আফগান নারীর সংগ্রাম ও বিশ্বের নারীদের প্রতি আহ্বান

পোস্টটি দেখেছেন: 69 সুভদ্রা চন্দ্র  আফগান নারীর উপরে কিছু চিত্র: ডিসেম্বর মাসের সকাল বেলা খাদিজা তার তিন মাসের ছেলের কপালে চুমু খেয়ে, গুডবাই বলে, কেরোসিন তেল ঢেলে নিজের গায়ে আগুন লাগায়। আগুন লাগাবার আগে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে –  “ভগবান তুমি আমাকে দয়া কর। আমাকে মুক্তি দাও এই জীবন যন্ত্রণা থেকে।” পরের দিন হাসপাতালে তার […]

আফগান নারী

সুভদ্রা চন্দ্র

 আফগান নারীর উপরে কিছু চিত্র:

ডিসেম্বর মাসের সকাল বেলা খাদিজা তার তিন মাসের ছেলের কপালে চুমু খেয়ে, গুডবাই বলে, কেরোসিন তেল ঢেলে নিজের গায়ে আগুন লাগায়। আগুন লাগাবার আগে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে –  “ভগবান তুমি আমাকে দয়া কর। আমাকে মুক্তি দাও এই জীবন যন্ত্রণা থেকে।” পরের দিন হাসপাতালে তার জ্ঞান ফিরলে সে বুঝতে পারে, তার প্রার্থনা বৃথা গেছে। তখন সে সাংবাদিকদের বলে – তার নাম গোপন রাখতে, তার পরিবারের কারণে। হীরাটের হাসপাতাল থেকে আফগান মহিলা বলে- “আমি মৃত নই, আমি জীবিতও নই।” বোনের হাত ধরে বলে – “আমি মরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা গেছে।”

খাদিজার মতন অনেক আফগান মহিলাকেই আত্মহত্যা করতে হয় সংসারের চাপে (সূত্র- টাইমস পত্রিকা)। তার কারণ সংসার থেকে পালিয়েও সমাজে তাদের মুক্তি নেই। পরবর্তী চিত্রে সেইরূপ ছবিই ফুটে উঠে। ২০১৫ সালের মার্চে ফারখুন্ডা মালিকজাদা নামে ২৭ বছরের এক আফগান নারীকে বেশ কিছু মানুষ ইঁট বৃষ্টির ঘায়ে খুন করে। দোষ হিসাবে বলা হয় সে কোরান পুড়িয়েছে। জনগণের মধ্যে জানাজানি হওয়ার সাথে সাথেই ফেসবুকের সাহায্যে জানতে পারা যায় যে- আসলে সে নির্দোষ। কোরান পোড়ানোর মিথ্যা দোষে তাকে খুন করা হয়। ২০১৮ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার রিপোর্টে বলে যে, মহিলাদের উপর এই রূপ অত্যাচার সরকারি বেসরকারি উভয় পক্ষ থেকেই করা হয়।

১৪ই আগস্ট ২০২০ ফাউজিয়া কফি (আফগানিস্তানের সরকারের সাথে তালিবানদের মধ্যে যে শান্তি চুক্তির আলোচনা চলছিল তার সদস্যা ছিলেন) আক্রান্ত হন এবং তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এছাড়া সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী “কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ” পড়লে বোঝা যায় আফগানিস্তান সমাজে নারীদের কিরূপ মর্মান্তিক অবস্থান। তিনি নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য কাজ করছিলেন বলে, তাকে অত্যন্ত নির্মম ভাবে খুন করা হয়। উপরিউক্ত ঘটনা গুলি ঘটেছে আফগানিস্তান থেকে তালিবানদের মার্কিন সরকার দ্বারা অপসারণের পর। তাহলে বোঝাই যায় আরো কত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তালিবানদের উপস্থিতিতে।

এই বর্বরতা আফগানিস্তানে টিকে থাকার কারণ কী?

