কেভিন কার্টার ও আজকের মিডিয়া মনস্তত্ত্ব

পোস্টটি দেখেছেন: 31 শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। সেই সুদর্শন নাদুসনুদুস সীমানা পেরোনো নিউজ অ্যাঙ্কর হাসিমুখে বিতর্ক সভা সঞ্চালনার কাজটি করছেন। সামনেই বাংলায় ভোট। ভোট নিয়ে বাংলায় জবরদস্ত খেলা হবে, একথা ঘিরে অলিগলি পাড়া এখন সরগরম। অতএব এই তো সর্বোত্তম সুযোগ। বিতর্কসভায় ভিন্ন মতাদর্শের নেতা, সুযোগসন্ধানী আমলা, সেলেবল সেলেবরা এসেছেন। সকলেরই ইস্তিরি করা জামাকাপড়। […]

kevin carter

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। সেই সুদর্শন নাদুসনুদুস সীমানা পেরোনো নিউজ অ্যাঙ্কর হাসিমুখে বিতর্ক সভা সঞ্চালনার কাজটি করছেন। সামনেই বাংলায় ভোট। ভোট নিয়ে বাংলায় জবরদস্ত খেলা হবে, একথা ঘিরে অলিগলি পাড়া এখন সরগরম। অতএব এই তো সর্বোত্তম সুযোগ। বিতর্কসভায় ভিন্ন মতাদর্শের নেতা, সুযোগসন্ধানী আমলা, সেলেবল সেলেবরা এসেছেন। সকলেরই ইস্তিরি করা জামাকাপড়। পরিচ্ছন্ন চাহুনি। সেখানেই এসেছেন এমন একজন নেতা যে কিনা প্রকাশ্যে দাঙ্গাবাজদের দেদার উস্কানি দেন। তিনি চান মানুষ তাদের কল্পনার জগতে তৈরি করা হিন্দু দেবদেবীর উপাসনায় দিন কাটাক। বাস্তব জগতে তাদের অন্ন, কর্মসংস্থান, শিক্ষাদীক্ষা চুলোয় যাক। তিনি জনসমক্ষে মনীষীদের সম্পর্কে ভ্রান্ত এবং উসকানিমূলক মন্তব্য করছেন সভায় সভায়। তিনি সর্বান্তকরণে চান মানুষ পদার্থবিদ্যা না শিখে cow science নিয়ে গবেষণা চালাক দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সকল প্রচার করার মুহূর্তগুলিতে ভিতরে ভিতরে সেই নেতা নিশ্চয়ই হাসেন, ভাবেন, এই তো আমার কাজ। একথা মানতেই হবে যে, এ হেন প্রচারের কিছুমাত্র তিনি নিশ্চয়ই মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করেন। যদি না করেন তাহলে নির্ঘাত বিশেষ এক উদ্দেশ্যে, কোনও উপরওয়ালার কড়া নির্দেশের পালন তিনি করছেন বিশেষ রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতায়। কিন্তু আসল কথা হল, আর যাই হোক, এই নেতা মানুষটি হাড়ে হাড়ে বোঝেন যে প্রচার তিনি উচ্চস্বরে বেপরোয়া ভঙ্গিতে করে বেড়াচ্ছেন তা আখেরে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে। দুই ভাই, দুই বন্ধু, বাবা ও ছেলের মধ্যে একে অপরের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। তিনি জানেন, তার প্রচারে ও প্ররোচনায় মানুষ দিনদুপুরে খুন হয়। মানুষ মানুষকে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারে। মাথার ঘিলু টিলু বার করে দিতে পারে শাবল টাবল দিয়ে। এই ধরনের মানসিক কারবার পুষে রাখা এই নেতা সীমানা পেরোনো চ্যানেলের স্টুডিওতে আমন্ত্রিত হন। গাড়ি হেঁকে বডিগার্ড নিয়ে আসেন এবং দাপটে নিজের বক্তব্য রাখেন। হাসিমুখে সহবক্তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করেন। চা টা খান। পারিশ্রমিক নিয়ে ফিরে আসেন ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে। তারপর আবার ঘুম থেকে উঠেই ভরপেট জলখাবার খেয়ে সেই ভয়ংকর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ঢুকে পড়েন।

 নিউস চ্যানেলটিতে বিতর্ক সভা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সেই সঞ্চালক কি জানেন সেই নেতার উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বা তার ভবিষ্যতের মারাত্মক পরিকল্পনা। আলবাত জানেন। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এইরকম যে, সেই সাংবাদিক সঞ্চালক কেবলমাত্র একটি বিতর্ক সভার আয়োজন উপলক্ষে, চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একমত হয়ে চ্যানেলটিকে নিউস ইন্ডাস্ট্রিতে সবার আগে পৌঁছে দেওয়ার  তাগিদে, আরও অনেক বেশি মুনাফা করার অনুপ্রেরণায় একজন বিরোধী দলনেতার মোড়কে এক দাঙ্গাবাজ, শয়তান খুনীর সঙ্গে হাস্যময় বার্তালাপে জড়িয়ে পড়েন। আজকাল বাংলা তথা গোটা ভারতের মিডিয়া সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এইসব ফেনোমেনা। কত সহজ, কত সাবলীলভাবে এই মিডিয়া সংস্কৃতি রমরমিয়ে পাল্লা ভারী করছে দিনের পর দিন। এই সঞ্চালকগণ কখনোই ধারালো প্রশ্ন করেন না নেতা আমলাদের বিরুদ্ধে। এমন প্রশ্ন যা সিনেমাতে স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে টলিউডের হিরোরা ভিলেনদের আকছার করে থাকেন। যদিও সদলবলে সেইসব হিরো হিরোইনরা শিড়দাঁড়া দুরমুশ করে বাস্তবে নিজেদেরকে বিকিয়ে দিচ্ছেন ভিলেনদের দলে। এইসব কদর্য ব্যাপারস্যাপার নিয়ে প্রথম সারির সিংহভাগ মিডিয়ার বেতনভুক সাংবাদিকরা সোজাসাপটা প্রশ্ন মোটেই করেন না। গভীরে গিয়ে এই জনবিরোধী কাজ কারবার এবং হিরো হিরোইনদের দেখানেপনা, তাদের জীবনের নোংরা দিকগুলো সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন না। তুলে ধরলেই কর্পোরেট আর রাষ্ট্রের যোগসাজশ উদোম হয়ে যাবে জনতার কাছে। মিডিয়া তা ভুলেও করবে না। কৌশলে কথার মারপ্যাঁচে ভোট এবং মুনাফা, এই দুয়ের প্রচণ্ড মিথোজীবীতাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হাসিমুখে বার্তালাপ, বিভ্রান্তিকর বিতর্কসভার আয়োজন ভণ্ড নেতা অভিনেতাদের স্টুডিওতে এনে। এ এক মারাত্মক অপসংস্কৃতিময় জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ মিডিয়া কর্মসূচি। মূল উদ্দেশ্য গ্রাফিক্স এবং সস্তা শিল্পের যুগলবন্দীতে লজ্জার মাথা খেয়ে সীমানা পেরিয়ে খবর করা এবং প্রতিবাদের কথা বলে মুচকি হেসে কর্পোরেট তোষামোদ। এই হল সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে নিজেদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনকে সুরক্ষিত রাখার সংস্কৃতি।

 এই বিপন্ন সময়ে আশার কথা, মেন স্ট্রিম মিডিয়ার উল্টোদিকে কিছু ছোটোখাটো খবরের চ্যানেল দেখা যাচ্ছে যেগুলি বাস্তবকে চোখের সামনে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলন এই দুই বিপরীতমুখী মিডিয়া সংস্কৃতিকে সামনে এনেছে। নির্ভিক সাংবাদিকেরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই এই কাজ করছেন। চ্যালেঞ্জ করছেন রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের পা চাটা মিডিয়াকে খুল্লামখুল্লা। তাঁদের সকলকে কুর্ণিশ।

কেভিন কার্টার
কেভিন কার্টারের তোলা সেই ছবি। ক্ষুধার্ত শকুন ও কঙ্কালসার শিশু। ছবিটির জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্তে ক্রমশ নখ দাঁত বার করা এই কঠিন সময়ে কমবেশি সবার কপালেই ভাঁজ। অনেকেই সন্ত্রস্ত। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে শান্তির জীবন। প্রায় সকল দৈনন্দিন লেনদেনেই এক ভয় মেশানো অনিশ্চয়তা। এখান থেকে মুক্তির পথ দেখাতে বিপুল ভূমিকা কিন্তু নিতে পারে  মিডিয়া। কারণ মিডিয়ার লম্বা হাত কত কম সময়ে শহর থেকে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিপুল সংখ্যক জনতার বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারে মিডিয়া পরিবার। হ্যাঁ, কর্পোরেট আওতায় থেকেই এই কাজ হতে পারে। দু একটি মেন স্ট্রিম মিডিয়া চ্যানেল সে কাজ করছে বইকি।

এবার একটু পেরিয়ে আসা সময়ে পাশ ফেরা যাক। পুলিৎজার প্রাইজ পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার সেই চিত্রসাংবাদিক। নাম কেভিন কার্টার। তাঁর তোলা ১৯৯৩ সালের সুদানের দুর্ভিক্ষের সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া ছবি রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। খিদের জ্বালায়, অনাহারে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে বছর তিনেকের এক পেটমোটা শিশু। যেন একরত্তি কঙ্কাল। পেছনেই একটা শকুন। শিশুটির মৃত্যুর অপেক্ষায়। অভুক্ত, শীর্ণকায় আফ্রিকান শিশু অবশ্যই লোভনীয় ‘সাবজেক্ট’। কেভিন সেই ভয়াবহ মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করেছিলেন। পেশাদার সাংবাদিকের আবেগপ্রবণ হওয়ার অবকাশ থাকে না। কারণ সেখানে জীবনের থেকে পেশার গুরুত্ব বেশি। দাঙ্গা, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা— খুব সামনে থেকে দেখেছিলেন কেভিন। কিন্তু ওই ছবিটা তোলার পর গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠেছিল একটা কষ্ট। চোখে জল এসেছিল। মানুষকে দিনের পর দিন অকারণে মরতে দেখে কেভিন এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে ছবি তোলার পর সেই শিশু মেয়েটির খোঁজ নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি তাঁর। সে কোথায় গেল, জানার চেষ্টাও করেননি। স্বভাবতই কেভিন শিশুটিকে ওই অবস্থায় ফেলে কী ভাবে চলে এলেন, প্রশ্ন তুলেছিলেন সাধারণ মানুষ। অপরাধবোধ আর অনুতাপের চোরকাঁটায় ভিতরটা রক্তাক্ত হয়েছিল কেভিনের। ক্ষুধার্ত শকুন আর সেই কঙ্কালসার শিশুটি যে শান্তি দিচ্ছিল না তাঁকে! গভীর অবসাদে ডুবে শেষে  আত্মহত্যা করেন কেভিন। গাড়ির ধোঁয়া বেরনোর নলের সঙ্গে আর একটি পাইপ জুড়ে গাড়ির জানলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছিলেন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইডে মৃত্যু।

তাঁর সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, “আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। জীবনের যন্ত্রণা সব আনন্দকে এতটাই ম্লান করে দেয় যে, আনন্দ বলে কিছু অনুভব করা যায় না। আমি অবসাদে ডুবে গিয়েছি। চারপাশে বড় দৈন্য… খুনের পর খুন, লাশের পাহাড়, মানুষের রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা, অভুক্ত ও জখম শিশু, বন্দুক-পাগল উন্মাদ, খুনি পুলিশ আর জল্লাদের দল যেন আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি চললাম বন্ধু”।

আসলে কেভিন বুঝেছিলেন সেই শিশুটির জন্য কিছু করতে না পারা তো সেই বেপরোয়া শকুন হওয়ারই শামিল। কেভিন ছিলেন সংবেদনশীল প্রকৃত মানুষ। যথার্থ মানুষ বলেই আত্মগ্লানি, তীব্র  সামজিক দায়বোধ।

আজকের মিডিয়ার সাংবাদিকরা কেভিনের কথা   জেনেও সচেতনভাবে তাকে উপেক্ষা করেই খবরের ব্যবসায় দু পয়সা কামিয়ে নিতেই ব্যস্ত সেকথা জোর দিয়ে বলাই যায়। মিডিয়ার মশলা খাবার হজম করে, চোখে ঠুলি পরে, অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন কত বুদ্ধিজীবী মানুষ! ভাবলে অবাক হতে হয়! সংস্কৃতির চেহারা বুঝি এমনও হয়! তবু এসবের মধ্যেই আশা করা যায় যে, নেতাদের সঙ্গে খোশমেজাজে গুফতগু করার পর আত্মগ্লানিতে চুরমার হয়ে দু পয়সার চাকরিকে লাথি মেরে চলে যাবেন হয়তো বা কেউ কেউ। প্রকৃত সাংবাদিকতার জায়গা তো তৈরি হচ্ছে। সেদিকের দলটাকে ভারী করে দেওয়ার গতি লক্ষ্য করা যাবে নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে।

 যেসকল ব্রেকিং নিউজ সাংবাদিক প্রাণের থেকে পয়সাকে বেশি গুরুত্ব দেন, বাস্তবকে আড়াল করে ভয়ংকর ভাবের জগতে মানুষকে অবলীলায় ঠেলে দেন, নোলা বার করা চাটুকারিতা আজ যাদের দৈনিক অভ্যাস তাদের সকলকে বলছি, এখনও আছে সময়, সাংবাদিক তো পরে, আগে তো আপনি  মানুষ।

লেখক পরিচিতি:

লেখক তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী। ছোট গল্প, সমাজ- বিজ্ঞান, পরিবেশ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে নানান নিবন্ধ লেখেন নিয়মিত।

Contact:

bhattacharya.sankhadeep@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top