অখন্ড ভারতে খণ্ডিত মানবতা

গোদি মিড়িয়া প্রশ্ন তোলেনি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর নজর এড়িয়ে পাক জঙ্গীরা ভারতে কীভাবে ঢুকল? যে কাশ্মীরে প্রতি দশ জনে একজন সেনা মোতায়েন করা আছে, সেই প্রতিরক্ষা পহালগাঁও-বৈসরণে সেদিন ছিল না কেন? তার বদলে নিশানা করা হয়েছে পাকিস্তানকে এবং ভারতে থাকা ১৭ শতাংশ মুসলিম জনগনকে।

যুদ্ধ

প্রীতিলতা বিশ্বাস

কাশ্মীরের পহেলগাঁওতে বাইশে এপ্রিল, পর্যটকরা একটি ঘৃণ্য জঙ্গী আক্রমনের শিকার হন। জঙ্গীদের ধরা না গেলেও তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সংযোগ স্পষ্ট। ২৭ জন নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ চলে যায়। মৃত পর্যটকরা সকলেই হিন্দু। হৃদয় বিদারক এই ঘটনা মেইনস্ট্রীম মিডিয়াতে সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে পরিণত হয়। ঘোড়া চালক সইদ আলি হুসেন শাহ যে জঙ্গীদের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিতে গিয়েছিলেন এবং জঙ্গীরা তাকে হত্যা করে, ভারতীয় জওয়ান ঝন্টু আলি শেখ যে সেদিন কর্তব্যরত অবস্থায় জঙ্গীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন সেটা জানতে জানতে একদিন পার হয়ে যায়।

গোদি মিড়িয়া প্রশ্ন তোলেনি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর নজর এড়িয়ে পাক জঙ্গীরা ভারতে কীভাবে ঢুকল? যে কাশ্মীরে প্রতি দশ জনে একজন সেনা মোতায়েন করা আছে, সেই প্রতিরক্ষা পহালগাঁও-বৈসরণে সেদিন ছিল না কেন? তার বদলে নিশানা করা হয়েছে পাকিস্তানকে এবং ভারতে থাকা ১৭ শতাংশ মুসলিম জনগনকে। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এমনকি রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো মনীষীরাও বিজেপির আইটি সেল ও গোদি মিডিয়ার আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাননি। যদিও সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা পিটিআই সরকারি আধিকারিকদের উল্লেখ করে জানিয়েছে – কাশ্মীরে পর্যটকদের উপর জঙ্গী হামলার সম্ভাবনা নিয়ে গোয়েন্দাদের আগাম সতর্কবার্তা ছিল। এই তথ্য জনমানসে স্বাভাবিকভাবেই বহু প্রশ্ন তুলে দেয়। কিন্তু বর্তমানে সরকার অস্বস্তিতে পড়তে পারে এমন কোন প্রশ্ন করা যাবেনা। করলে নেহা রাঠোরের মতো মামলার মুখোমুখি হতে হবে।

গোদি মিডিয়া দেখায় নি যে, প্রায় সমস্ত কাশ্মীর এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতায় পথে নেমে মিছিল করেছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে, পালন করেছে হরতাল। মিডিয়া দেখায় নি ঘোড়া-চালকরা কীভাবে কাঁধে করে পর্যটকদের বৈসরণ থেকে নিচে নামিয়ে এনেছেন। ট্যাক্সিচালক, হোটেল মালিক, সাধারণ কাশ্মীরীরা পর্যটকদের চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এইসব খবর করলে মিডিয়ার স্বার্থ পূরণ হয়না।

কেন্দ্র সরকার তড়িঘড়ি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকে, যদিও তাতে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকতে পারেন নি। ঐদিন বিহারের ভোটপ্রচার বাতিল করে দিল্লী ফেরার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেননি। সমস্ত সংসদীয় দল কেন্দ্র সরকারের পাশে থাকার আশ্বাস দেয়। সরকার থেকে একগুচ্ছ ঘোষণা করা হয়। জঙ্গী নিকেষে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়া, পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল, পাকিস্তানের পাসপোর্ট বাতিল, আটারি-ওয়াঘা বর্ডার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার মতো বিষয়গুলি ঘোষণার অন্যতম অঙ্গ।

