সন্তোষ সেন
হাথরাস
হিন্দি সাহিত্যের পাঠকদের কাছে হাথরাস নামের জায়গাটির সম্মান ছিল হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গকৌতুক লেখক “কাকা হাথরসী”র জন্মস্থান বলে। সেই হাথরাস আজ খবরের শিরোনামে- দেশজুড়ে আলোচিত, প্রতিবাদ প্রতিরোধে মুখরিত। এই হাথরাসে উনিশ বছরের দলিত কন্যার ধর্ষিত ছিন্নভিন্ন শরীরটা পনেরো দিন লড়াই করে রণে ভঙ্গ দিল ২৯ শে সেপ্টেম্বর। আর দেরী করেনি “রাম-রাজ্যের” পুলিশ। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সমস্ত অন্যায় কুকীর্তি অপরাধ ঢাকতে সকলের চোখের আড়ালে নির্যাতিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হলো। বেটিকে শেষবারের জন্য বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মা-বাবার আকুতিকে পাত্তা দেওয়ার কথা মনে হয়নি “বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও” স্লোগানের কর্ণধারদের।
কী “ভুল” ছিল তরুণী ও তার পরিবারের? উত্তর একটাই। তারা দলিত। উঁচুজাতের ঠাকুর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তারা মুখ খুলেছেন, ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। এত বড় “ভুল ও সাহসকে” কি করেই বা মেনে নেবে পুলিশ প্রশাসন? তাই পুরো সমাজকে, দেশের মানুষকে চিৎকারে আবারও জানিয়ে দেওয়া হল দলিত- আদিবাসী- মুসলিম রমণীরা সমাজের কীট। শুধুমাত্র পুরুষদের (বলা ভালো উচ্চবর্ণের পুরুষদের) ভোগের সামগ্রী, তাদের যৌন লালসা মেটানোর দায় তো ওদের ওপরেই বর্তায়। নিচুজাতের মেয়েদের ধর্ষণ, এমনকি প্রমাণ লোপের জন্য খুন করে দেওয়ার অধিকার রয়েছে ঠাকুর— সম্প্রদায়ের। এ আর এমন কি? আর ওদের এই মহান অধিকারের প্রতিবাদ করলে কেটে নেওয়া হবে জীভ, যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে লোহার রড, ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হবে সারা শরীর।
শুধুই কি উত্তরপ্রদেশ?
বৃহত্তম গনতন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষে নারী নির্যাতন, নারীবিদ্বেষ, ধর্ষণ-খুন তো আর হাথরাস বা উত্তরপ্রদেশ দিয়ে শুরু নয়, শেষও বোধহয় নয়। তাই এর পর পরই ঘটে বলরামপুর ও ভাদোহির ঘটনা। সেইসব ক্ষেত্রেও গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের মহিলাদের।
এর আগে কাঠুয়ার আট বছরের মুসলিম শিশুটিকে মন্দিরের মধ্যেই পুরোহিত, তার সাঙ্গোপাঙ্গ আর পুলিশ বাহিনী বারংবার গণধর্ষণ করে মেরে ফেলেছিল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। সমাজজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া নারী বিদ্বেষের প্রবল জোয়ারের সাথে যোগ হয়েছিল মুসলিম মেয়েদেরকে ধর্ষণ করার উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতি। তাই আমরা দেখি- ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তো অনেক দূরের কথা। বরং এই হিংসা, প্রবল নারীবিদ্বেষ, জাতি-বর্ণ বিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষের সংস্কৃতিকে জল বাতাস দিয়ে পুষ্ট করতে বিজেপির নেতা ও ভক্তকূল জাতীয় পতাকা হাতে সোচ্চারে মিছিল করে। বলে- এটাই হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতির পরম্পরা। দুঃখের বিষয় অনেক মহিলাও সচেতন বা অসেচতনভাবে সামিল হয়ে যাচ্ছেন এই মিছিলে।
একই ঘটনা আরও ভয়াবহতার সাথে দেশের মানুষ বিস্ময়ে দেখলেন উন্নাওয়ের ঘটনায়। নির্যাতিতা কিশোরীকে চরম লাঞ্ছনা ও রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল বারেবারে। উন্নাওতেই আর একটি ধর্ষণের ঘটনায় জামিনে মুক্ত হওয়ার পর অপরাধীরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল মেয়েটিকে। তারপর হায়দ্রাবাদে ২৬ বছরের এক মেয়েকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। আবার বিহারের বক্সারে এক মহিলাকে গণধর্ষণ করে- গুলি করে- জ্বালিয়ে দেওয়া হয় দেহ। এই ধরাবাহিকতায় আবার উত্তরপ্রদেশ। ১৫ সেপ্টেম্বর হাথরাসের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করলেন এবার বরাবাঁকি জেলার সাতরিখে। ধর্ষণ-খুনের মিছিল লম্বা থেকে লম্বাতর হচ্ছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণ করে হত্যা করার ধারাবিবরণী দিতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। বরং সরকারি তথ্য কি বলছে তা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
নারী নির্যাতনের নির্মম পরিসংখ্যান
এ পোড়া দেশে প্রতি সতেরো মিনিটে ঘটে যায় অন্তত একটি নির্মম ধর্ষণের ঘটনা। “ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর নথি বলছে ধর্ষণ করে খুনের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে ছিল ২২৩, আর ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১। তবে বাস্তব চিত্রটা আরো ভয়াবহ। “জাতীয় স্বাস্থ্য জরিপ” অনুযায়ী- আশি শতাংশ মহিলা ধর্ষণের কথা স্রেফ চেপে যান। সম্মানহানি, কটুক্তি, সামাজিক বয়কটের ভয়, লোকলজ্জা তো আছেই। আবার অভিযোগ জানালে পুলিশের হয়রানি, এমনকি মহান ধর্ষকদের দ্বারা খুন- লোপাট হয়ে যাওয়ার ভীতিও কাজ করে এর পেছনে। আর অভিযোগ যারা করেন না, তাদের মধ্যে দলিত-ব্রাত্যজন-আদিবাসী- মুসলিমসহ সমাজের প্রান্তিক মহিলাদের সংখ্যা সব থেকে বেশি।
বিকৃতিটা কোথায়?
