প্রীতিলতা বিশ্বাস
1913 সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কবির কাছে আমন্ত্রণ আসে সেখানে বক্তৃতা দেবার জন্য। এরকমই আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে 1916-17 সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ জাপানে ও আমেরিকায় তিনটি বক্তৃতা করেন, যা পরে Nationalism নামে ইংরাজিতে একটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর তিনি পৃথিবী ব্যাপী জাতীয়তাবাদ বিরোধী চিন্তাবিদ হিসাবে পরিচিত হন।
ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই—উনবিংশ শতকের শেষ দুই দশকে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের প্রভাবে ঔপনিবেশিক হীনমন্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশপ্রেম ও এক ধরনের জাতীয় গর্ববোধকে লালন-পালন করার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করেন ভারতের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মানুষ। এই তাগিদ থেকেই বুদ্ধিজীবিরা দেশের অতীত আবিষ্কারে ব্রতী হন। অনেক সময় প্রকৃত অনুসন্ধানের পরিবর্তে অজানা অতীতের গৌরবোজ্জ্বল নির্মাণ হতে থাকে। এদিকে ভারতের উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী কারিগরী বিদ্যায় শুধু জার্মানী বা ইংল্যাণ্ড নয়, জাপানের থেকেও পিছিয়ে ছিল। নতুন কোন যান্ত্রিক উদ্ভাবনের কৃতিত্ব তাদের ছিল না। পণ্য উৎপাদনের আধুনিকিকরণের জন্য যন্ত্রপাতি, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো সবই তাদের বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই ভূমিহীন, হত দরিদ্র শ্রেণীর বিপুল জনসংখ্যা বর্তমান ছিল, যা কলকারখানার জন্য সস্তা শ্রমের মজুত বাহিনী হিসাবে কাজ করল। সেই ভাবে দক্ষ শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশ না ঘটলেও এদেশে বুর্জোয়া অর্থনীতির বিকাশ হতে লাগল অনেক দ্রুত। এই ধরনের একটি আর্থ-সামাজিক পরিবেশ জাতীয়তাবাদের ভাবনায় ইন্ধন জোগালো, যার সঙ্গে যুক্ত থাকলো পুজিঁর স্বার্থ।
এই রকম একটি পরিমন্ডলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে আমরা রবীন্দ্রনাথকে প্রথমদিকে যে সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে পাই পরবর্তী বয়কট বা স্বদেশী আন্দোলনে সেটা আর দেখতে পাই না। নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর চিন্তা ভাবনার অসংগতিই এর কারণ। এই সময়ে লেখা তাঁর উপন্যাস ‘গোরা’ তে প্রকাশ পায় রাজনৈতিক মনস্তত্ব, ‘ঘরে-বাইর’ তে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব এবং ‘চতুরঙ্গ’ এ রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্নটি উঠে আসে। এরই মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা তাঁর জাতীয়তাবাদ বিরোধী অবস্থানকে সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত করে তুললো।
খুব সংক্ষেপে আমরা তাঁর লেখা থেকে বুঝে নেবার চেষ্টা করবো ‘নেশন’ কি? পেট্রিয়াটিজম কি? কেন তিনি ন্যাশনালিজম এর বিরোধিতা করেছিলেন এবং ন্যাশনালিজম এর বিপরীতে তাঁর স্বদেশী চিন্তা ঠিক কি রকম ছিল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর Nationalism গ্রন্থে nation এর যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হলো—A nation, in the sense of the political and economic union of a people, is that aspect which a whole population assumes when organized for a mechanical purpose. এক কথায় বলা যেতে পারে–রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে একত্রিত হওয়া জনসমষ্টি যা যান্ত্রিক প্রয়োজনে সংগঠিত। নেশনের ধারণাকে তিনি পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সভ্যতার ফসল বলেই বিবৃত করেন। তিনি আরো বলেন—এ যেন নদীতে বাঁধ দিয়ে তার স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে গড়ে তোলা এক সমাজ ব্যবস্থা যার যান্ত্রিক সংগঠন সব সময়ই এক শ্রেণীর মানুষকে শোষণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