মার্কিন দেশ এবং তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়া এই অঞ্চলে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে বলে যেসব ক্রিয়া কলাপ চালিয়েছে, সেটাই শক্তিশালী করেছে মৌলবাদকে। আফগানিস্তানের মানুষকে জাতি হিসেবে মাথা তুলতে দেয়নি। ফলে ভিতরে ভিতরে টিকে থাকা ট্রাইবাল সমাজের ধাঁচাটি অবিকল টিকে রয়েছে। যার মাধ্যমে মানুষের ঘাড়ে চেপে রয়েছে গ্রামীণ সমাজ ভিত্তিক “সুরা কাউন্সিল” -এর অনুশাসন। অর্থাৎ ধর্মের অনুশাসন। ফলে একদিকে চলছে কাবুলের কেন্দ্রীয় আইনি অনুশাসন, উল্টোদিকে গ্রামেগঞ্জে চলছে এইরূপ মৌলবি অনুশাসন, আর এইখানে জায়গা করে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ। ১৯৬৩ সালের মার্চে রাজা মোহাম্মদ জাহিরশা ও প্রধানমন্ত্রী মোঃ দাউদ পদত্যাগ করেন- পাকতুনস্থান নিয়ে  বিবাদের কারণে। যার ফলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর দুই সপ্তাহ পরে জাহিরশার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সংবিধানে আইন আনা হয় – রাজপরিবারের কেহ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা, একমাত্র রাজা ছাড়া। উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের সদস্য দাউদকে আটকানো। সংবিধানে মেয়েদের ভোট দেবার অধিকার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার স্থান পায়। আর বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেওয়া হয়। একমাত্র শরীয়ত আইন সেখানেই চলবে যেখানে সরকারি আইন বলবৎ নয়। নতুন এই সংবিধানের আওতায় দুইজন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসেন। এর মধ্যে দিয়ে শিক্ষিত আফগানরা দেশ গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আস্তে আস্তে সামনের সারিতে চলে আসছিলেন। কিন্তু আফগানিস্তান সমাজের যে দ্বন্দ্ব আধুনিক কেন্দ্রীয় গনতান্ত্রিক অনুসাশনের সাথে সমাজে চলা “সুরা কাউন্সিল”-এর শাসন- এই দুই শাসন মুখোমুখি দাঁড়াল পার্লামেন্টে এসে। তার কারণ পার্লামেন্টে নির্বাচিত ৯০% সদস্য তারা আবার গ্রামিন সুরা কাউন্সিলের সদস্য ছিল।

ছবি এপি ভায়া https://www.pri.org/

নতুন ও পুরনো আফগানিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব

একদিকে আধুনিক আফগানিস্তান গড়ার শিক্ষিত মানুষদের স্বপ্ন, উল্টোদিকে সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা আফগানিস্তানের দ্বন্দ্ব পার্লামেন্টে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু এই দ্বন্দ্বগুলি আফগান জনজাতির নিজের মধ্যেই বিতর্কের আকারে উপস্থিত হচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘ এই বিতর্ক আবার কোনরূপ শক্তিশালী আইন তৈরী করার পথে বাধা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পার্লামেন্টে নারী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ এবং নারীদের পক্ষে আইন পাসের জন্য লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এক নারী সচেতনতা গড়ে উঠছিল সমাজ জুড়ে। কিন্তু আবার মৌলবাদীরা তাদের অস্তিত্বের সংকটে পড়ছিল। ফলে গ্রামীণ মৌলবাদী “সুরা অনুশাসনের” শক্তি বাড়িয়ে সরকারি আইনকে আটকাবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে মৌলবাদীরা এই পর্বে। এই অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দাউদ খাঁ জাহিরশাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৯ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদকে ভেঙে দেয়। পার্লামেন্ট রিপাবলিক থেকে দাউদ খাঁ আফগানিস্তানকে একটা প্রেসিডেন্সিয়াল রিপাবলিকে পরিণত করে। আবার নতুন সংবিধান তৈরি হয়।

