পিটার রোনাল্ড ডি’সুজা
যদিও তিনি একটি জাতীয় বিতর্কের আহ্বান জানিয়েছেন, তবুও তিনি অবশ্যম্ভাবী এই প্রবন্ধের জবাব দেবেন না । অবশ্যই তাঁর মন্তব্যটি ছিল উসকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেবল একটি মতাদর্শগত ভাসমান ধারণা, যুক্তিসম্পন্ন কোনো বক্তব্য নয়। কিন্তু যেহেতু তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সরকার্যবাহ (সাধারণ সম্পাদক, ২০২১ থেকে), যে সংগঠন দেশকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিচালনা করে, তাই তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া জরুরি।
সংঘ পরিবার-এর উচ্চপদস্থ নেতারা সাধারণত হঠাৎ করে কোনো মন্তব্য করেন না। তবে এটিই এই প্রতিক্রিয়ার প্রধান কারণ নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, ২০০৪ সাল থেকে তিনি সংঘ পরিবারের বৌদ্ধিক শাখার সহ-বৌদ্ধিক প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। ফলে তিনি আরএসএস-এর অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদ।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের শব্দচয়ন খুব সতর্কতার সঙ্গে করেন। তাঁরা বলার আগে চিন্তা করেন। তাঁদের ভাষা সংযত, যা ইঙ্গিত করে যে উচ্চারিত কথার আড়ালে একটি সম্পূর্ণ চিন্তার জগৎ রয়েছে। সেই জগৎ যেন আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকে। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক টেরি ঈগলটন বুদ্ধিজীবীদের ব্যাখ্যা করেছিলেন এমন মানুষ হিসেবে যারা “পুরো সংস্কৃতির মধ্যে ধারণাগুলোকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে।” দত্তাত্রেয় হোসাবলে ঠিক সেটাই করছিলেন যখন তিনি সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে “ধর্মনিরপেক্ষ” এবং “সমাজতান্ত্রিক” শব্দগুলো অপসারণের দাবি তুললেন (জুন ২০২৫)।
তাঁর উক্তির মধ্যে দুটি দিক রয়েছে যা আমাদের মনোযোগ দাবি করে। একটি গ্রহণযোগ্য, অন্যটি বিতর্কিত। দুর্ভাগ্যবশত, জনসমাজের প্রতিক্রিয়া মূলত বিতর্কিত দিকটির ওপরই সীমাবদ্ধ।
পুর্বপক্ষের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের ধারায় আমি তাই উভয় দিকের প্রতিক্রিয়া জানাব। (পুর্বপক্ষ, ভারতীয় তর্কবিদদের বিতর্কে একটি ঐতিহ্য। এটি সমালোচনা করার আগে প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে গভীর পরিচিতি তৈরি করে যেখানে সমালোচনার আগে প্রতিপক্ষের মতামত গভীরভাবে বুঝে নেওয়া হয়। পূর্বপক্ষ পদ্ধতিটি আদি শঙ্করাচার্যের পাশাপাশি রামানুজ এবং পরবর্তী আচার্যগণ তাদের রচনায় ব্যবহার করেছেন ) ।
প্রস্তাবনার বিতর্ক
গণপরিষদে প্রস্তাবনাকে কেন্দ্র করে হওয়া বিতর্কে লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি, অঞ্চল ও দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য দেখা গিয়েছিল। যে সদস্যরা কথা বলেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন— এইচ.ভি. কামাথ, কে.এম. মুনশি, হাসরত মোহানি, দেশবন্ধু গুপ্ত, বি. পট্টাভি সীতারামাইয়া, জয় নারায়ণ ব্যাস, কে. সান্থানাম, এ. থানু পিল্লাই, রোহিনী কুমার চৌধুরী, ভি.আই. মুনিস্বামী পিল্লাই, শিব্বনলাল সাক্সেনা, এম. তিরুমালা রাও, মহাবীর ত্যাগী, হৃদয়নাথ কুনজরু, সত্যনারায়ণ সিনহা, গোবিন্দ মালব্য, বি.আর. আম্বেদকর, জে.বি. কৃপালানি, পি.এস. দেশমুখ, সত্যেশ চন্দ্র, ব্রজেশ্বর প্রসাদ, নাজিরউদ্দিন আহমদ এবং পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজেন্দ্র প্রসাদ সভার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন। আমি তাঁদের এখানে উল্লেখ করছি তাঁদের স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। আলোচনা যদিও তীব্র হয়েছিল—কিছু সদস্য তাঁদের সংশোধনী নিয়ে একগুঁয়েমি দেখিয়েছিলেন—তবুও তাঁরা পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট সৌজন্যশীল ছিলেন এবং কখনও কখনও রসিকতাও করেছিলেন। যেমন মুনশি, হাসরত মোহানির একটি পয়েন্ট অফ অর্ডারের জবাবে বলেছিলেন: “জীবনে প্রথমবারের মতো আমি মৌলানা সাহেবকে সমর্থন করছি!”—সেই সময় যেন অনেক দূরের এক স্মৃতি হয়ে গেছে।