হিন্দু ধর্মে বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ধর্মে ও তার ধারক-বাহকদের রক্তে মিশে গিয়েছে এক সংস্কৃতি- যার নাম প্রবল নারীবিদ্বেষ, নারী হিংসার সংস্কৃতি। এই মনুবাদী সংস্কৃতির মূল কথা- মেয়েরা সংসারের দায়িত্ব সামলাবে, পতিসেবা করবে নিপুন সুচারুভাবে। লোভী-লোলুপ- যৌন পিপাসু পুরুষদের ভোগ্য হওয়ায় তো নারীদের পবিত্র কর্তব্য। নরকের কীট -আমাদের “অর্ধেক আকাশ”। তাই তো মহিলারা, এমনকি ব্রাহ্মণ পরিবারের মহিলারাও পুজো করার বা পইতে ধারণ করার অধিকারী নন। এই সংস্কৃতি ও নারী বিদ্বেষ, নারী হিংসার পক্ষে প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের পুরাণ ধর্মগ্রন্থ সহ একাধিক দলিল দস্তাবেজে। আর বর্তমানে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতা মন্ত্রী পারিষদ তো মেয়েদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। দুবেলা নিয়ম করে তারা গাল পাড়েন মেয়েদের বিরুদ্ধে। মেয়েদের স্বভাব চরিত্র, পোষাক, চলন- বলন নিয়ে তাদের কটূক্তি ও “সুপরামর্শ” আধুনিক সভ্য সমাজের সমস্ত মাপকাঠিকে ছাড়িয়ে এক চূড়ান্ত ঘৃণ্য ও হিংসার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে। তাদের মতে- মেয়েরাই যত নষ্টের গোড়া, সুতরাং—–।
পুঁজির বিকাশ, অধিক উৎপাদন, সস্তা শ্রমের বাজার তৈরি এসবের হাত ধরে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশেও মেয়েরা আজ অনেকটাই ঘর থেকে বেরিয়ে কর্মজগতে সামিল হয়েছেন। পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শারীরিক- মানসিক শ্রম এমনকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে আসছেন। যদিও পুঁজিবাদের পচা-গলা সংস্কৃতি নারীকে পণ্য, ভোগ্য বস্তু হিসেবেই হাজির করেছে সমাজের কাছে। পুরুষতান্ত্রিকতা বা পিতৃতান্ত্রিকতাও সমান দায়ী এই কাজে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার আছে তার শ্রম, এমনকি ‘শরীর’ বিক্রি করা বা না করার। যদিও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অসহায় মহিলাদের কাছে “না বেচার” অধিকারটুকুও থাকেনা। এই আলোচনা বিশদে হতে পারে অন্য পরিসরে।
ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণের হিন্দু সংস্কৃতি কি শেখায়
এই সংস্কৃতি মেয়েদের সম্মান করতে শেখায় না, তাদেরকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখায় না। নারীরা শুধুই ভোগ্যবস্তু, পুরুষের যৌন লালসা পরিতৃপ্তি ও সন্তান ধারনই তাদের একমাত্র কর্তব্য। এই সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিষবৃক্ষের গোড়ায় সুচারুভাবে জল সিঞ্চন করে চলেছে বিজেপি, আরএসএস ও তাদের বহুবিধ শাখা সংগঠন। তাই সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নারী নির্যাতন, বধু হত্যা, ধর্ষণ- খুনের এক অবক্ষয়ী ও সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি। ধর্ষকদের সমর্থনে মিটিং মিছিল সভা চলছে বুক বাজিয়ে সগর্বে সদর্পে। শুধু উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, ছত্রিশগড়ে নয় সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এক প্রবল নারীবিদ্বেষ। আমাদের রাজ্যও এর বাইরে নয়। তবুও একটা বিষয় খুব স্পষ্ট- ধর্ষকদের পক্ষে, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের পুরুষদের সমর্থনে এবং তাদেরকে বাঁচানোর পক্ষে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন- এমনটা খুব একটা চোখে পড়ে না। এখানেই অন্যদের সাথে আরএসএস পন্থীদের এক বড় ফারাক।
আমরা দেখেছি শবরীমালা মন্দিরে ঋতুবতী মেয়েদের প্রবেশের অধিকারের বিরুদ্ধে সরাসরি দাঁড়িয়ে পড়ে প্রবল নারীবিদ্বেষ পোষণকারী দল ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। সমাজের সর্বস্তরে মহিলাদের উপর বিদ্বেষ-নির্যাতনের ধারাটিকে সুকৌশলে পুষ্ট করা হচ্ছে। তাই সুশান্ত মৃত্যু-রহস্যের নেপথ্যে ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে চব্বিশ ঘন্টা ধরে বাজারী সংবাদমাধ্যমগুলো রিয়া চক্রবর্তীদের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য চক্রান্তে শামিল হয়ে পড়ে। যদিও মহামান্য আদালত সমস্ত অভিযোগ বিচার করে স্পষ্ট রায় দেন-” রিয়া মাদক পাচার চক্রে জড়িত এমন প্রমাণ মেলেনি। তিনি আর্থিক বা অন্য কোন লাভের জন্য কাউকে মাদক সরবরাহ করেন নি। রিয়ার কোন অপরাধের পূর্ব ইতিহাস নেই”। তাহলে কেন্দ্রীয়
গোয়েন্দা সংস্থা এবং সাথে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে রিয়াকে অপমানিত- কলঙ্কিত করার যে খেলা চলল দীর্ঘদিন ধরে, তা কি রিয়া একজন মহিলা এই অপরাধেই? দীপিকা পাড়ুকোনও ওদের নিশানায়। মূল অপরাধ তিনি JNU’ র ছাত্র ছাত্রীদের বিক্ষোভের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সর্বোপরি দীপিকা একজন মহিলা এবং ভারতীয় মহিলা।
মহান “ধর্মগুরু স্বামী চিন্ময়ানন্দ” এর লাগাতার নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও প্রাণে মেরে ফেলার হুমকির বিরুদ্ধে অভিযোগকারিনী ছাত্রীর দশ বছর পর অভিযোগ তুলে নেওয়া কীসের ইঙ্গিত বহন করে?
সমাধান কোন পথে?
সার-ওষুধ-জল দিয়ে বিষবৃক্ষের লালন পালনের যে রাজনীতি-সংস্কৃতি চলছে সারা দেশ জুড়ে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে সমস্ত সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি মানুষকে। পুরুষদের সাথে মহিলাদেরও হাত লাগাতে হবে এই কাজে। যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সারা দেশজুড়ে। এমনকি প্রতিবেশী বাংলাদেশেও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে পড়ছেন মায়েরা বোনেরা। উচ্চবর্ণীয় তকমা ছুঁড়ে ফেলে বেশ কিছু মহিলা এবং সাংবাদিক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সজোরে প্রতিবাদে পা মিলিয়েছেন, যা বেশ আশাপ্রদ। আসলে দলিত মুসলিম আদিবাসী সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আজ নারীবিদ্বেষ- নারী নির্যাতন নিয়ে শঙ্কিত আতঙ্কগ্রস্ত। তাই আমাদের বুঝে নিতে হবে নারীবিদ্বেষের প্রবল পরাক্রমশালী শক্তিগুলিকে ও তাদের এই ঘৃণ্য প্রয়াসকে।
দাবি উঠুক- আঁধার মেঘে ঢেকে থাকা “অর্ধেক আকাশ” নয়। পরিষ্কার নির্মল স্বচ্ছ “অর্ধেক আকাশের”, যে আকাশের প্রতিটি নারী আমার সহকর্মী সহযাত্রী বন্ধু। নারী বা পুরুষ নয়- দেখতে ও ভাবতে শিখি মানুষ হিসেবে। বড় হয়ে উঠুক সহমর্মিতা সহযোগিতা মানবিকতা। নিজের পরিবার থেকেই শুরু হোক এই শিক্ষা। ভাইকে বা পুত্র সন্তানকে পুরুষ নয়, মানুষ করে গড়ে তোলার দায়িত্বে এগিয়ে আসুন বোনেরা মায়েরা। সমাজ সচেতন সংবেদনশীল মানুষরা গভীর চর্চায় মাতুন- প্রবল নারীবিদ্বেষের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে সমূলে উচ্ছেদ করার মানবিক ভাবনায়। আমাদের ভাবনা উদ্দ্যোগ ডালপালা মেলে বিকশিত হোক সমাজজুড়ে বিশ্ব মানবিকতায়।।
তথ্য সূত্র :
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।
ই-মেল: santoshsen66@gmail.com