সুপর্ণা দে
“টগরদিদি, ডালিম ফুল/ রোজ যাচ্ছে দূরের স্কুল/ সাইকেল নয় ,পক্ষীরাজ /গল্প আমার সাঙ্গ আজ”-
দূরের স্কুলে যাচ্ছে – সাইকেলে, এ তো শুধু সাইকেল নয়, এ যেন এক পক্ষীরাজ ঘোড়া – টগবগিয়ে নিজের স্বপ্নকে ধরতে চলেছে টগরদিদি । অথচ এই টগরদিদির ছোট ডালিম বোনটি হারিয়ে যায় l ডাকাতরা তাকে তুলে নিয়ে যায় l ডাকাতের হাত থেকে পালাতে গিয়ে বিষ কুঁয়োয় পড়ে যায় । হারিয়ে যাওয়া ছোট বোনটিকে টগরদিদি বিষ কুঁয়োয় লুকিয়ে থাকা অজগরের পেটের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে। মনে হচ্ছে তো এ এক রূপকথার গল্প ?
না ! এ রূপকথার গল্প নয় এ ভয়ঙ্কর বাস্তব, পরিণতি অবশ্য মিলনাত্মক, রূপকথার গল্পের মতো। বাস্তবে কি আমরা এই টগরদিদি, ডালিমবোন দের সেই সমাজ উপহার দিতে পেরেছি যেখানে তারা উচ্চৈঃশ্রবার কেশর ধরে তাকে বশ মানাতে পারবে। পারিনি ! অপহরণ, শিশুকন্যা পাচার, নারীপাচার চক্র, ধর্ষণ, অত্যাচরের প্রতিকী রূপ টগরদিদির ডালিমবোন গল্পে লুকিয়ে আছে ।
এ পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর অর্ধেক তার রচিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর – সেই অর্ধেক পৃথিবীর শ্রষ্ঠাদের এ কোন পরিনতি । প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর স্থান ছিল পুরুষের সমতুল্য । মনুর যুগে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে নারীর স্থান ক্রমশ সংকীর্ণ হতে শুরু করেছে । পশ্চিম ইউরোপে বু্র্জোয়া শ্রেণির হাত ধরে প্রসার ঘটে লিঙ্গ বৈষম্যের । বুর্জোয়া শ্রেণি যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার ওপরে দাঁড়িয়েছিল ,তার শ্রমবিভাজনের রূপটি ছিল লিঙ্গভিত্তিক অর্থাৎ বুর্জোয়া মতাদর্শ অনুসারে পুরুষের জন্য বরাদ্দ হল বাইরের জগতের উৎপাদনমুখী ভূমিকা আর নারীর জন্য বরাদ্দ হল অন্দরমহলে প্রজননমূখী ভূমিকা । মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আমরা বেরিয়ে আসি ফরাসি বিপ্লবের জোয়ারে অথচ ফ্রান্সে ১৯৬০ সালে মহিলারা ভোটাধিকার পায়। প্রদীপের তলাটুকুর অন্ধকারের মতনই অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি দেশের নারী সমাজ ও আশ্চর্যজনক ভাবে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার । ১৯৪৯ সালে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়া নারীর সামাজিক অবস্থানকে প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেছেন Second Sex । তারও অনেক আগে আঠারো শতকে মেরি উলস্টোনক্রাফট ও উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল মেয়েদের শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত করে অন্দরমহলে আটকে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন । ভারতবর্ষেও সেইসময় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে রাজা রামমোহন রায় ও বিদাসাগরের হাত ধরে ।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবী যখন সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে তখন দেখা গেল নারীরা দারুণ বৈষম্যের শিকার। কাজের জগতে তাদের স্বীকৃতি বাড়েনি বরং কমেছে। প্রজননের মতো মহৎগুনের অধিকারী নারী পরিনত হয়েছে গর্ভদাসীতে। ইতিহাসে, সৃজনশীল শিল্পে , সাহিত্যে নারী ক্রমশ হারিয়ে গেছে। সাহিত্যে নারীচরিত্র চিত্রণ ক্রমশই হয়ে উঠেছে পুরুষের যৌন লালসা তৃপ্তির মাধ্যম। বাজারি সভ্যতার প্রধান মাধ্যম গনমাধ্যম –সেখানেও মেয়েরা ক্রমশ অবদমিত হয়েছে, পুরুষের লালসায় ইন্ধন জুগিয়েছে মাত্র । পরিবারের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃত সম্পর্কের মধ্যেও স্বাভাবিকতার মুখোশে নারী ও শিশু হয়ে চলেছে অত্যাচারিত। পিতৃতন্ত্রের বোঝায় অবদমিত অর্ধেক আকাশের অধিকারিনীরা। যে নারী পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ কাজ করে তার এক তৃতীয়াংশ অধিকার ও প্রতিষ্ঠা পায় না সে। বর্তমান পৃথিবীতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা পেলেও তা পিতৃতন্ত্রের দলিলকে শিরধার্য করে । আত্মপ্রচারের ব্যাধিতে ভুগে চলা সমাজ ভাবছে ‘ সব ঠিক আছে’ কিন্তু সমাজের গভীর গোপনে ভয়ঙ্করভাবে বাসা বেঁধেছে লিঙ্গ-বৈষম্য। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষের লালসা ও লোলুপতায় নারীরা ভাবছে তারা কম শক্তিশালী – তাদের extra security র প্রয়োজন। আর এই ভাবনা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় সমাজ – লিঙ্গ বৈষম্যের সমাজ। এক ভয়ঙ্কর ক্ষয় রোগের মতো লিঙ্গ বৈষম্য একবিংশ শতাব্দীতেও সাড়ম্বরে বিরাজমান। তাই চারিদিকে ধর্ষণ, খুন, নারীপাচার, কন্যাভ্রূণ হত্যা ,নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে –নারী যেন একটি ভোগ্য বস্তু । আজও প্রচলিত সমাজ নারীকে চেনা পেশার বাইরে যেতে দিতে আগ্রহী নয় । তার সব কাজের গতিবিধি স্থির করে দেবে পিতৃতন্ত্র । হাসির বিষয় যে, নারীর পোষাক নিয়েও এ সমাজ ভীষণভাবে সরব । কাজের জায়গায় একদল নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় মেধার পরিবর্তে কর্ম জগতে দেখা হচ্ছে সে কতখানি যৌন আবেদন রাখে । রাস্তাঘাটে , যান বাহনে বিভিন্ন সত্ত্বা তাকে মনে করিয়ে দেয় সে নারী – গৃহ তার নিরাপদ স্থান। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সভ্যতার বিকাশ যখন আকাশ ছোঁয়া তখন নারীদের বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয় হচ্ছে ।
আজকের করনীয় :
বর্তমান পৃথিবীতে পিতৃতন্ত্র একটি স্বতন্ত্র শোষণ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার নীতি ও রাজনীতির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর অবদমনের প্রক্রিয়া। নারী ও প্রকৃতির ওপর চলতে থাকে এই অবদমন
প্রক্রিয়া। লিঙ্গ রাজনীতিতে পুরুষের ভাবনাটাই সমাজর ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে –সেই চিন্তা প্রক্রিয়ার বদল ঘটাতে হবে। ব্যক্তি মালিকানা ধারনায় পুরুষ যবে থেকে নারীর ওপর তার সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করল , মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ধ্বংস ঘটালো তবে থেকেই বিশ্বব্যাপী নারীদের পরাজয়ের ধারা শুরু হয়। এঙ্গেলস তাঁর ব্যক্তিগত মালিকানাতে পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎস সন্ধানে নারীর বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়ের কথা বলেছেন । সমাজের চেতন ও অবচেতন স্তরে আলোড়ন তুলে নারী ও প্রকৃতির দাবী আর অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে । শ্লোগান তুলতে হবে সমানাধিকারের, কর্মের যোগ্য স্বীকৃতির ।
শিল্পে ,সাহিত্যে,সমাজবিজ্ঞানে,গনমাধ্যমে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। যে নারী দুই তৃতীয়াংশ কাজ করেও এক তৃতীয়াংশ স্বাচ্ছন্দ্যভোগ করে না তার স্বীকৃতি ও সমানাধিকারের লড়াইকে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে । নারীকে নারী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অর্জিত ক্ষমতার প্রতি তাদের সচেতন করতে হবে। নারী সচেতনতার পাশাপাশি পুরুষ সচেতনতারও প্রয়োজন । মায়েরা অপুষ্ট ও অশিক্ষিত থাকলে মেয়েরাও অশিক্ষিত ও অপুষ্ট হবে । আমাদের দেশের মহিলাদের ক্ষমতায়ন হয় সে বিড়ি বাঁধতে পারে কিনা , তাঁত বুনতে পারে কিনা , মাঠে কাজ করতে পারে কিনা , মীন ধরতে পারে কিনা – এসব তো সে পারবেই , তার সাথে তার মানসিক দৃঢ়তা ও তার দাবী-অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষমতায়নের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে । খাতায় কলমে জেলায় জেলায় নারী সুরক্ষা নয়, সত্যিকারের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির প্রয়োজন। একজন স্বনামধন্য লেখিকা লিখেছেন এদেশের নারীরা যখন নিজের বাড়িতে নিরাপদ নয় , সুরক্ষিত নয় তখন সে কোথাও নিরাপদ ও সুরক্ষিত নয় । মাতৃতন্ত্রের শ্লোগানে সুরক্ষিত সমাজ ও পরিবার গড়ে তুলতে হবে । নারী ও প্রকৃতির অধিকারের দাবীকে আরও মুখরিত করে তুলতে হবে ।
লেখক পরিচিতি:
লোকসংস্কৃতির গবেষক, পরিবেশ কর্মী ও নাট্যকর্মী।
মেইল আই ডি: