এ সময়ের দুধ-মা: মাতৃত্ব, আধুনিকতা ও দেহের রাজনীতি

মাতৃত্ব—যাকে আমরা প্রায়শই প্রকৃতির দান বা ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে ভাবি—আসলে সামাজিক নির্মাণ। জন্মদাত্রী মা যখন সন্তানকে নিজের দুধ না খাইয়ে অন্য নারীর কাছে সে দায়িত্ব অর্পণ করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে: মাতৃত্বের সীমানা কোথায়? ভালোবাসা ও শ্রম কি আলাদা করা যায়?

breast milk

 

অনিরুদ্ধ দত্ত

সংবাদে প্রকাশ অতিমানবিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য পূর্ণবয়স্করা মাতৃদুগ্ধের সন্ধানে বাজারের ক্রেতা হচ্ছেন৷

“নিজের সন্তান, কিন্তু অন্যের স্তনদুগ্ধে বড় হওয়া”—এই বাক্যে যে দ্বন্দ্ব লুকিয়ে আছে, তা কেবল পারিবারিক নয়, সামাজিকও। দুধ-মা প্রথা যেন এক আয়না, যেখানে আমরা দেখতে পাই সমাজের শ্রেণি, লিঙ্গ ও ক্ষমতার গোপন বিন্যাস। কেউ মাতৃত্ব পায় উত্তরাধিকারে, কেউ দেয় শ্রমে; কেউ ভালোবাসাকে কর্তব্য বলে জানে, কেউ ভালোবাসাকেও বিক্রি করে টিকে থাকে।

 মাতৃত্বের বিভক্ত বাস্তবতা

মাতৃত্ব—যাকে আমরা প্রায়শই প্রকৃতির দান বা ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে ভাবি—আসলে সামাজিক নির্মাণ। জন্মদাত্রী মা যখন সন্তানকে নিজের দুধ না খাইয়ে অন্য নারীর কাছে সে দায়িত্ব অর্পণ করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে: মাতৃত্বের সীমানা কোথায়? ভালোবাসা ও শ্রম কি আলাদা করা যায়?

দুধ-মা এখানে এক সামাজিক চরিত্র—যিনি নিজের সন্তানকে রেখে অন্যের সন্তানকে পোষণ করেন, কারণ অর্থনৈতিক প্রয়োজন তাঁকে তেমনটাই করতে বাধ্য করে। দেহ তখন হয়ে ওঠে জীবিকার উৎস, আর মাতৃত্ব হয়ে পড়ে একটি সেবা—একটি পণ্য।

 ইতিহাসের গর্ভে দুধমা

খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে থেকেই ধাত্রী ব্যবস্থার শুরু এবং তা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দুগ্ধদানের বোতল এবং ফর্মুলা ফুড চালু হওয়ার আগে একজন ধাত্রী বা ‘ওয়েট নার্স’, “যে নারী অন্য ব্যক্তির শিশুকে স্তন্যদান করে” (Davis, 1993, p. 2111), তার ব্যবহার ছিল একটি সাধারণ প্রথা। রোমান সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তারের সময়কালে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৪০০ সালের মধ্যে, পরিত্যক্ত শিশুদের লালন-পালনের জন্য ধাত্রীদের সাথে লিখিত চুক্তি করা হত। এই শিশুরা ছিল প্রধানত অপ্রত্যাশিত কন্যা শিশু, যাদের আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেওয়া হত। ধনী ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সস্তা দাস হিসেবে এই শিশুদের ক্রয় করতেন, এবং ধাত্রীরা—যারা নিজেরাও দাস ছিল—প্রায় তিন বছর ধরে শিশুদের স্তন্যদান করত। চুক্তিগুলোতে ধাত্রী সেবার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ থাকত, যার মধ্যে স্তন্যদানের সময়সীমা, জামা-কাপড় সরবরাহ, বাতির তেল এবং সেবার পারিশ্রমিকও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সময়সীমার মধ্যে, ধাত্রী ব্যবস্থা একটি প্রয়োজনীয় বিকল্প (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০) থেকে বিকল্প পছন্দে (খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৮০০) রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত হয় পছন্দে। তখন থেকে এটি একটি সুসংগঠিত পেশায় পরিণত হয়।  চুক্তি ও আইন তৈরি করা হয়েছিল এই চর্চা নিয়ন্ত্রণের জন্য। মধ্যযুগ ও রেনেসাঁর সময় আপত্তি সত্ত্বেও, ধাত্রী ব্যবস্থা চালু ছিল যতক্ষণ না পর্যন্ত ঊনবিংশ শতাব্দীতে দুগ্ধদানের বোতল চালু হয়। ফলে একটি কার্যকর বিকল্প খাদ্যপ্রদান পদ্ধতি সহজলভ্য হওয়ায়,  পেশা হিসেবে ধাত্রী ব্যবস্থা দ্রুত বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হয়।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে রাজপরিবারে দুধ-মার প্রথা ছিল নিয়মিত। অভিজাত নারীরা নিজেদের দেহ ‘অক্ষত’ রাখার তাগিদে অন্য নারীর স্তন ধার করতেন। ঔপনিবেশিক ভারতে এ প্রথা নতুন রূপ নেয়—জমিদার ও সাহেব পরিবারের বাচ্চাদের জন্য নিযুক্ত হতো গ্রামীণ নারীরা। তারা দুধ দিত, কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি বা মর্যাদা পেত না। তাদের দেহ হয়ে উঠত এমন এক সম্পদ, যার তারা মালিক নয়, বরং ভাড়াটিয়া।

এই ইতিহাসে ‘দুধ’ কেবল শিশুর খাদ্য নয়; এটি শ্রেণি ও জাতিগত শোষণের তরল প্রতীক।

 আধুনিকতার প্রতিশ্রুতি প্রতারণা

আধুনিকতা আমাদের শিখিয়েছে “স্বাধীন নারী”, “বৈজ্ঞানিক মাতৃত্ব”, “স্বাস্থ্যকর বিকল্প” ইত্যাদি ভাষা। কিন্তু এই ভাষার অন্তরালে দেহ ও মাতৃত্বের শোষণ আরও সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছে।

আজ যখন আমরা সারোগেসি, ব্রেস্ট মিল্ক ব্যাংক বা শিশুখাদ্য শিল্পের কথা বলি, তখন দেখছি এক নতুন দুধ-মা অর্থনীতি। এখানে দেহ সরাসরি বিক্রি হয় না, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয় চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও বাজারের মাধ্যমে।

একদা দরিদ্র দুধ-মা নিজের গ্রামের কুটিরে নিজের সন্তানদের জন্য দুধ বাঁচাতে পারতেন না; আজ তাঁর আধুনিক প্রতিরূপ — সারোগেট মা — বৈধ চুক্তির আওতায় সন্তান ধারণ করেন এমন এক সমাজের জন্য, যাদের কাছে মাতৃত্ব কেবল “অধিকার”, শ্রম নয়।

পুঁজিবাদী আধুনিকতা মাতৃত্বকে স্বাধীনতার প্রতীক বানাতে চায়, অথচ সেই স্বাধীনতাকে পণ্যায়িত করে। “আমার শরীর, আমার অধিকার”—এই স্লোগানটি সুন্দর, কিন্তু বাজার তার ভেতরে ঢুকে গেছে নিঃশব্দে, বিজ্ঞাপন ও চিকিৎসা প্রযুক্তির ছদ্মবেশে।নারী যদি বলে “আমার শরীর, আমার অধিকার”—তখন বাজার বলে, “ঠিক আছে, তাহলে তোমার শরীর আমরা ভাড়া নেব।” মাতৃত্ব যদি হয় নারীর স্বপ্ন—বাজার বলে, “আমরা সেটাকে প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব করব—সারোগেসি, ডোনার এগ, ব্রেস্টমিল্ক ব্যাংক, বেবি ফর্মুলা।”

অর্থাৎ, মাতৃত্বকে স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে না দেখে “সার্ভিস” বা “প্রোডাক্ট” হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এইভাবে স্বাধীনতা হয়ে যায় বিক্রিযোগ্য পণ্য, এবং নারী হয়ে ওঠেন এক উৎপাদনযন্ত্র—যিনি গর্ভ, দুধ, বা যত্নশ্রম “সরবরাহ” করেন।বায়োটেকনোলজির উন্নতি এমন এক যুগ এনে দিয়েছে যেখানে মা হতে হলে দেহেরও প্রয়োজন নেই। কৃত্রিম জরায়ু, ল্যাব-নির্ভর নিষেক, জিন সম্পাদনা—সবকিছুই “প্রযুক্তির মাতৃত্ব” সৃষ্টি করছে। এতে নারী যেন আরও “স্বাধীন”!  কিন্তু এই স্বাধীনতা জৈব অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক ভার্চুয়াল মাতৃত্বে রূপ নিচ্ছে।এখানে “মা” আর শরীর নয়, বরং একটি সেবাদানকারী শ্রম ।

 যত বেশি মাতৃত্ব প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে, ততই তা হয়ে উঠছে corporate- motherhood যেখানে মাতৃত্বের প্রতিটি ধাপ বেসরকারি কোম্পানির সেবা হিসেবে বিক্রি হয়।

 মাতৃত্বের রাজনীতি নারীদেহ

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বুর্দ্যু (Pierre Bourdieu) মূলধনের ধারণাকে শুধু অর্থনৈতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর  ভাষায়, শরীর এক ধরনের ‘দেহমূলধন’—যা সামাজিকভাবে ব্যবহারযোগ্য, রূপান্তরযোগ্য ও বিনিময়যোগ্য। দুধ-মা বা সারোগেট মা সেই মূলধনের এক নিখুঁত উদাহরণ। তাদের দেহকে সামাজিকভাবে “প্রয়োজনীয়” করে তোলা হয়, কিন্তু মালিকানা থাকে না তাদের হাতে। বুর্দ্যুর মতে, মানুষের শরীর কোনো নিছক জৈবিক সত্তা নয়; এটি সামাজিকভাবে গঠিত, ব্যবহৃত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই শরীর—তার সৌন্দর্য, শক্তি, লিঙ্গ, যৌনতা, পরিশ্রমক্ষমতা, মাতৃত্ব বা দুধদানের ক্ষমতা—সবই এক প্রকার “মূলধন”, যা সমাজে বিশেষ সুবিধা বা অসুবিধা তৈরি করতে পারে। যেমন:

ক্রীড়াবিদ বা শ্রমিকের শরীর পেশিশক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।  অভিনেত্রী বা মডেলের শরীর নান্দনিক ও প্রতীকী মূলধন হিসেবে বাজারে রূপ পায়। আবার দুধ-মা বা সারোগেট মায়ের শরীর প্রজননক্ষমতা ও স্তন্যদানের মাধ্যমে জৈবিক উৎপাদনের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে—যা সমাজ ও পুঁজির জন্য “বিনিময়যোগ্য”। দেহমূলধনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার রূপান্তরযোগ্যতা।

অর্থাৎ, শরীরের একধরনের সামাজিক বা জৈবিক ক্ষমতাকে অন্য ধরনের মূলধনে রূপান্তর করা যায়— একজন দুধ-মা তার শরীরের জৈবিক ক্ষমতাকে (দুধ উৎপাদন) অর্থনৈতিক মূলধনে রূপান্তর করছেন।

কিন্তু এই বিনিময় স্বাধীন নয়, বরং সামাজিক ও শ্রেণিগত অসমতার ভেতর বাঁধা—যেখানে এক শ্রেণি অন্য শ্রেণির শরীরকে ব্যবহার করে।

মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ বলবে, এটি শ্রমশক্তির চূড়ান্ত রূপ—যেখানে আবেগ, যত্ন, নিদ্রাহীনতা, দুধ—সবই উৎপাদনের উপকরণ।

এভাবে মাতৃত্ব আর স্নেহের প্রকাশ নয়, হয়ে যায় এক “কন্ট্রাক্টেড প্রক্রিয়া” — অর্থাৎ এমন এক দেহরাজনীতি, যেখানে শ্রমিক নারী নিজের অস্তিত্বের জন্য নিজেরই শরীর বিক্রি করেন।

