হর্ষ দাশ
একবিংশ শতাব্দীর বিস্ময় :
বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে সর্বত্রই প্রবল প্রচার, মানুষ নাকি মঙ্গল গ্রহে বাসা বাঁধবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নাকি মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে ইত্যাদি অনেক কিছু। কিন্তু এই সমস্ত প্রচারের ফানুসকে আজ চুপষে দিয়েছে, ক্ষুদ্র এক আরএনএ ভাইরাস কোভিদ-১৯, প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বিজ্ঞানের ক্ষমতা তাহলে কোথায়?
কেন বিজ্ঞানের আজ এই দুরাবস্থা:
নিউটনীয় যুগের যান্ত্রিকতার থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত করে আইনস্টাইন নবযুগের সূচনা করেছিলেন, তাহলে সেই বিজ্ঞানের আজ এহেন হাল কেন? এই পশ্চাৎ গতি শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে। যখন কেইনস এবং হোয়াইট মিলে ফিন্যান্স পুঁজির নতুন কাঠামো তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিলো। বস্তুগত দর্শনের সাহায্যে অর্থনীতিকে মার্কস যে স্থানে উত্তরণ ঘটিয়ে ছিলেন, সুচতুর ভাবে কেইনস তার মূলেই আঘাত করেছিলেন, কিন্তু তখনকার মার্কসবাদীরা তা ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। লেনিনের মৃত্যুর পর মার্কসবাদের এই পরাজয় আজ বিজ্ঞানকে এহেন বিপথগামী করেছে।
মার্কসের ভূমিকা কি ছিল :
মার্কসের কাছে দর্শন মানে, মূল্য-পৃথিবীর উল্টানো চিন্তার জগৎকে সোজা পায়ে দাঁড় করানো। মার্কস দর্শন চর্চাকে বিমূর্ত জগত থেকে মূর্ত জগতে টেনে এনে দর্শনের মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন। এটি করতে গিয়ে তিনি দেখান পুঁজিবাদ পৃথিবীটাকে উল্টো করে দেখাচ্ছে, এটাকে সোজা করতে হবে। তিনি দেখান – পন্য, অর্থ ও পুঁজিকেই এই সমাজ জীবন্ত রূপে প্রকাশ করে চলেছে, অথচ মূর্ত শ্রম প্রকৃতির সাথে ক্রিয়া করে মনুষ্য সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। উল্টে শ্রম ও প্রকৃতির মিলনের জগতকে মানুষের চোখের সামনে সর্বোতভাবে হেয় করে চলেছে এ জগত। ফলে পুঁজিবাদে যা সাধারণ ভাবে (appearance) ধরা পড়ে তা কিন্তু বাস্তব (reality) নয়। ফলে আমরা সাধারণ চোখে যে বিজ্ঞানকে দেখছি সে কিন্তু প্রকৃত বিজ্ঞান নয়, সেটি অন্য ধরনের অর্থনীতি। বিজ্ঞান যেহেতু বিমূর্তকে মূর্তে নিয়ে যায়, তাই মার্কস অর্থনীতিতে মূল্যকে কেন্দ্র করে মূর্ত ও বিমূর্ত শ্রমের আবিষ্কার দ্বারা অর্থনীতিকে একটি বিজ্ঞানে রূপান্তরিত করেন কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে। মূর্ত এবং বিমূর্ত শ্রমের জগত দুটিকে আলাদা করে দেখানোর ভেতর দিয়েই সেদিন ছিল প্রকৃত বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ। বিমূর্ত শ্রমই হচ্ছে মূল্য পৃথিবীর আত্মা এই আত্মাকে উপড়াতে গেলে, বিনিময়কে উপড়াতে হবে। কারণ বিনিময় করার জন্যেই শ্রমকে মূর্ত রূপ থেকে বিমূর্ত করতে হচ্ছে, ফলে শ্রমের পরিমাণগত রূপ প্রধান হয়ে শ্রমের গুণগত রূপ অপ্রধান হয়ে গেল। এই বিনিময়কে উপড়াতে গেলে, বিনিময় দাঁড়িয়ে আছে যে শ্রমবিভাজনের উপর তাকেই উপড়ে ফেলতে হবে। তাই বিমূর্তায়নের দর্শন হচ্ছে পুঁজিবাদী দর্শন। বিমূর্ত ভাবে ব্যাখ্যা যতই করা হবে পুঁজিবাদ ততই শক্তিশালী হবে, যতই পুঁজিবাদবিরোধী কথা বলা হোক না কেন।
মার্কসের এই আবিষ্কৃত জায়গাটিকে কেইনস কিভাবে উল্টে দিলেন :
কেইনস মূল্যের সাধারন জগত থেকে মূল্যকে বিচ্ছিন্ন করে একটা ফাঁকা শব্দ বলে অভিহিত করলেন “In his view that is (value) a empty word a myth.The only reality he recognise is market price(p-186 The dialectics of the abstract and concrete in marx’s capital).”
মার্কস দামকে যে মূল্যের বস্তুগত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে ছিলেন, তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে, হেগেলের ন্যায় কেইনস আবার মানুষের চিন্তা জগতের উপর নিয়ে চলে গেলেন। “Keynes insists, for instant, that the interest rate entirely depends on the emotion of the owners of capital and is there for a purely psychological factor” (ibid)।
মূল্যকে নগণ্য করে মুনাফার হারকে পুঁজিপতিদের মানসিক জগতের ব্যাপার বলে ব্যাখ্যা করা হলো। অথচ হেগেলকে মার্কস এইখানেই আটকে ছিলেন, যখন হেগেল মুনাফাকে পুঁজিপতিদের বুদ্ধির খেলা হিসাবে দেখাতে চেয়ে ছিলেন। বস্তুবাদকে গুড়িয়ে দেওয়া হলো কার্যকারণ সম্পর্কেকে বিসর্জন দিয়ে। ফলে মুনাফার যে কারণ অর্থাৎ শ্রম ও শ্রমশক্তির মধ্যেকার যে তফাৎ তাকে গুলিয়ে দেওয়া হলো।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের এই পরাজয়ে কি ঘটলো :
কেইন্সের এই চাতুরতাও বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করল। ১৯২৭ সালে সলভে কনফারেন্সে হাইজেনবার্গরা আইনস্টাইনদের সাথে যে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা ছিল uncertainty প্রিন্সিপালকে কেন্দ্র করে, তা ছিল তখন অমীমাংসিত। অর্থাৎ এতদিনে চলে আসা কার্যকারণ সম্পর্ক রহিত এক বিজ্ঞানের জন্ম দিতে চাইছিলেন হাইজেনবার্গরা, আর আইনস্টাইনরা এর বিরোধিতা করছিলেন। বিতর্কের মীমাংসা না হওয়া সত্ত্বেও এই নিয়মটিকে হাইজেনবার্গরা বিজ্ঞানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন, এই চাপিয়ে দেওয়াটাই এমনি ধুমধাম করে করা হলো যে, যার তলে চাপা পড়ে গেল আইনস্টাইনদের মতবাদ।
কার্যকারণ সম্পর্ক রহিত বিজ্ঞান কেন পুঁজিবাদ চায়:
বিজ্ঞানের বিকাশ হয়েছে বস্তুর উৎপাদনকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ কত আয়েসে বস্তু উৎপাদন করা যায়। বিজ্ঞানের উন্নতিতে পণ্যের মধ্যে শ্রম কমে যায়, ফলে পণ্যের মূল্য কমে যায়, এটা একটা দিক। কিন্তুু প্রকৃতি যেহেতু শ্রম দ্বারা উৎপাদিত নয় তাই প্রকৃতির মূল্য হয় না। কিন্তু একচেটিয়া পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে এই কার্যকারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করে। একদিকে একচেটিয়াভাবে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে, পাশাপাশি প্রকৃতি ও জমির দাম বাড়িয়ে দিয়ে।
তাই পন্যের মধ্যে শ্রমের ও কাঁচা মালের অযাচিতভাবে মূল্য বৃদ্ধি দেখা যায়। তার কারণ আজ একটি পণ্য তৈরি করতে যা খরচ হয়, তার থেকে অনেক বেশি খরচ হয় পণ্যের পিছনে বিজ্ঞাপন জাতীয় খরচে, পণ্যের তৈরির খরচ থেকে এই খরচ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রায় দশগুণ। এই বাড়তি খরচটি একটি অবৈজ্ঞানিক চেতনার জন্ম দেয়। কোন পণ্যের যা বস্তুগত গুণ থাকে, তাকে প্রায় স্বর্গতুল্য করে তোলা হয়। যেমন করোণা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য যে বিজ্ঞাপনগুলি দেখা যাচ্ছে, যার কোনোটিই কার্যকারণ সম্পর্ক মেনে নয়। ঔষুধের জগতে আরও একটি কারণ আছে কার্যকারণ সম্পর্ককে অবজ্ঞা করে চলার। ঔষুধের প্রয়োগে যদি রোগের কারণ উৎপাটিত হয়ে যায় তাহলে রোগ চিরতরে সেরে যাবে, ঔষধের পিছনে বিনিয়োগ মার খাবে। তাই এই অর্থনীতি রোগ নিরাময় চায় না, রোগের উপশম করে।
তাই অঙ্ক জিনের আবিষ্কারককে বলতে শোনা যাচ্ছে ৪০ বৎসর আগে অঙ্ক জিন আবিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও, কেন আজও ঔষধ বেরোয় না এবং বায়োইনফরমেটিক্সের আবিষ্কার থেকেও জানা যায়, মূলত p-53 জিন কাজ করতে পারছে না বলেই ক্যান্সার হচ্ছে, এই কাজ না করার কারণ হচ্ছে প্রকৃতির বৈচিত্র নষ্ট হওয়া, এবং যে কারণে আমাদের শরীরের বন্ধু ব্যাকটেরিয়াদের মৃত্যু ঘটছে। প্রকৃতির জৈব বৈচিত্র ফিরিয়ে আনলে ব্যাকটেরিয়াগুলোর পুনর্জন্ম সম্ভব, তাহলে ক্যান্সার সেরে যাওয়া সম্ভব। আর এটা ঘটলে ক্যান্সারকে ঘিরে যে ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা চলছে তা মার খাবে। তাহলে পণ্য অর্থ ও পুঁজি জীবন্ত থাকতে পারবে না, তাই মানুষকে মৃতপ্রায় রেখে পণ্য, অর্থ, পুঁজির অক্ষকে জীবন্ত রাখা সেটাই আজ বিজ্ঞানের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিজ্ঞাপনে ব্যবহারিত শ্রম ও শক্তি তৈরি করে একচেটিয়া মালিকানা। কিন্তু এই শ্রম ও শক্তিকে পৃথিবীর পরিবেশকে ঠিক করার কাজে ব্যবহার করলে, পৃথিবী সুজলা সুফলা হতো মানুষ রোগের থেকে মুক্তি পেতো।
লিওনটিন ও লেভিন কি বলছেন:
“Since the major breakthrough of quantum physics in 1920’s and 1930’s and discovery of random mutation as an evolutionary force, people have been asking whether the world is determinate or random……. Randomness has been associated with lack of causality, a lack of purpose, and the existence of freewill. It has been invoked as the negation of lawlessness and therefore of any understanding of society becomes a justification of reactionary passivity. (Biology under the influence -dialectical essays on Ecology agriculture and health).”
scientific law-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল random মতবাদকে সামনে এনে randomnessকে বায়োলজিতে প্রবেশ করানো হলো, আর মানুষকে শুধুমাত্র জৈবিক হিসেবে দেখে সমাজ ও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। তারপরে তাঁরা দেখালেন- বিজ্ঞানকে টেস্টের জগতে প্রয়োগ করা হলো, কিন্তু চিকিৎসার বিষয়টিকে সেই পুরনো পন্থায় ফেলে রাখা হলো। ” These advances however conists in greatly improved methods for examining the state of our insides, of remarkable advances in micro plumbing, and of pragmatically determine the ways of correcting chemical imbalances and killing of bacterial invaders.”
টেস্টের জগতের এই বিকাশের সাথে চিকিৎসা জগতের বৈপরীত্যটা খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেন।
“None of these depends on a deep knowledge of cellular processes or an any discoveries of molecular biology. cancer is still treated by gross physical and chemical assault.”
সত্যতা ধরা পড়ে যখন দেখা যায় একদিকে ক্যান্সারের ওষুধ বার করা হচ্ছে না বা প্রকৃতির মেরামতি হচ্ছে না, অন্যদিকে রেডিওথেরাপি, সার্জিক্যাল মেথড এবং কেমোথেরাপির ব্যবহার বেড়েই চলেছে অথচ নিরাময় নেই। কার্ডিওভাস্কুলার ডিসিস, ডায়াবেটিক এবং অ্যান্টিবায়োটিক ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেখানে রোগটা নির্মূল হয় না, বরং মানুষকে একটি যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। অর্থাৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার- অর্থ, পন্য ও পুঁজিকে জীবন্ত করতে হবে অথচ বিজ্ঞানের গতি এটাকে শেষ করে। অর্থাৎ বিমূর্তের শেষ মূর্তের উত্থান ঘটানোই বিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু বিমূর্ত অর্থ বেঁচেই চলবে ক্যান্সারকে বাঁচিয়ে রেখে, এটাকে কি বিজ্ঞান বলা যায়? না বিজ্ঞান এখানে এক অর্থনীতি।
উপসংহারের বদলে :
একই ঘটনা ঘটেছে জিনোম প্রজেক্টকে ঘিরে, যখন মানুষের জিনের মানচিত্র তৈরি হচ্ছিল তখন মালিকানা স্বার্থের জন্য হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টকে বন্ধ করে দেয়া হলো। যেখানে ১০ লক্ষ সংখ্যায় ভাইরাস আছে, মাত্র ২৬০ ভাইরাসকে আমরা জানতে পেরেছি। মানুষকে এইরূপ অন্ধ রেখে করোনার জগতে কে নিক্ষেপ করল? বিজ্ঞানকে কে উল্টে দিয়েছে?
Ba khub valo laglo lekha.
Thank you for your comments