বাস্তবে যা দেখা গেল —একজনও জঙ্গীকেও আজ পর্যন্ত ধরা সম্ভব না হলেও কাশ্মীরের বহু যুবককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একজন টাট্টু চালক গুলি চলার শব্দে ‘আল্লাহ আকবর’ বলে ফেলার জন্য চার-পাঁচদিন আটক থাকলেন। পরে সিদ্ধান্তে আসা গেল যে, এটা বিপদের আশঙ্কায় নেহাতই ‘রাম রাম’ বলার মতো বিষয়। জঙ্গী থাকতে পারে এই সম্ভাবনায় কাশ্মীরে কিছু ঘর বাডি ভেঙে দেওয়া হল। ভারতীয় পুরুষের স্ত্রীর পাকিস্তানের পাসপোর্ট হবার কারণে একবছরের দুধের শিশুকে ভারতে ছেড়ে রেখে তাকে ওয়াঘা বর্ডার পার করে যেতে বাধ্য করা হল। কোন কাকুতি-মিনতি কাজে আসল না। একই রকমভাবে দুটি নাবালকের পাসপোর্ট পাকিস্তানের হবার কারণে মায়ের থেকে আলাদা করে তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হল। হৃদয় বিদারক এইসব ঘটনা ওয়াঘা বর্ডারে ঘটতে থাকল। এই ওয়াঘা বর্ডার দিয়ে ভারতের ৫২৩ মিলিয়ন ডলারের জিনিসপত্র পাকিস্তানে যায়। আর মাত্র ৭ মিলিয়ন ডলারের জিনিস ভারতে ঢোকে। বাণিজ্যিক এই লেনদেন বন্ধের কোন ঘোষণা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। আর বিশেষজ্ঞদের মতে সিন্ধুর জল আটকাতে হলে যে বাঁধ নির্মণ করতে হবে তার জন্য কমপক্ষে চারপাঁচ বছর সময় লাগবে। বিপুল ব্যায়ভার আর কুফল হিসাবে ভারতভূমি প্লাবিত হবার প্রসঙ্গ না হয় ছেড়েই দিলাম। বিষয়টা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার সঙ্গেই তুলনীয়।

এছাড়া যেগুলো হতে থাকল তার মধ্যে অন্যতম হল কাশ্মীরের বাইরে পড়তে আসা কাশ্মীরী ছাত্র-ছাত্রী, কাশ্মীরী শালওয়ালাদের ধরে ধরে শারীরিক ও মানসিক ভাবে হেনস্থা করা। গোদি মিডিয়া দায়িত্ব সহকারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তথা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল। সারা ভারতে পশ্চিমবাংলা থেকে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের পিটিয়ে তাড়নো হতে থাকল। গুজরাটে প্রায় ছ হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে আটক করে কাগজপত্র পরীক্ষা করা হল। এরমধ্যে চারশ জনকে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোটামুটি বাংলায় কথা বললেই মুসলিম বাঙালীকে ‘ঘুসপেটিয়া’ ধরে নিয়ে প্রথমে পিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে ছড়ির আগায় রেখে জয় শ্রী রাম বলতে বাধ্য করা। বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিক ইতিমধ্যে প্রাণ হাতে করে পশ্চিমবঙ্গে ফিরেও এসেছেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে পশ্চিমবাংলা থেকে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যাওয়া বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। সেই ২০০৫ সালেই সাচ্চার কমিটি ভারতবর্ষে মুসলিম জনগোষ্ঠীর পিছিয়ে থাকার কারণ হিসাবে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবকে চিহ্নিত করেছিল। তারপর দিল্লীর মসনদে অনেক পালাবদলের সাক্ষী থেকেছে দেশ। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নতিসাধনে কোন প্রকল্প ঘোষিত হয়নি। উল্টে এনডিএ আমলে নেমে এসেছে একের পর এক খাঁড়ার ঘা। সিএএ-এনআরসি, ইউনিফর্ম সিভিল কোড আর সাম্প্রতিক কালে ওয়াকফ আইন।

