রুণা মিশ্র
বর্তমানকালে সমাজজীবন বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন বাড়ছে এখানে ভালোভাবে টিকে থাকার লড়াই। প্রাচীনকালে মনুষ্য প্রজাতিকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করে দেখেছি – নারী ও পুরুষ। এটাই ছিল জনজীবনের স্বাভাবিক চেহারা। কিন্তু সেই যুগেও এমন কিছু মানুষ ছিল যারা চেহারায় পুরুষ কিন্তু তাদের হাবভাব ছিল মেয়েদের মতো বা এর উল্টোটাও ছিল অর্থাৎ চেহারায় নারী কিন্তু আচরণে পুরুষ। বর্তমানকালেও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এই রকম মানুষদের সংস্পর্শে আসি। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই এদের এতদিন ছোট চোখে দেখে এসেছি। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। আগের দিনে সমাজ পরিবারের চাপে এই সমস্ত মানুষরা তাদের নিজেদের মানসিক বা যৌনচাহিদা মনের মধ্যে চেপে রেখেই জীবনযাপন করতে বাধ্য হত, আজকের এই সচেতনতার যুগে এইসকল মানুষ তাদের চাহিদাকে আর অস্বীকার করছে না বরং তা আদায়ের জন্য সোচ্চার হচ্ছে। এবং এক্ষেত্রেই সমাজ একটা গেল গেল রব তুলছে। এই সমস্ত ছেলেমেয়েরা যখন থেকে তাদের শরীরে ভিন্নধর্মী একটা চাহিদা (যেটা সমাজ স্বীকৃত নয়) অনুভব করছে তখন থেকেই শুরু হচ্ছে তার লড়াই। বয়ঃসন্ধিকালের এই সময়টা স্বাভাবিকভাবেই ছেলেমেয়েরা স্কুলে কাটায়। সেখানেও তার ব্যবহারের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে তারা সহপাঠীদের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যঙ্গ বিদ্রুপের স্বীকার হয় এবং নিজে আরও হীনমন্যতায় ভোগে। কারণ মনে রাখতে হবে সে নিজে নিজের অন্তরের এই পরিবর্তন সকলের আগে বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে সে আর পাঁচটা সাধারণ ছেলেমেয়ের মতো নয়, সে ভিন্ন। কিন্তু তার সমস্যার গোড়াটা কোথায় এটা সে নিজেও বুঝতে পারে না। আর ভয় বা লজ্জায় সে কাউকে কিছু জানাতেও পারে না। এক্ষেত্রে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বাড়িতে অভিভাবকের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখা যায় অভিভাবক খুব ভীত হয়ে পড়েন লোকলজ্জার ভয়ে এবং বাড়িতে চলতে থাকে অকারন শাসন। তারা ভাবেন শুধু শাসন করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনেকে তো আবার ভাবেন এটা ছেলেমেয়েদের দুষ্টুমি, ফলে শাসনই একমাত্র পন্থা। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা ঘরে আটকে রাখা, ভয় দেখানো এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন।
এরফলে এইজাতীয় ছেলেমেয়েরা আরও ভয় পেয়ে গুটিয়ে যায়, হীনমন্যতায় ভোগে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এখন তারা হয়তো বলবেন এই সমস্যার বিষয়ে আমরা আর বেশি কি জানি বা বুঝি? কিন্তু জানতেও হবে এবং অভিভাবকদের জানাতেও হবে। প্রয়োজনে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। কারণ অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।