1921 সালে জগানন্দ রায়কে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলছেন—nationalism হচ্ছে একটি ভৌগোলিক অপদেবতা, পৃথিবী সেই ভূতের উপদ্রবে কম্পান্বিত—সেই ভূত ছাড়াবার দিন এসেছে। ঐ একই সালে এন্ড্রুজকে লেখা এক চিঠিতে তিনি মুক্তকণ্ঠে বলছেন—I love India but my India is an idea and not a geographical expression. Therefore, I am not a patriot. I shall ever seek my compatriots all over the world. বিশ্বকবি দ্বিধাহীন ভাবে বিশ্ব ভাতৃত্বের কথা ঘোষণা করেন। patriotism সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য আরো পরিষ্কার করে পাই 1311 বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত ‘দেশের কথা’ প্রবন্ধে–“প্যাট্রিয়াটিজমের প্রতিশব্দ দেশহিতৈষিতা নহে। জিনিসটা বিদেশী, নামটাও বিদেশী থাকিলে ক্ষতি নাই। যদি কোনো বাংলা শব্দ চালাইতেই হয় তবে স্বাদেশিকতা কথাটা ব্যবহার করা যাইতে পারে। স্বাদেশিকতার ভাবখানা এই যে, স্বদেশের ঊর্ধে আর কিছুকেই স্বীকার না করা।……যেখানে স্বদেশের স্বার্থ লইয়া কথা সেখানে সত্য, দয়া, মঙ্গল, সমস্ত নিচে তলাইয়া যায়। স্বদেশীয় স্বার্থপরতাকে ধর্মের স্থান দিলে যে ব্যাপারটা হয় তাহাই প্যাট্রিয়াটিজম শব্দের বাচ্য হইয়াছে।……ন্যাশনালত্বের সুবিধার খাতিরে মনুষ্যত্বকে পদে পদে বিকাইয়া দেওয়া, মিথ্যাকে আশ্রয় করা, ছলনাকে আশ্রয় করা, নির্দয়তাকে আশ্রয় করা প্রকৃতপক্ষে ঠকা।……মনুষ্যত্বের মঙ্গলকে যদি ন্যাশনালত্ব বিকাইয়া দেয়, তবে ন্যাশনালত্বের মঙ্গলকেও একদিন ব্যক্তিগত স্বার্থ বিকাইতে আরম্ভ করিবে”।
নেশন বা ন্যাশনালিজম এবং প্যাট্রিয়াটিজমের যে ভাবমূর্তি কৃত্রিমভাবে নির্মাণ করা হয় তার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আক্রমণ করলেন তাঁর ‘বিরোধমূলক আদর্শ’ প্রবন্ধে। বিপরীতে তুলে ধরলেন তাঁর ‘সমাজ’ ভাবনার আদর্শকে। তিনি বললেন–“মিথ্যা দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজেদের কাছে নিজেকে বড় করিয়া প্রমাণ করিতে হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, প্যাট্রিয়াটিজমের প্রধান অবলম্বন।…..নেশনের মেরুদণ্ড হইল স্বার্থ। স্বার্থের বিরোধ অবস্বাম্ভাবী, এবং স্বার্থের সংঘাতে মানুষকে অন্ধ করিবেই।….এক নেশনের প্রবলত্ব অন্য নেশনের পক্ষে সর্বদায় আশঙ্কাজনক। এ স্থলে বিরোধ, বিদ্বেষ, অন্ধতা, মিথ্যাপবাদ, সত্যগোপন, এসমস্ত না ঘটিয়া থাকিতে পারে না”। এর বিপরীতে ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ প্রবন্ধে উনি বললেন— “সভ্যতার যে মহৎ গঠনকার্য—বিচিত্রকে এক করিয়া তোলা—হিন্দু তাহার কি করিয়াছে দেখিতে হইবে। এই এক করিবার শক্তি ও কার্যকে ন্যাশনাল নাম দাও বা যেকোন নাম দাও তাহাতে কিছু আসে যায় না, মানুষ বাঁধা লইয়ায় বিষয়।…..হিন্দুসভ্যতা যে এক অত্যাশ্চর্য প্রকাণ্ড সমাজ বাঁধিয়াছে, তাহার মধ্যে স্থান পায় নাই এমন জাত নাই।…..সকলে আপন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ও আচারের নানা প্রভেদ সত্ত্বেও সুবিশাল হিন্দু সমাজের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া একত্রে বাস করিতেছে”। তিনি আরো বললেন—“সমাজের পক্ষে উদারতা সহজ। হিন্দুরা বলে, স্ব স্ব ধর্মপালন করাই পুণ্য।…..সদ্ভাব ও সত্যই সমাজের মূল আশ্রয়”।
তাঁর এই সমাজ ধারণাটি মনে হতে পারে হিন্দুত্বের আবরণে আচ্ছাদিত। এর উত্তর পাই তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের পরিশিষ্টে। তিনি বলছেন—“ইউরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার। আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে; তাহা ধর্মরূপে আমাদের সমাজের সর্বত্র ব্যপ্ত হইয়া আছে”। এখানে ধর্ম বলতে যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা রিলিজিয়ন নয় তাও তিনি স্পষ্ট করেছেন। এক্ষেত্রে ধর্ম মানে সামাজিক কর্তব্যতন্ত্র—সামাজিক মানুষজনের স্বদেশের প্রতি কর্তব্য, প্রীতি-ভালোবাসা। ধর্ম মানে, যে আত্মীয় সম্পর্কের বন্ধনকে ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তি বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সেই আত্মীয়তন্ত্রের বিকাশ। তিনি বললেন মানুষকে এক সূত্রে বাঁধার কথা, বললেন দেশের হৃদয়কে এক করার কথা। স্বদেশ নির্মাণের বা দেশের হৃদয়কে এক করার ক্ষেত্রে তিনি ভারতবর্ষীয় পথের সন্ধান দিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথায়—“এখন আমাদের সমাজ নির্জীবভাবে সকলের সহিত বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়া থাকিবে না, সজীব হইয়া সকলের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিবে—পল্লীর সহিত পল্লীর, সম্প্রদায়ের সহিত সম্প্রদায়ের, দেশের সহিত দেশ গাঁথিয়া এক হইয়া যাইবে।……প্রয়োজনের সম্বন্ধকে আমরা হৃদয়ের সম্বন্ধ দ্বারা শোধন করিয়া লইয়া তবে ব্যবহার করিতে পারি”। শুধু তাই নয়, তাঁর মতে, “মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয় সম্বন্ধ স্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল”।