হোসাবলের “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দের প্রতি অনীহার প্রসঙ্গ ধরলে “ঈশ্বর” নিয়ে গণপরিষদের আলোচনাগুলো বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। সাক্সেনা একটি সংশোধনী প্রস্তাব করেছিলেন:
“সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নামে, যাঁর প্রেরণা ও দিকনির্দেশনায় জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন…”
মহাত্মা গান্ধীর নাম অবিলম্বে বিরোধিতার মুখে পড়ে কারণ এটি গান্ধীবাদী সংবিধান ছিল না। তবে, আরও মজার বিষয় ছিল “ঈশ্বর” শব্দটিকেও বিরোধিতা করা। পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন:
“আমি মি. কামাথের কাছে আবেদন করছি [যিনি প্রথমে ঈশ্বর যোগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন] আমাদেরকে এমন এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না যাতে আমাদের ঈশ্বরের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে হয়।”
অর্থাৎ, সংবিধানে ঈশ্বরকে আনবেন না।চৌধুরী চাইছিলেন “In the name of god” বা “ঈশ্বরের নামে” পরিবর্তন করে “In the name of goddess” বা “দেবীর নামে” করা হোক, কারণ তাঁর কথায়, তিনি “কামরূপের মানুষ, যেখানে দেবী কামাখ্যার পূজা করা হয়।” তবে উভয় প্রস্তাবই বাতিল হয়ে যায়, এবং মজার বিষয় হলো—এ নিয়ে কেউই বিরক্ত হননি।
ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা
এরপর থানু পিল্লাই সংশোধনীতে নিহিত বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে যুক্তি দেন এই বলে যে “একজন মানুষের অধিকার আছে ঈশ্বরে বিশ্বাস করার বা না করার।” লক্ষ্য করুন, “বা না করার” কথাটা। তিনি আরও বলেন, যদিও তিনি নিজে একজন বিশ্বাসী, এই শব্দবন্ধ ঈশ্বরে বিশ্বাসকে এক প্রকার বাধ্যতামূলক করে তুলবে। থানু পিল্লাই যেন অবিশ্বাসীদের অধিকারকেও বিশ্বাসীদের সমানভাবে স্বীকৃতি দিচ্ছিলেন। বিস্ময়কর উদার মানসিকতা। এই সব মন্তব্য থেকে স্পষ্ট যে প্রস্তাবনার ভেতরে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা গভীরভাবে প্রবাহিত ছিল।
এই বিতর্কগুলো থেকে আরেকটি অমূল্য উক্তি উঠে আসে, যা হোসাবলের প্রস্তাবনার “চিরন্তন” বর্ণনাকে সমর্থন করে। কৃপালানি বলেন:
“স্যার, আমি এই গম্ভীর মুহূর্তে সভাকে স্মরণ করাতে চাই যে, আমরা এই প্রস্তাবনায় যে কথাগুলো বলেছি, তা শুধুই আইনগত বা রাজনৈতিক নীতি নয়। এগুলো মহান নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নীতি এবং যদি বলি, এগুলো একরকম মিস্টিক বা রহস্যময় নীতি।”
প্রস্তাবনাকে “চিরন্তন” বলে বর্ণনা করে হোসাবলে আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। “চিরন্তন” মানে এমন কিছু যা সময়, স্থান, প্রেক্ষাপট, বা শাসনব্যবস্থার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। একে সংশোধন বা উপেক্ষা করা যায় না। যদি কখনও সংশোধন করতেই হয়, তবে তা হওয়া উচিত একেবারে ব্যতিক্রমী, বিরল পরিস্থিতিতে।
চিরন্তন নীতি
হোসাবলে কি “চিরন্তন” শব্দ ব্যবহার করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে এই আহ্বান জানাচ্ছেন যে তারা যেন সকল নাগরিকের জন্য “সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা, মর্যাদা ও সুযোগের সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব (যা ব্যক্তির মর্যাদা ও জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করে)”—এই লক্ষ্যগুলি রক্ষা করে?
