ডিজিটাল জুয়ার বিষাক্ত ছায়া: সমাজের চিত্রাবলী

খেলা শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং এটি মানুষকে পরিশ্রম ও সংগ্রামের মূল্য শেখায়। খেলোয়াড় হিসেবে সাফল্য অর্জন করতে গেলে কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। এবং মাঠের বাইরে যারা খেলা দেখেন তাদেরও বিশ্বাস থাকে যে সাফল্যের চাবিকাঠি হলো কঠোর পরিশ্রম।

ডিজিটাল জুয়া

বিজন পাল

আজকের সমাজে ডিজিটাল জুয়া বিস্তৃত ও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, যা আমাদের মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ক্রিকেট জুয়া, যা ক্রীড়াবিশ্বে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই ধরনের জুয়ার জনপ্রিয়তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এটি বিশেষত যুবকদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই লোভের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে বহু মানুষ নিঃশ্ব হচ্ছে এবং কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে আত্মহনের পথ বেছে নিচ্ছে। এই ন্যক্কারজনক পরিণতি আমাদের সামাজিক ঐতিহ্যকে বিপন্ন করছে।

     খেলা শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং এটি মানুষকে পরিশ্রম ও সংগ্রামের মূল্য শেখায়। খেলোয়াড় হিসেবে সাফল্য অর্জন করতে গেলে কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। এবং মাঠের বাইরে যারা খেলা দেখেন তাদেরও বিশ্বাস থাকে যে সাফল্যের চাবিকাঠি হলো কঠোর পরিশ্রম।

    খেলাধুলা শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক সংহতি, শৃঙ্খলা এবং সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক হাতিয়ার, যা ব্যক্তি ও সমাজের উন্নয়নে অপরিহার্য। খেলাধুলা মানুষকে একত্রিত করে এবং সম্প্রদায়গত বন্ধন শক্তিশালী করে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলকে একই মাঠে সমান সুযোগ দেয়, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলে। খেলার মাঠে নিয়মকানুন মেনে চলা, দলগত সমন্বয় এবং নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়। এটি সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গঠনে সাহায্য করে। যুবসমাজকে খেলাধুলার মাধ্যমে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখা গেলে মাদকাসক্তি, অপরাধ ও সহিংসতা রোধ করা সম্ভব। এটি সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। খেলাধুলা ন্যায্যতা, সহনশীলতা, সম্মান এবং দলগত প্রচেষ্টার মতো মূল্যবোধ শেখায়, যা একটি সুস্থ সমাজ গঠনের ভিত্তি।  

    কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কী? আজ খেলার আড়ালে এমন এক জুয়ার সংস্কৃতি বেড়ে চলেছে যা মানুষের মূল্যবোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করছে। জুয়ার লোভ মানুষের মনন এবং মানসিকতার উপর এক অন্ধকার ছায়া ফেলে দিয়েছে।

  আজকের খেলোয়াড়দের কাছে খেলাটা প্রধান নয়। এমন কি দেশ বা জাতির জন্য‌ও নয়। এখানে অর্থটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেটিংয়ের মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তি একটি দল বা খেলোয়াড়ের উপর বাজি ধরেন। যদি তাদের নির্বাচিত দল বা খেলোয়াড় জয়ী হয় তাহলে তাদের মুনাফা হয়, আর যদি হেরে যায় তাহলে লোকসান হয়। সাধারণত সকলেই শক্তিশালী দল অথবা খেলোয়াড়ের উপর বাজি ধরে। তাহলে সবাই যদি শক্তিশালী দলের উপর বাজি ধরে এবং সেই দল যদি জিতে যায় তাহলে বেটিং কোম্পানিগুলির লোকসান হ‌ওয়ার কথা। যদি এই কোম্পানিগুলি লোকসানে চলতে থাকে তাহলে এই সব কোম্পানিগুলি আর থাকার করা নয়। কিন্তু এই কোম্পানিগুলি রমরমিয়ে চলছে। এই কোম্পানিগুলির কাজ হল প্রথমে জেনে নেওয়া যে কোন দল বা খেলোয়াড়ের উপর বেশি বাজি ধরা হয়েছে। আজকের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তা নিমেষেই জানা সম্ভব। জেনে নেওয়ার পর বেশি বাজি ধরা দল বা খেলোয়াড়কে প্রভাবিত করতে পারলেই মুনাফা কোম্পানির ঘরে ঢুকবে। আমারা প্রায়‌ই শুনে থাকি বেটিং করতে গিয়ে অনেক খেলোয়াড় ধরা পড়েছে।