 আধুনিকতার মুখোশ দুধের দ্বন্দ্ব

আধুনিকতা ঘোষণা করেছে: নারীর মুক্তি প্রযুক্তির মধ্যেই নিহিত। গর্ভ ধারণ করা যাবে পরীক্ষাগারে, স্তন্যদান করা যাবে ব্যাংক থেকে, মাতৃত্ব হবে ‘পছন্দের বিষয়’।

কিন্তু এই পছন্দ কাদের? দরিদ্র নারীরা কি এই প্রযুক্তির মালিক, নাকি ব্যবহারযোগ্য সম্পদ?

দুধ-মা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আধুনিকতার কেন্দ্রে—যেখানে মাতৃত্বকে একাধারে শ্রদ্ধা করা হয় ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এমনকি বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও আমরা দেখি, “মায়ের দুধের সমান”—এই তুলনা মাতৃত্বকে বিজ্ঞান ও বাজারের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনে।

 আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের সমাজে “দুধ-মা” প্রশ্ন কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।

নারীর দেহকে মুক্ত করতে হলে, দেহের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মালিকানার প্রশ্ন তুলতে হবে। মাতৃত্বের অধিকার মানে শুধু সন্তান জন্মদানের স্বাধীনতা নয়, বরং নিজের শ্রম ও আবেগের মূল্য নির্ধারণের স্বাধীনতা।

যে সমাজ নারীর শরীরকে প্রযুক্তি ও বাজারের মাধ্যমে শাসন করে, তাকে সত্যিকারের আধুনিক বলা যায় না।

নারীবাদী ও শ্রমিক আন্দোলন আজ যদি দুধ-মার কণ্ঠস্বর শুনতে চায়, তবে তাদের এই প্রথার ভেতর লুকিয়ে থাকা শ্রেণিচরিত্র উন্মোচন করতে হবে। মাতৃত্বকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে, প্রথমে তাকে শোষণ থেকে মুক্ত করতে হবে।

 দুধশ্রেণি মানবতার প্রতীক

দুধ এক আশ্চর্য তরল। এটি একইসঙ্গে জীবনদাতা, বন্ধনসৃষ্টি, আবার সামাজিক বিভাজনের প্রতীক। দুধ-মা প্রথা আমাদের শেখায়, কিভাবে সমাজ ভালোবাসাকেও শ্রেণি অনুযায়ী ভাগ করে নেয়।

তবে এই দুধই আন্দোলনের প্রতীক হতে পারে  যদি আমরা বুঝি যে  মাতৃত্ব কোনো পণ্য নয়, এটি শ্রম ও জীবনের আন্তরিক এক সম্পর্ক। দুধ-মা, সারোগেট মা, ব্রেস্টমিল্ক দাতা আজকের যুগের শ্রমিক, যাদের শরীরের প্রতিটি অংশ বাজারের হিসাবের অন্তর্গত। আধুনিকতা তাদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিই শোষণের নতুন রূপ ধারণ করে।

মাতৃত্ব তাই আজ এক রাজনৈতিক ক্ষেত্র— যেখানে প্রশ্ন কেবল আবেগের নয়, বরং শরীরের মালিকানা ও শ্রমের ন্যায্যতার। যে দিন নারী নিজের দেহের অর্থনীতি বুঝে তার দুধ, ঘুম, শ্রম, ও ভালোবাসাকে পুঁজির হিসাব থেকে মুক্ত করবে সেই দিনই মাতৃত্ব সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হবে। দুধ-মা তাই কেবল অতীতের চরিত্র নয়; তিনি আজকের সমাজেও আছেন, নাম পাল্টে, পোশাক বদলে, চুক্তিপত্রে সই করে। তাঁর দেহে আমরা দেখতে পাই আধুনিকতার প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণা—একইসঙ্গে। এই দ্বন্দ্ব থেকেই শুরু হতে পারে প্রশ্ন: “মাতৃত্ব কাদের জন্য মুক্তি, আর কাদের জন্য শ্রম?” এ প্রশ্নের উত্তর  খোঁজা  হয়ে  উঠুক সমাজ পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top