এই নীতিগুলোই তো চিরন্তন। হোসাবলে কি তাঁর সরকারকে বলবেন যে অসমে নাগরিকত্ব প্রশ্নে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, উত্তর প্রদেশে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, আর দেশে ভ্রাতৃত্ববোধ হ্রাস পাচ্ছে—এভাবে তারা প্রস্তাবনার চেতনা লঙ্ঘন করছে এবং এর “চিরন্তন” দীপ্তিকে কলুষিত করছে? যদি হোসাবলে ইচ্ছাকৃতভাবে “চিরন্তন” শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন—যা একজন চিন্তাশীল মানুষের বৈশিষ্ট্য—তাহলে কি আমরা সবাই প্রস্তাবনার বিশেষ মর্যাদা নিয়ে একমত?
উদ্দেশ্য প্রস্তাব (Objectives Resolution) পড়েও অনেক কিছু শেখা যায়, তবে আমি এখানে দুটি বিষয়ের উল্লেখ করব। নেহরু, লক্ষ্য করেছিলেন যে বহু সদস্য অনুপস্থিত, তাই তিনি উপস্থিতদের উপদেশ দেন যেন তাঁরা অনুপস্থিতদের স্বার্থ মাথায় রেখে “কিছুই না করেন যা অন্যদের অসুবিধায় ফেলবে বা কোনো নীতি-বিরোধী হবে।”
তাঁর মতে, তাঁদের অনুপস্থিতি “আমাদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।” কী মহৎ চিন্তা, যা আজকের সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলোতে অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। আরেকটি বিষয় যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, তা হলো নেহরুর প্রস্তাব যে, এই প্রস্তাবটি “হাত তুলে সমর্থন” নয়, বরং “আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যেন নতুন করে এই শপথ গ্রহণ করি।”
হোসাবলে কি একমত হবেন যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৭৫তম বছরে আমাদের এই শপথ নতুন করে গ্রহণ করার সময় এসেছে? এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে এবার আমি চারটি অসন্তোষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। প্রথম প্রসঙ্গে, প্রেক্ষাপট: আমি তাঁর সাধারণ যুক্তির সঙ্গে একমত যে স্বৈরাচারী শাসনের সময়ে আনা সাংবিধানিক পরিবর্তনের খুব সামান্য বৈধতা থাকে। ঘোষিত কিংবা অঘোষিত জরুরি অবস্থার সময়কালে আনা মৌলিক পরিবর্তনগুলোর তেমন কোনো নৈতিক মূল্য থাকে না (যদিও আইনগতভাবে তা সঠিক হতে পারে), তাই যদি এ ধরনের পরিবর্তন আনা হয়ে থাকে, তবে সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।
৪২তম সংশোধনীতে আনা পরিবর্তন
জরুরি অবস্থার সময় ১৯৭৬ সালে আনা ৪২তম (সংবিধান)সংশোধনীতে বহু পরিবর্তন হয়েছিল, যেগুলো ১৯৭৮ সালে জনতা পার্টির শাসনামলে ৪৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ফিরিয়ে নেওয়া হয় (সম্পত্তির মৌলিক অধিকার, জরুরী অবস্থা ঘোষণা ইত্যাদি)।
তবে “ধর্মনিরপেক্ষ” এবং “সমাজতান্ত্রিক” শব্দ দুটি কেন রেখে দেওয়া হয়েছিল তা এখনো রহস্য। সম্ভবত হোসাবলে আমাদের এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারবেন, কারণ জনসংঘ (যা পরে বিজেপি’র পূর্বসূরী হয়) জনতা পার্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। হোসাবলের দ্বিতীয় আপত্তির সঙ্গেও আমি একমত: প্রস্তাবনায় এই শব্দ দুটি আনার পদ্ধতি সঠিক ছিল না। “ধর্মনিরপেক্ষ” এবং “সমাজতান্ত্রিক” শব্দ দুটি জরুরি অবস্থার সময়ে আনা একটি বৃহৎ, সর্বব্যাপী ৪২তম সংশোধনীর অংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল। এগুলো আনা যদি জরুরি হতো, তবে আলাদা ও স্বতন্ত্র একটি সংশোধনীর মাধ্যমে আনা উচিত ছিল। অবশ্যই, তা জরুরি অবস্থার বাইরে সময়ে করা উচিত ছিল।
আমি এখানে স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে আমার বিশ্বাস, কোনো সংবিধান চিরকালের জন্য অটলভাবে স্থির থাকে না। নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে সব ধারা-উপধারা সংশোধন করা সম্ভব। তবে একটি শর্ত আছে। মূল ধারণাগুলিতে সংশোধন খুব সতর্কতার সঙ্গে, গভীর আত্মবিশ্লেষণ ও দ্বিধা নিয়ে এবং খুবই কম, একেবারে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে করা উচিত, কারণ এগুলোই আমাদের প্রতিষ্ঠাতা দলিলের মূল দিশারী দিকনির্দেশনা। এগুলো অশোক স্তম্ভের মতো দৃঢ় থাকা উচিত।এই ধারণাটি আমার পছন্দ। এগুলোই সংবিধানের “মূল কাঠামো” গঠন করে—কারণ এটি মেনে নেয় যে মূল উপাদানগুলো বিস্তৃত ও গ্রহণযোগ্য এবং সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বদলালে সেগুলো অন্যভাবে রূপ নিতে পারে।