কেন তৈরি হয়? তার কারণ দাউদ খাঁর উদ্দেশ্য ছিল তার “আফগান ন্যাশনাল রিভলিউশনারি” পার্টির একদলীয় অনুশাসন গঠন করা। এর ভেতর দিয়ে আফগান সমাজ জুড়ে যে বিতর্ক চলছিল সেটা চাপা পড়ে যায় এবং একদলীয় অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত রাজের অনুপ্রবেশের রাস্তা তৈরি হয়। দাউদ খাঁর আমলে ২১৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে চারজন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। তারমধ্যে কুবরা নুরজি প্রথম মহিলা মন্ত্রী হন। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করে, বারবার কারমালকে ক্ষমতায় বসানোর মধ্য দিয়ে। এর ভিতর দিয়ে আফগানিস্তান সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটি প্রকাশিত হচ্ছিল-  গণতান্ত্রিক আইনের অনুশাসন বনাম ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বন্দ্ব, তা অন্য রূপ পেতে শুরু করে। বিশেষ করে মার্কিন সেনাবাহিনী আসার সাথে সাথে তারা যোগাযোগ করে সোভিয়েত বিরোধী ধর্মীয় মুজাহিদিনদের এবং তাদের শক্তিশালী করার পথ নেয়। ফলে আফগান সমাজের ভিতরের দ্বন্দ্বটি সোভিয়েত রাশিয়া এবং মার্কিন দেশের ভেতরকার দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। এই কাজে মার্কিন দেশ নিয়োজিত করে লাদেনকে। এর ভিতর দিয়ে মার্কিন দেশ অন্য ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে এই অঞ্চলে। সোভিয়েত অনুশাসন উপর থেকে চাপানোর মধ্য দিয়ে নারীরা কিছু সুযোগ সুবিধা পেলেও, এই অঞ্চলের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসবাদি সংগঠন গড়ার কাজে পাকিস্তান ও লাদেন উভয়কেই মার্কিন দেশ ব্যবহার করলো। বকলমে এক বেসরকারী

সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা হয়। এই সকল অঞ্চলের সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলির ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে, যুবকদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে ও যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে অস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করে। আফিম চাষ ও ড্রাগ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একদিকে একটা বেআইনি অর্থনীতি গড়ে তুলে এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলোকে অর্থ যোগান দেওয়া হয়েছে আবার অন্যদিকে এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলোর কারণে এই সকল অঞ্চলের সরকারগুলিরও প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়ে গেছে।