আসলে, সহনশীলতা-তিতিক্ষা-ধৈর্য— ভারতবাসীর চিরকালীন অন্তর বস্তু। তাই দেশের হৃদয়কে এক করার ক্ষেত্রে তিনি যেকোন রকম বল প্রয়োগ, হিংসা এবং আধিপত্যবাদের বিরোধী ছিলেন। সেই কারণে, ‘এক দেশ এক জাতি এক ভাষা’ জাতীয় স্টীমরোলার চালিয়ে বৈচিত্র্যময় সমাজ জীবনকে সমভূম সমতলে পরিণত করার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। তিনি যথার্থরূপে উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতের বৈচিত্র্যময় জনজীবন তার সম্পদ, সমস্যা নয়। “Nationalism in India” প্রবন্ধে জোরালো ভাষায় বলেন—”India has never had real sense of nationalism”.

আসলে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষের ইতিহাস হলো প্রতিনিয়ত সামাজিক বোঝাপাড়া এবং পারস্পরিক সহনশীলতার ইতিহাস। এক্ষেত্রে বাহ্যিক বলপ্রয়োগ মূলক শৃঙ্খলা আরোপের বিষয়টি ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ যেন দেখাতে চান, বল প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল পৌরুষ উদ্দিপ্ত পশ্চিমি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের অন্ধ অনুকরণ মোটেই ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পরবর্তী কালের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কোসাম্বির মতে—যদি আমরা সময়ের গতিপথে পিছিয়ে গিয়ে মিশরীয় বা সুমেরীয় সংস্কৃতির খোঁজ করি তাহলে আমাদের আরবী ভাষা এবং সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। বৃহত্তর আফ্রিকাতে মিশরীয় সংস্কৃতির সেই ধারাবাহ্কিতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা আমরা তিন হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজে বহন করে আসছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরদৃষ্টি দিয়ে এই সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন।
এক কথায় তাঁর এই জাতীয়তাবাদ-বিরোধী স্বদেশপ্রেমকে আমরা বিশ্ব মানবতাবাদ বলতে পারি। যা আমরা এবং ওরা এই বিভাজনের উর্দ্ধে মানুষকে আপন করতে শেখায়। এটাই ভারতীয় সভ্যতার মূল অন্তর বস্তু। বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই চিন্তাধারা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আজ একদিকে যেমন দেশব্যাপী সহনশীলতার অভাব দেখতে পাই, শুনতে পাই গণতন্ত্রের বোবা কান্না; তেমনই অপরদিকে দেখি এই দুর্দিনে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের লং মার্চে পানীয় জল, খাবারের প্যাকেট দিয়ে সাহায্য করছেন স্থানীয় মানুষ। বিভিন্ন জায়গায় দরিদ্র জনের খাবার বন্দোবস্ত করছেন সাধারণ মানুষ। উম্পুন ও করোনা অতিমারির সময় একদল নির্ভীক মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। লাঠির শাসন বিনা “নেশন” সেখানে নিতান্তই অনুপস্থিত। দাঁড়িয়ে আছে শুধু মানবতা! ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ব মানবতার জয়গান।
ঋণ স্বীকার:
দেবজ্যোতি বন্দোপাধ্যায় লিখিত রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবদ-বিরোধী স্বদেশপ্রেম।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞানের ছাত্রী, গণিতে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন এক দশকের উপর। বর্তমানে প্রবাসী এবং ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে জানা বোঝায় আগ্রহী।
যোগাযোগ:
Photo: Wikimedia Commons
অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ প্রাসঙ্গিক লেখা
ধন্যবাদ জানবেন।
যুগোপযোগী লেখা। ভালো লাগল।
ধন্যবাদ জানবেন।
ধন্যবাদ জানবেন।
ধন্যবাদ জানবেন।