগীরাজ্য তার প্রমাণ। উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণে অভিযুক্তকারীদের
(জামিনে ছাড়া পেয়ে) হাতে নির্যাতিতার বাবা খুন হয় ।গতকাল ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে মেডিকেল পরীক্ষা করাতে চাওয়ার জন্য নির্যাতিতার বাবাকে ট্রাক ধাক্কা মারে,লোকটি মারা যায় । এখনই সময় মুখোশের আড়ালের মুখগুলিকে ভালো করে চিনে নেওয়ার।
লেখক পরিচিতি:
লোক সংস্কৃতির গবেষক, পরিবেশ কর্মী ও নাট্যকর্মী।
মেইল আই ডি: suparnadey2010@gmail.com






যথার্থ বক্তব্য। এই ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে।
লেখনীর ধার খুব। এই ধার প্রত্যেক নারীর মননে আঘাত করুক তারপর বেরিয়ে আসুক তাদেরও লেখনী কিংবা মুখ থেকে আর সজোরে আঘাত করুক সমস্ত মুখোশধারীদের।
লড়াইটা লিঙ্গভেদ ভুলে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নাহলে মানুষ বলে পরিচয় দেবে কীভাবে 🙏
ধন্যবাদ 🙏এখন ই আঘাত করতে হবে মুখোশধারীদের ।