দুই তরফেই অস্ত্র ব্যবসা করেছে মার্কিন দেশ। সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন হওয়ার সাথে সাথেই এদের মধ্যের থেকে তালিবান গোষ্ঠী সামনের সারিতে চলে আসে এবং ক্ষমতা দখল করে, বকলমে মার্কিন সমর্থনে। মধ্যযুগীয় মৌলবাদী অনুশাসন গড়ে ওঠে আফগানিস্তানে। ফলে কেন্দ্রীয় অনুশাসন ও গ্রামীণ সুরা কাউন্সিলের অনুশাসন দুটোই একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। একদিকে আফিম চাষ আর একদিকে অস্ত্র ব্যবসার মধ্যে দিয়ে এদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটলো। পাকিস্তানের মিলিটারিও একরূপ আয় এখানে থেকে পেতে থাকে, ফলে পাকিস্থানে কোন নির্বাচিত সরকার যদি কখনো এই সকল স্থানে শান্তিপ্রক্রিয়া জারি করতে গেছে, তখনই তার বিরুদ্ধে ঘটেছে বর্বর আক্রমণ। উদাহরণ বেনজির ভুট্টোর মৃত্যু ও মুসারফের দেশত্যাগ। মার্কিন দেশের সাথে নতুন বিরোধ শুরু হলো লাদেনের। কারণ লাদেন কার্যত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। এই অঞ্চলের দরিদ্র মুসলিম যুবকদের সন্ত্রাসবাদে নিয়ে এসে বিশাল শক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছিল। সে চেষ্টা করেছিল এই শক্তির সাহায্যে এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি হতে। লাদেনের উস্কানিতে তালিবানরা মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া শুরু করলো। মার্কিন দেশ বিশ্বব্যাপী তালিবানদের বিরুদ্ধে ও লাদেনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করল, তালিবানরা কতো নারী বিরোধী সেটাকে সামনে নিয়ে এসে। এর ভেতর দিয়ে মার্কিন দেশ আফগানিস্তান থেকে তালিবান মুক্ত করার কর্মসূচি গ্রহণ করলো। এবং তালিবানদেরকে বিতাড়ণও করলো, কিন্তু নারীদের উপর মৌলবাদীদের সামাজিক অত্যাচার বিন্দুমাত্র কমেনি। যদিও সোভিয়েত দখলদারি মানসিকতাকে সমর্থন করা যায় না, কিন্তু তাদের সময় নারীরা অনেক বেশি গণতন্ত্র এবং সামাজিক কাজে অনেক বেশী অধিকার পেয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আবার বিশ্বব্যাপী চায়না ও মার্কিন দেশের মধ্যে যে নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হলো তা আফগানিস্তানের ঘাড়ে চলে এলো। রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা তালিবানদের নতুন করে ক্ষমতায় আনার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করলো চায়না। চায়না-পাকিস্তান অক্ষ তালিবানদের শক্তিশালী করে তুলে আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠিত সরকারকে আক্রমণ করতে সাহায্য করলো। যার ভেতর দিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা তালিবানদের দখলে চলে গেলো। এই সময়ে মার্কিন দেশ আফগানিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি রাশিয়া, ব্রিটেনসহ অনেকেই তালিবানদের সাথে আপোষ করে নিচ্ছে। আফগান নারীর ভাগ্যে আবার জুটছে তালিবানি শাসন।

আফগানিস্তান সমাজের এহেন অবস্থা কেন?

আফগানিস্তান হচ্ছে একটি “ল্যান্ড লক কান্ট্রি” অর্থাৎ কোন দিকেই সমুদ্র নেই। দেশটার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে হিন্দুকুশ পর্বতমালা, যে পর্বতমালা একদিকে ইরান থেকে অন্যদিকে তাজাকিস্তান অব্দি বিস্তৃত। গরমকালে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ওঠে আবার শীতকালে -৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অবধি নামে। দিনের বেলায় প্রচন্ড গরম ও রাতের দিকে ঠান্ডা। সারা বৎসর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে চাষবাস বেশি হয় না। প্রচন্ড জলের কষ্ট লেগে আছে সারা বৎসর ধরে। এতদসত্ত্বেও দেশটি বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে আবার খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখার গুরুত্বপূর্ণ একটা পথ। এই পথের কারণেই সবাই দখলদারি রাখতে চেয়েছে আফগানিস্তানের উপরে, ফলে একটি স্বাধীন দেশ হয়েও জাতি হিসেবে বিকশিত হতে পারেনি আফগান জনগণ।