২০২৬-এর ভোটকে লক্ষ্য রেখে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বিভাজনের রাজনীতিটা ভালোভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মুসলিম। বাকি ৭০ শতাংশের ভোটটা যদি নিশ্চিত করা যায়, সেই লক্ষ্যেই সব পদক্ষেপ। ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে হওয়া একটি মিছিল থেকে মুর্শিদাবাদে দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের বিস্তারিত রিপোর্ট বলছে এটা কোন স্বতস্ফূর্ত দাঙ্গা ছিল না, সম্পূর্ণরূপে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। এখানে রাজ্য গোয়েন্দা ও পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতার দাম দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।

এখন পহেলগাঁওকে সামনে রেখে বাঙালী মুসলিমদের উপর অর্থনৈতিক অবরোধের চক্রান্ত করা হচ্ছে। রাজ্য সরকারও হিন্দু ভোটারদের কাছে টানতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দীঘায় মন্দির করেছে, টেম্পল ট্যুরিজিমের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অন্য রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসা এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কী ব্যবস্থা হবে? প্রশাসন যেখানে প্রচ্ছন্ন মদতের ভূমিকা নেয়, সেখানে রাজ্যের বাইরে থেকেই বা তাঁরা কাজ করবেন কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের কাছে আছে কিনা, জানা নেই।

বাঙালীর মননে সাম্প্রদায়িকতার বীজ প্রথম ঢুকেছে ঔপনিবেশিক যুগে, যা তৈরী করা হয়েছিল বাঙলার জাতীয়তবাদকে ভাঙার জন্য। ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল ভারতের উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হাতে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর বাদেও শাসক শ্রেণীর এই চরিত্র বদলায় নি।

কেন বাঙালী নিশানায়?

আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল স্তরে কাজ করে যাচ্ছে। তার ফল হিসাবে তলোয়ার নিয়ে রামনবমীর মিছিল দেখতে হচ্ছে বাঙালীকে। এত কিছুর পরেও জয় শ্রী রাম কিন্তু বাংলায় ঠিক জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। কেন রামনবমী বা জয় শ্রী রাম ধ্বনি দিয়ে বাঙালীকে ঠিক গড়েপিঠে নেওয়া যাচ্ছে না, সেটা বুঝতে হলে আমাদের বাঙালী জাতির ইতিহাসকে খুব সংক্ষেপে একটু বুঝে নিতে হবে।

বাংলা চিরকালই ছিল আর্যাবর্তের বাইরে। আদি-নর্ডিক জনগোষ্ঠী, যারা বৈদিক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, তাদের রক্ত বাঙালীদের মধ্যে খুব সামান্য পরিমানে আছে। বলা যেতে পারে সমাজ বিন্যাসের একেবারে উচ্চস্তরে রয়েছে। তাই বলে বাঙালী ব্রাহ্মণের মধ্যে কোন মিশ্রণ হয়নি এমনটা একেবারেই নয়। মূলতঃ বাঙালী জাতি তৈরী হয়েছে অ্যালপাইন ও আদি-অস্ট্রেলীয় জনজাতির সংমিশ্রণে। বহু পূর্বে বাঙলার মানুষজনকে ম্লেচ্ছ হিসাবেই উল্লেখ করা হত আর্য সংস্কৃতিতে।

এখনও বাঙালীকে ঠিক হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্বের সাংস্কৃতিক দীক্ষায় দীক্ষিত করে নেওয়া যাচ্ছেনা। হিন্দি বলয়ের রাম কেন্দ্রিক হিন্দুত্ব ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পিতৃতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আদর্শ। যে রাম বেদপাঠের অপরাধে শূদ্র শম্বুকের মুণ্ডচ্ছেদ করে, গর্ভবতী সীতাকে অসতী অপবাদে ত্যাগ করতে পারে, নিজ স্বার্থে অন্যায়ভাবে বালিকে হত্যা করতে পারে।