এই কারণেই আজ “জীবনের অধিকার” বলতে “পরিষ্কার পরিবেশের অধিকার”ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মূল দিকগুলো দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে, টিকে থাকতে হবে এবং শুধু চরম পরিস্থিতিতেই পরিবর্তিত হওয়া উচিত। মূল দিকগুলির বৈধ পরিবর্তনকে তুলনা করা যেতে পারে এভাবে যে “আপদধর্ম” (দুর্যোগের সময়ের নৈতিক নীতি) প্রয়োগ করা হয় “সাধারণ ধর্মে” (প্রতিদিনের নৈতিক নীতি)। সম্ভবত এ কারণেই জনতা পার্টি ৪৪তম সংশোধনী পাস করার সময় প্রস্তাবনা থেকে “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “সমাজতান্ত্রিক” শব্দগুলো বাদ দেয়নি। এখানে হোসাবলের কাছে আমার প্রশ্ন: অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলুপ্তির বিষয়টি এই নীতির সঙ্গে কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
‘সমাজতান্ত্রিক’ সীমাবদ্ধতা
হোসাবলের তৃতীয় উদ্বেগ—যে “সমাজতান্ত্রিক” শব্দটি নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধতা আনতে পারে—তা অন্তত তিনটি কারণে দুর্বল। সব প্রতিষ্ঠাতা নীতি—ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা, এবং ভ্রাতৃত্ব—সরকারকে সীমাবদ্ধ করার জন্যই থাকে, কারণ সেই সীমাবদ্ধতাই এক সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাপকাঠি। তাই নীতিনির্ধারণকে সীমিত করা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
এছাড়া, নেহরু ও আম্বেদকর দু’জনেই সংবিধানকে আত্মায় সমাজতান্ত্রিক হিসেবে দেখেছিলেন। তাই নেহরু শব্দটি সংবিধানে জোর করে যোগ করার প্রয়োজন অনুভব করেননি এবং আম্বেদকর সংবিধানের নানা ধারাকে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত, হোসাবলেকে প্রশ্ন করতে হয়—কোন সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর আপত্তি? কারণ ভারতে সমাজতন্ত্রের বহু ধরন রয়েছে—গান্ধীয়, লোহীয়, নেহরুবাদী, আবার দীনদয়াল উপাধ্যায় ও এস.এ. ডাঙ্গের সমাজতান্ত্রিক ধারণাও আছে। বিজেপির “অন্ত্যোদয়” ধারণা কি সমাজতন্ত্রের অন্য নামে পরিচিত নয়?
এবং শেষত, চতুর্থ আপত্তি: প্রস্তাবনার “চিরন্তন” আভাকে ম্লান করা নিয়ে। ভাষাগতভাবে, “সমাজতান্ত্রিক” এবং “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দ দুটি সেখানে কিছুটা বেমানান শোনায়। এগুলোর মর্যাদা ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের মতো নয়। কারণ প্রথমগুলো মতাদর্শ, আর পরেরগুলো নীতি।
কিন্তু হোসাবলে এখানে প্রস্তাবনার ভাষাগত সৌন্দর্য হারানোর প্রসঙ্গে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা করছেন না। তাঁর বক্তব্য অনেকটা শূন্য, শক্ত যুক্তি দিয়ে সমর্থিত নয়। এটা একধরনের পক্ষপাত। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রকে পছন্দ করেন না কারণ সেটাই দলের অবস্থান, কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ নয়। কেন তিনি মনে করেন এই শব্দগুলো প্রস্তাবনার “চিরন্তন” আভাকে কলুষিত করে, তা জানা সত্যিই আকর্ষণীয় হবে।
আমি আশা করি, এটাই সেই আলোচনার ধরন যা তিনি চেয়েছিলেন। যদি না হয়ে থাকে, তবে তিনি যেন আমাদের জানান, আমরা নতুন করে শুরু করব।
[পিটার রোনাল্ড ডি’সুজা একজন স্বাধীন গবেষক। তিনি পূর্বে শিমলাস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের পরিচালক ছিলেন।]
সৌজন্যে: ফ্রন্টলাইন পত্রিকা, ২২ জুলাই ২০২৫
ভাষান্তর ও সংযোজনী : বঙ্কিম দত্ত
আগের যে লেখাগুলি পড়তে পারেন:
পরিবেশ আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র: মধ্যবিত্ত নাকি শ্রমিক?