দীর্ঘদিন ধরে সমাজটি বিভিন্ন ট্রাইবাল গোষ্ঠী হিসেবে ভেঙে রয়েছে ভেতর থেকে। ফলে ট্রাইবাল গ্রুপ গুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব একরূপ দখলদারি মানসিকতা রেখে দিয়েছে নিজেদের মধ্যে। এই দখলদারি মানসিকতাই কার্যত নারীদের জোর করে দখলে রাখার মানসিকতার জন্ম দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্ব  ট্রাইবাল গ্রুপগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে বলে, এই ট্রাইবাল গ্রুপ গুলিও টিকে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সাম্রাজ্যবাদের ভিতরকার বিরোধ ও দ্বন্দ্ব আফগান নারীর জীবনের গতিকে নির্ধারণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদ কখনোই একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে  আফগানিস্তানকে গজিয়ে উঠতে দেয়নি বলে আফগান নারীর জীবন মধ্যযুগীয় অন্ধকারে পড়ে রয়েছে। অথচ দেশটি খনিজ পদার্থ ভরপুর হলেও তাদের কাজে খুব লাগেনি। আমেরিকা, রাশিয়া সকলেই তাদের খনিজ পদার্থের উপর দখল নিয়েছে। এই দখলের সাথে ঘটেছে বনধ্বংস, যার ফলে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তাকে কমিয়ে দিয়েছে। এতে চাষবাস অবস্থার অবনতি ঘটেছে আরো দ্রুত। ফলে এক ধরনের ভবঘুরে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে, যা নারীর ওপর অত্যাচারকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী অর্থে গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলি একমাত্র যুবক শ্রেণীর অর্থ উপার্জনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সন্ত্রাসবাদি সংগঠন গুলিতে যুবকদের রমরমা দেখা গেছে একদিকে আর একদিকে পৃথিবী ব্যাপী সন্ত্রাসবাদী আক্রমণও বেড়েছে। নারীরা যত স্বামীহারা হয়েছে ততো নারীর জীবনে আরো বেড়ে গেছে মৌলবাদী শাসন।  বয়স্ক স্ত্রী থাকা সত্বেও যুবতী নারীকে বিবাহ করে নিয়ে আসা এ সমাজের আকছার ঘটনা। শুধু তাই নয়, ওই একই ঘরে বয়স্ক স্ত্রীকে থাকতে হয়- রাত কাটাতে হয়। আফগানিস্তানের যে সকল এলাকা তালিবান নিজের দখলে এনেছে, সেখানে তারা ঘোষণা করেছে -বিধবা ও অবিবাহিত নারীদের তাদের চাই তাদের যোদ্ধাদের জন্য। তাই আফগান নারীর এহেন অবস্থার জন্য মার্কিন দেশের আগ্রাসন নীতি অনেকাংশেই দায়ী।

কেন মার্কিন দেশের সৈন্য আজ আফগানিস্তান ছাড়ছে?

মার্কিন দেশের দুটি শত্রু আছে আজ আফগানিস্তানে- একটি তালিবান, আরেকটি নতুন শিক্ষিত সমাজ। শিক্ষিত সমাজ মার্কিন দেশের শত্রু হবে কেন? কেন মার্কিন সৈন্য বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ছে বলতে গিয়ে বাইডেন পরিষ্কারভাবে বলেছেন –  “US troop should not be used for nation building, but to fight and win war. Barack Obama and Donald Trump both promised not to get mired in nation building.”  কথা খুব পরিষ্কার আফগানিস্তানকে জাতি হিসেবে উত্থান তারা কিছুতেই হতে দিতে চায় না, তাহলে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চলবে কি করে। অন্যদিকে তালিবানদের মাধ্যমে চায়নার অনুপ্রবেশ সেটাও তারা চায় না। পুরনো সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও মার্কিন দেশ এই কারণেই আফগানিস্তানে তালিবানদের সাথে রফা করে নিয়েছে।

উপসংহার:

 মার্কিন দেশ আফগানিস্তান দখল নেওয়ার পর, চায়না তলে তলে তালিবানদের শক্তি যুগিয়েছে। ফলে মার্কিন সৈন্যবাহিনীর পেছনে খরচ প্রচুর বেড়ে গেছে। আজ মার্কিন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মার্কিন দেশের পক্ষে এই খরচ চালানো সম্ভব নয়। ফলে তারা ভেতরে ভেতরে তালিবানদের সাথে রফা করে নিচ্ছে। আবার উল্টোদিকে আফগানিস্তানের সরকারকেও তার দরকার এই চত্বরে চায়না বিরোধী অক্ষ ধরে রাখার জন্য। যার ফলে বারবার তারা চেষ্টা চালাচ্ছে আফগানিস্তান সরকার ও তালিবানদের মধ্যে শান্তি চুক্তি করে একটা সূত্র বার করা। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা বানচাল করে দিচ্ছে চায়না। ফলে এই এলাকার ভবিষ্যৎ কি হবে? তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে চায়না-তালিবান অক্ষ শক্তিশালী হওয়ার ফলে এই এলাকায় নারীদের উপর , গণতন্ত্রের উপর এবং শিক্ষিত মানুষদের উপর আক্রমণ বেড়ে যাবে।

তাহলে আফগানিস্তান দখল করার আগে তালিবানদের দ্বারা নারীদের উপর অত্যাচারকে সামনে এনে মার্কিন দেশ যে প্রচার গড়ে তুলেছিল, যে জনমত গড়ে ছিল সেগুলো আজ কোথায় গেল? যে চায়নায় দাঁড়িয়ে মাওসেতুং বলতো- নারীরা পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ। চায়না আজ সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথ ছেড়ে মার্কিন দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে তালিবানদের নিয়ে। এই দুই খেলোয়াড়ের খেলায় আফগানিস্তানের নারীর ভাগ্যাকাশে আজ মধ্যযুগীয় অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু আফগান নারীরা তাদের মতো করে সংগঠিত হবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের নারীদের আজ এই দিকে সহানুভূতি জানানো উচিত এবং একে সমর্থন করা উচিত। তবেই আফগান নারীর ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্যোদয় ঘটবে।

2 thoughts on “আফগান নারীর সংগ্রাম ও বিশ্বের নারীদের প্রতি আহ্বান”

  1. ।।তালিবানিস্থান-মৌলবাদ ও নারী নির্যাতন।।
    আফগানিস্তানে কুড়ি বছর পর আবারো তালিবান রাজত্ব ফিরে আসায় সবচেয়ে বেশি করে আক্রান্ত হবেন এবং হয়ে চলেছেন ওখানকার মহিলারা, ঘটছে মানবতার চূড়ান্ত অপমৃত্যু। তালিবানিরা স্বভাবতই নারী বিদ্বেষী। তাদের ফতোয়া- মেয়েদের আপাদমস্তক বোরখা ও হিজাবে ঢেকে গৃহবন্দী থাকতে হবে, তাদের আবার স্বাধীনতা, অধিকার ? কিন্তু এই মেয়েদেরই যৌনসঙ্গী নির্বাচনে তালিবানিদের বাধে না, শরিয়তি আইনে আটকায় না, বরং তা জোরপূর্বক ও বাধ্যতামূলক করা হবে। এখানেও মৌলবাদীরা বারবার ফতোয়া জারি করে — মেয়েদের জন্মই তো পুরুষের ভোগের জন্য। তাদের একমাত্র কাজ–সন্তান উৎপাদন, প্রতিপালন ও গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকা। তারা বাইরে বেরোবে কেন, চাকরি করবে কেন, নিজেদের পছন্দের পোশাক পরবে কেন?
    #আসলে দুই মৌলবাদীদেরই আদর্শ– নারী বিদ্বেষী, বিজ্ঞান ও যুক্তি বিরোধী, গনতন্ত্র ও স্বাধীনতার বিরোধী। তাই এখানেও দলিত মহিলাদের গণধর্ষণ করার ও খুন করার উচ্চবর্ণের অধিকার জন্মে যায়, অধিকার জন্মে যায় অন্য ধর্মের মানুষদের পিটিয়ে মারার। লাভ জিহাদের নামে সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, অথচ নারীদেরকে বিজ্ঞাপনে পণ্য হিসাবে ব্যবহার করতে আটকায় না।
    #তাই সব ধরণের মৌলবাদীদেরই সোচ্চারে বিরোধিতা করা দরকার নির্দ্বিধায়, মহিলাদের অধিকার ও গনতন্ত্র রক্ষা করা এবং মানবাধিকারের স্বার্থেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top