বাংলার মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে বুঝতে হলেও এর শাসন কালগুলো একটু দেখে নিতে হবে। অষ্টম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় পালবংশ শাসন করেছে, যারা বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক হলেও হিন্দু ধর্মের প্রতি ছিলেন উদার মনস্ক। দক্ষিণ ভারত থেকে আসা সেন বংশ খুব অল্পদিন শাসন করলেও বাংলায় গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিষ্ঠাতা তারাই। এদের সময় বাংলায় কৌলিণ্য প্রথার প্রচলন হয়, যা নারীদের জন্য ছিল চরম প্রতিক্রিয়শীল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই রকম শক্ত ঘাঁটিতে দাঁড়িয়েই লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব রচনা করলেন গীতগোবিন্দ কাব্য। সৃষ্টি হল রাধা চরিত্র, যে রাধা কৃষ্ণপ্রেমে পাগল, সমাজের সব বাধাকে তুচ্ছ করে সে কৃষ্ণের অভিসারিনী। বৈষ্ণব ধর্মের আধারে মানবপ্রেমের এই কাব্য পেল ধর্মীয় ব্যাখ্যা। ইতিমধ্যে বাংলায় শুরু হয়ে গেছে ইসলামী শাসন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই বাংলার ইসলামী শাসন দিল্লীর প্রভাবমুক্ত স্বাধীন সুলতানী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। বাংলায় বিস্তার লাভ করে ইসলাম ধর্ম। কিন্তু তা ধ্রুপদী ইসলাম ধর্মের থেকে পৃথক। যা আসলে উদার ও মানবিক সুফিবাদ। সারা ভারতে বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া বৌদ্ধ ধর্ম হীনযান, ব্রজযান, সহজিয়া, বাউল, নাথ ইত্যাদি শাখায় বাহিত হল বাংলার মাটিতে। কৃষিজ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত মানুষ সুলতানি আমলে ইসলাম গ্রহণ করল।  নাহলে করের বাড়তি বোঝা বইতে হবে, আবার হিন্দু ধর্মেও সে ব্রাত্য। সুফির মানবতাবাদের বিপরীতে জাতপাতের সঙ্কীর্ণতায় জীর্ণ হিন্দু ধর্মকে ষোড়শ শতকে বাঁচালেন শ্রীচৈতন্য। জাতপাত আর মন্দিরকেন্দ্রিক আচার সর্বস্বতাকে বিসর্জন দিয়ে ভক্তি ও প্রেমের নামগানে ভাসিয়ে দিলেন সমাজকে। সুফি ও ভক্তির সমন্বয়ে গঠিত এক সমাজ, যা বহুত্বকে ধারণ করল।

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনিপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা আজও প্রকৃতি কেন্দ্রিক ধর্মাচারণে অভ্যস্ত। এই কৌম চেতনা ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বাংলার মূল উপাদান। আর তাকে পুষ্টি জুগিয়েছে ভূমিনির্ভর কৃষিজ উৎপাদন, শস্যশ্যামলা বাংলার প্রকৃতি যাকে ধারণ করেছে।

আজও সারাভারত যখন রামের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে দিওয়ালি উদযাপন করে, বাঙালী তখন মাতৃশক্তি হিসাবে কালীর আরাধনা করে। সারা ভারতের দশেরাও বাঙালীর দুর্গোৎসবের থেকে একেবারেই আলাদা। কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসা একাধিক দেবী-পুজোর প্রচলন এবং উৎসব আকারে উদযাপন এই অঞ্চলের মাতৃকেন্দ্রিক কৃষি সভ্যতার অবশেষ হিসাবে টিকে আছে। যা ভারতের হিন্দি বলয়ে নেই।

উনিশ শতকেও শ্রীরামকৃষ্ণ বাংলার এই বহুত্বকে ধারন করলেন তাঁর ‘যতমত ততপথ’ বাণীর মধ্যে দিয়ে, যদিও রানী রাসমনি মাহিষ্য জাতির হবার কারণে ঐ মন্দির নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। এক টাকা দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের দাদা জমি কিনে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্য থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ হিন্দুধর্মের ভিতরে বহুত্বকে ধারণ করলেও বিচ্ছিন্নতার বীজটি সুপ্ত আকারে থেকেই গেল। 

স্বাধীন ভারতের অবস্থা

বাঙালীর মননে সাম্প্রদায়িকতার বীজ প্রথম ঢুকেছে ঔপনিবেশিক যুগে, যা তৈরী করা হয়েছিল বাঙলার জাতীয়তবাদকে ভাঙার জন্য। ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল ভারতের উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হাতে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর বাদেও শাসক শ্রেণীর এই চরিত্র বদলায় নি। তাই এখনও শাসকশ্রেণী নিজেদের সুবিধার্থে এই সাম্প্রদায়িকতাকেই ব্যবহার করে যাচ্ছে। রাম কেন্দ্রিক যে হিন্দুত্বের নির্মাণ শুরু হয়েছে তা ভারতের বহুত্বকে ধারন করে না। আর বাংলায় সুপ্ত অবস্থায় বিচ্ছিন্নতার যে বীজ রয়ে গিয়েছিল আরএসএস-বিজেপির কাছে তাই-ই এখন সোনা ফলানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