তাহলে আমাদের প্রথম কাজটা হলো সমস্যাটিকে ঠিক মতো জানা বোঝা। এই সমস্যা সাধারণভাবে দেখা হয় অস্বভাবী (abnormal) যৌনাচরণ হিসাবে। অর্থাৎ আমাদের মানবজীবনে যে যৌনাচরণ স্বভাবী বলে মনে হয় এই আচরণ তা নয়। এখানে যৌনাচরণ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গী, নিজ লিঙ্গের প্রতি আচরণ, লিঙ্গের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। এই ধরনের মানুষদের ক্ষেত্রে লিঙ্গ আচরণের তিনটি ধরন রয়েছে নারী-সমকামী, পুরুষ-সমকামী এবং উভকামী যাদের কেউই প্রথাগত লিঙ্গ সংক্রান্ত আন্তঃসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে না। এখানে প্রধান সমস্যা হল যৌনাচরণ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গী (orientation) এবং যৌনাচরণের পছন্দ (sexual preference)। এই ধরনের মানুষের মনের মধ্যে তিনটি বিষয় প্রাধান্য পায় – যৌনাকাঙ্ক্ষা (desire) অর্থাৎ এই যৌনতার ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য যে ধরনের আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। ঠিক কী ধরনের যৌনাচরণ ব্যক্তির পছন্দ অর্থাৎ ব্যক্তি এই যৌনাচরণ করে অন্যদের আকৃষ্ট করতে চায়। যৌনাচরণ চার ধরনের হতে পারে – সমকামিতা, বিপরীতকামিতা, উভকামিতা এবং অকামিতা (যাদের মধ্যে কোনো ধরনের যৌনাকর্ষনই থাকে না)। একই ব্যক্তির বিভিন্ন সময়ে এই চার ধরনের কাম ভাবই থাকতে পারে তবে বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে এই কামভাব বিভিন্ন সময়ে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। এর মধ্যে সমাজ স্বীকৃত যৌনাচরণ শুধুমাত্র বিপরীতকামিতা। যেখানে একজন নারী-পুরুষের মধ্যে যৌনসম্পর্ক একমাত্র সমাজ স্বীকৃত। বিভিন্ন যৌনধর্মী মানুষ আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে দেখতে পাই এর মধ্যে বৃহন্নলা বা হিজড়ে (hermaphrodite) যাদের প্রায় কোনো ধরনের যৌন অঙ্গ থাকে না। দ্বিতীয়ত যারা নিজেদের যৌনধর্ম পরিবর্তন করে থাকে যেমন নারী থেকে পুরুষে রূপান্তর বা পুরুষের নারীতে রূপান্তর যাদের ট্রান্সসেকচুয়েল বা ট্রান্সজেনডার বলা হয়।
এখন পাঠকগণ জানতে চাইতেই পারেন কবে কোন পরিস্থিতিতে এই লক্ষণগুলি প্রকাশ পাচ্ছে আমরা কি করে বুঝবো? অনেক অভিভাবক বলেন আমার সন্তান তো স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নিয়েছিল এবং আমরা তো ওকে সুস্থ পরিবেশে বড় করেছি তাহলে ওর মধ্যে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে কেন? এর উত্তর পেতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই সন্তানের গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন পর্যায়ে। লিঙ্গ সংক্রান্ত পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলি বিকশিত হতে শুরু করে গর্ভাবস্থার বারো সপ্তাহের পর। এই সময়কালে জিনগত কারণের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গের ভেদ শুরু হয় এবং এর ওপর শুরু হয় পুং ও স্ত্রী হরমোনের ক্রিয়াকলাপ। এর ফলে যে যৌনাঙ্গের বৈশিষ্ট্যগুলি দেহে প্রতিভাত হয় একে আমরা বলি প্রাথমিক বা মুখ্য যৌনতার বৈশিষ্ট্য এবং বয়ঃসন্ধিকালে এই যৌনতার বৈশিষ্ট্য পুনর্বার শক্তিসঞ্চারিত হয় যাকে আমরা বলি দ্বিতীয় বা গৌণ যৌনতার বৈশিষ্ট্য। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হরমোন-এর পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্তি হওয়ার জন্য ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে এবং প্রায় সব ক্ষেত্রে হরমোনের ক্রিয়াকলাপ নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।
এখন প্রশ্ন আমাদের জনসংখ্যায় কি পরিমাণে এই ধরনের সমস্যা রয়েছে। এককথায় এর উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল। কারণ আগেই বলেছি কলঙ্কিত হওয়ার সঙ্কোচে অনেকেই মুখ খুলতে চায় না। সুতরাং এই সমস্ত মনের গোপন কথা জানা সম্ভব হয় না। আর শুধুমাত্র ব্যক্তির আচরণ দেখে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্পূর্ণ অনুচিত। তবে সাধারণভাবে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে এই সমস্যা যা দেখি তা বেশি নয়; কিন্তু তা চোখে পড়ে। ব্যক্তি এই সমস্যাটি সংশোধন করতে পারে কিনা এই বিষয়টিও সম্পূর্ণ ভালোভাবে জানা যায় না। প্রথমত, ব্যক্তি যদি বিষয়টি সমস্যা মনে করে তাহলে হয়তো এর সমাধানের রাস্তা খুঁজবে; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি একে সমস্যা বলে মনে করে না, তাই এ ব্যাপারে সমাধানের কথাও ভাবে না। তবে যারা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করে থাকেন তাদের বক্তব্য ব্যক্তি চাইলে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। এই সমস্যার উৎস অংশত জৈবিক, অংশত পারিবারিক-সামাজিক জীবনচর্চা সম্পর্কিত এবং অংশত এই দুই শর্তর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াজনিত। যেমন চোখের সামনে এই ধরনের মানুষজন দেখলে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কারও এমন ধরনের যৌনাচরণগত দৃষ্টিভিঙ্গী বিকশিত হতে পারে। আবার ব্যক্তির জৈবিক দিক থেকে কোনো অসম্পূর্ণতা বা দুর্বলতা এই ধরনের আচরণের অভিমুখে ঠেলে দিতে পারে। তবে দেখা গেছে জৈবিক দিক থেকে জিনগত ও হরমোনের প্রভাব মস্তিষ্কে যৌনাচরণগত অগ্রাধিকার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিপরীত লিঙ্গতা আমাদের পারিবারিক-সামাজিক দৃঢ় প্রথা, কারণ এই প্রথার সঙ্গে নির্ভর করে রয়েছে প্রধানত প্রজাতি সংরক্ষণ। এই কারণে দেখা যায় আমাদের পরিবার ও সমাজ সমকামিতা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে থাকে। এর নৈতিক ও আইনগত দিকটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। (যদিও বর্তমান বিশ্বে কোনো কোনো রাষ্ট্র সমকামি বিবাহকে আইনসিদ্ধ করেছে।) ফলে কোনো ব্যক্তিকে যদি এইপ্রকার যৌনাচরণগত দৃষ্টিভঙ্গী সারা জীবন বজায় রাখতে হয় তাহলে তাকে এই বিপরিত লিঙ্গের যৌনাচরণ সংক্রান্ত সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গী এর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে টিকে থাকতে হবে। যতদিন না সমাজ সহজভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নিতে পারছে ততদিন ব্যক্তিকে এই বিষয়ে যথেষ্ট হেনস্থা সহ্য করতে হবে। কিন্তু সমাজকেও এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে রাখলে চলবে না। নাই বা হলো তারা আর পাঁচ জনের মতো ‘স্বাভাবিক’, ওরা না হয় ‘ব্যতিক্রম’ হয়েই বাঁচুক।
লেখাটি পরে অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ।
তবে মূল বিষয়গত আলোচনা যৌনাচারকে ঘিরেই। একটি মানুষের সঙ্গে আরেকটি মানুষের প্রেমের জায়গাটিকে তাদের আকাঙ্ক্ষার সমলয়নের মধ্যে দিয়েই দেখা উচিৎ। সেখানে প্রেম কী তা নিয়ে কিছু কথা থাকলে ভালো হয়। সাইকোসোমাটিক angle থেকে একজন মানুষের সঙ্গে আরেজন মানুষের সম্পর্ক ধরলে হয়তো আরও একটু গভীরে আলোচনা হতে পারে । সেখানে sexual orientation এর ব্যাপারটা জড়িয়ে যাবে। দুজন সমকামী মানুষ যৌন চাহিদা পূরণ করবার জন্য কেন আন্দোলন করবে? সার্ত্রে আর সিমন বুভোয়ার সম্পর্কের মতো কেন হবে না সেই সম্পর্ক। মন ও শরীরের চাহিদা desire production এর জায়গা ধরে এগোলে লেখাটি সম্পূর্ণতা পায় আমার মতে। আর এটা কি কোনও ব্যতিক্রমী ব্যাপার? প্রকৃতির বাইরে যেহেতু নয় তাই এটাও তো ন্যচারাল। LGBTQ আন্দোলনের সঠিক দিশা synchronization of desire এর ওপর ভিত্তি করেই হওয়া উচিৎ।