দলিত নারীকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে দেওয়া, দলিত পুরুষ ঘোড়ায় চড়লে বা গাড়ি চড়লে উচ্চবর্ণের হাতে মার খাওয়া, মন্দিরের কল থেকে দলিত বালক জল খেয়ে ফেললে তাকে মেরে শিক্ষা দেওয়া, এমনকি দলিতের গায়ে প্রস্রাব করে দেওয়া —এসব এখন উত্তর ও মধ্যভারতের সর্বত্র সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে আদিবাসী মানেই মাওবাদী, মুসলিম মানেই সন্ত্রাসবাদী, দলিত মানেই চোর-চামার। আর এই জনগোষ্ঠীর নারীরা যেকোন সময় ভোগের সামগ্রী। সংবিধান সকলকে সমান অধিকার দেয়। কিন্তু সেই অধিকার আদায়ের জন্য দিল্লী পর্যন্ত দৌড়ানোর ক্ষমতাটা নির্ভর করে শিক্ষা আর সম্পদের পরিমানের উপর। ন্যায় পাওয়াটা নির্ভর করে রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর। এই অসমতা কি দূর করা সম্ভব হবে জাতিগননার মধ্যে দিয়ে? ‘যিতনা আবাদী উতনা হক’—এই স্লোগান ভারতে নতুন নয়। তবু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের শিকড় আলগা হয়নি এদেশে। দেখতে হবে আগামীদিনে ভারত কোন্ দিকে যায়। তবে আজকের এই অস্থিরতা শুধুমাত্র ভারতের শাসক শ্রেণীকে ভোটের বাজারে সুবিধা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর স্বার্থ এখানে জড়িয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক স্বার্থ

ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশের শোষণ-শাসনটা ভারতের মানুষের প্রত্যক্ষ অনুভবের ভিতরে ছিল, তাই শত্রুকে আমরা চিনতাম। বাংলার কুটির শিল্প ধ্বংস করা হল, কাঁচামাল লুঠ করা হতে থাকল, সেই কাঁচামাল দিয়ে তৈরী জিনিস বেশি দামে আমরা কিনতে বাধ্য হলাম —এগুলো আমাদের জানা জিনিস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, ব্রিটেন এবং পশ্চিম ইউরোপকে বাধ্য করে সরাসরি উপনিবেশ থেকে হাত গোটাতে। শাসন ব্যবস্থা ছেড়ে দেওয়া হয় দেশের শাসকশ্রেণীর হাতে। স্বাধীনতার পরপরই ভারতে ভারী শিল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র, ইত্যাদি কিছু গড় উঠলেও আমরা যুদ্ধ সামগ্রী কোনদিন বানাতে শিখলাম না। ভারত লৌহ উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁচামাল হিসাবে লৌহ রপ্তানিতে চতুর্থ। যদিও  ভারতীয় বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদরা ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবী জুড়ে। তবু আমরা যুদ্ধাস্ত্র বানাতে পারিনা। এই পহেলগাঁও দুর্ঘটনার পরে মিডিয়া যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তার জন্য ফ্রান্স থেকে অতিরিক্ত ২৬টি যুদ্ধ বিমান কেনার চুক্তি সই হয়েছে ২রা মে। আর গৃহস্থালীর ইলেকট্রনিক ভোগ্যপণ্য বা গাড়ি শিল্পে আমাদের টিমটিম করে চলা একটা দুটো কোম্পানি থাকলেও আমরা মূলতঃ আমদানি নির্ভর। ভারত একটা বিরাট বাজার, যার ক্রয়ক্ষমতা আছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি। আমরা কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারি না, বড়জোর সব মালমশলা হাতে পেলে জোরা লগাতে শিখেছি। অর্থাৎ এখনও আমরা কাঁচামাল রপ্তানি আর ভোগ্যপণ্য আমদানিতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখন আমাদের শত্রুর চেহারা আমাদের কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতাগুলোকে দেখতে পেলেও ফিন্যান্স ক্যাপিটাল কখন, কোথা দিয়ে ভারতের বাজারে ঢুকছে তা বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু শোষণটা তো হচ্ছে একেবারে গায়ে গতরে। এইখানেই আড়ালে থাকা পুঁজির সুবিধা এবং এই পুঁজির দালালি করা রাজনৈতিক শক্তিগুলোরও সুবিধা। এই অবস্থায় সুকৌশলে শত্রুর নির্মাণ চলছে। এই নির্মিত শত্রুর পিছনে শুধু মানুষকে লেলিয়ে দিলেই যথেষ্ট। তারপর কাঁচামাল নেওয়া আর জিনিস বিক্রি করা যেমন চলছে তেমন চলবে। এই পর্যন্ত একটা স্তর এবং একটা ছক। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতা ও বাজারের একটি পুনর্বিন্যাস তৈরি হচ্ছে।

একবিংশ শতাব্দীতে নতুন জ্বালানি হিসাবে কাজ করবে বিরল খনিজ পদার্থ যার মজুদ ভান্ডার হিসাবে পৃথিবীতে ভারত তৃতীয় স্থানে আছে। হিমালয়ে হাজার কিমি বিস্তৃত চীন-ভারত সীমান্ত অঞ্চলটিতে রয়েছে এই মজুদের একটা অংশ, যার উপর চীনের শ্যেন দৃষ্টি রয়েছে। আবার বিরল খনিজ মজুদের দিক থেকে সপ্তম স্থানে থাকা আমেরিকা তার রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করে ভারতের এই খনিজের উপর দখল নিতে চেষ্টা করছে। পহেলগাঁও এর ঘটনার পরেই ট্রাম্প ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে। চীনও চুপ করে বসে নেয়। ভারত যুদ্ধ করলে সে পাকিস্তানের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের উপর আধিপত্য ধরে রাখতে আমেরিকা আজ পর্যন্ত কোন না কোন ছুতোয় সেখানে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান দুজনেই পরমানু শক্তিধর দেশ। দুটি পরমানু শক্তিধর দেশ পুরোদস্তুর যুদ্ধ করবে না কখনও। কিন্তু ছায়াযুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখতে পারে, যে আবহে সাধারণ মানুষের বেসিক চাহিদাকে কিছুকালের জন্য শিকেয় তুলে রাখা যায়। আর একটা পথ হল মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকেই লড়িয়ে দেওয়া, যার আড়ালে দেশের সম্পদ বেচে ভারতের পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি যেমন হবে, রাজনৈতিক নেতাদের প্রসাদ ভক্ষণটাও তেমনি হবে।

উপসংহার

বিংশ শতকের এক ছাদের তলায় কাজ করা কারখানা শ্রমিকই আজ পরিযায়ী শ্রমিক। স্থানীয় চরিত্র ঘুচিয়ে আজ সে আন্তর্জাতিকতার পথে। প্রযুক্তি তাকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। শ্রমিক সংগঠনকে আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতির বাধা দূর করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সারা দেশব্যপী সংগঠন গড় তুলতে হবে। জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে নিগৃহীত শ্রমিকের পাশে গিয়ে দাঁড়তে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দাবি হোক দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রয়োজন অনুসারে দেশের মানুষের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য শিল্প গড়ে তোলার। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, দেশে বিদেশি সামগ্রীর বাজার তৈরি করার মধ্যে দিয়ে আত্মনির্ভর দেশ গড়ে তোলা যায় না। পরিযায়ী শ্রমিক তৈরি হওয়ার পিছনে কাজ করছে চাপিয়ে দেওয়া সবুজ বিপ্লবের অভিশাপ। কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলি থেকেই সেইজন্য পরিযানের হার সবথেকে বেশি। শ্রমিকের পাশাপাশি তাই কৃষককেও সংগঠিত হতে হবে এবং শ্রমিক-কৃষক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তিকেই শাসকশ্রেণী ভয় পায়, তাই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়। আমাদের সকলকে উপলব্ধি করতে হবে এই সত্যকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top