         আরেক দিকে এই খেলোয়াড়রাই বিজ্ঞাপনে দর্শকদের উৎসাহিত করে এই জুয়ায় অর্থ বিনিয়োগ করতে। খেলোয়াড়দের কাছে অর্থের প্রলোভনই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থের লোভ তাদের নিজেদের নৈতিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করছেন না। IPL-কে কেন্দ্র করে যেভাবে রমরমিয়ে বেটিং আর জুয়া চলছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। গত ২৩শে মে ২০২৫, একটী জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয় বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং কোটেশ্বর সিংহের বেঞ্চে। আবেদনে জানানো হয়েছে IPL-এর নাম করে যে জুয়া চলছে তা এখন নাম করা ক্রিকেটার থেকে বলিউড তারকারা প্রোমোট করছে। এখানে শচীন তেন্ডুলকর থেকে সৌরভ গাঙ্গুলী কেউই বাদ নেই। তারা সচেতন ভাবে জেনেশুনেই এই সব বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে শুধুমাত্র অর্থ রোজকারের জন্য। যাদের সমাজে নায়ক  হিসাবে দেখা হয় তাদেরই ইন্ধনে মানুষকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাদের আমরা যোদ্ধা, পরিশ্রমী, লড়াকু হিসাবে জানি। তাদের সাফল্য দেশ, জাতি ভাগ করে নেয়। আগেকার দিনেও আমরা দেখেছি যেসব খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপ জয় করেছেন তাদের এতো অর্থ ছিল না কিন্তু তাঁরা মানুষকে অর্থের জন্য জুয়ার রাস্তায় নিয়ে যাননি। আজকের নায়কদের আর নায়কের জায়গায় রাখা যাচ্ছে না। যার কাজ নেতৃত্ব দেওয়া তার বদলে তার সেই গুনকে পণ্য রূপে বাজারে বিক্রি করছে অর্থের বিনিময়ে।

সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল অ্যাপ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে। একটি প্রচার রয়েছে – “তুমি এখানে বিনিয়োগ কর, হয়ে যাও কোটিপতি।”

    আজ খেলা যেভাবে জুয়ায় পরিণত হয়েছে তাতে খেলা আর শুধু খেলার পর্যায়ে থাকছে না। খেলা উপভোগকারী দর্শকরা আগে যেখানে দলের জয়-পরাজয় নিয়ে চিন্তিত থাকতো, সেখানে আজ তারা জুয়ায় অর্থ বিনিয়োগের আনন্দে লিপ্ত।

        জুয়ার আসক্তি শুধু খেলাধুলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এতে সামাজিক সম্পর্কগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে। যেখানে আগে মানুষ শিক্ষা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথ অনুসরণ করতো, আজ সেই চিন্তাভাবনাও পরিবর্তিত হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এই ছবি সামনে আসে। অর্থ দিয়েই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। যোগ্য অযোগ্য তার বিচার করার দরকার নেই। যদি অযোগ্যরা টাকা দিয়ে সুযোগ পায়, তাহলে তাদের হাতে আগামী ভবিষ্যত কেমন তৈরি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের মা বাবারাও চাইবে যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করে সন্তানকে যোগ্য তৈরি করার। সর্বভারতীয় NEET পরীক্ষাতেও সেই ছবি দেখতে পেলাম। সমাজের সর্বত্রই এই ছবি বিরাজমান।

     আগে মানুষের মধ্যে যে সংস্কৃতি ছিল কাউকে না ঠকিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জন করতে হয় সেই ঐতিহ্য এবং সাফল্যের মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হচ্ছে। একজন ঘুষ নিয়ে ধরা পড়ার পর দল পরিবর্তন করে আবার শুদ্ধ হয়ে আগের মতো প্রভাবশালী থেকে যায়। সাংবাদ মাধ্যম যাকে চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়, সেটাও বিক্রি হয়ে বিভ্রান্তির খবর ছড়ায়। সঠিক খবর পরিবেশন করলে তাকে জেলে যেতে হয়ে।

      বর্তমানে আমাদের পরিবারগুলিতেও লোভের সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে। অর্থ যেভাবেই আসুক তার উৎস বিবেচ্য নয়, কেবল অর্থ হলেই চলবে। মানুষ মনে করে অর্থ থাকলেই জীবনকে উপভোগ করা যায়। এই কৃত্রিম ভোগের আকাঙ্খা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি বেড়েছে অর্থের লোভ। ফলস্বরূপ, উৎপাদনশীলতার পরিবর্তে সহজ পন্থায় অর্থ উপার্জনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মানুষকে।

     আজকের ডিজিটাল মাধ্যমগুলি আগ্রাসীভাবে এই জুয়ার সংস্কৃতিকে প্রসারিত করতে কাজ করছে। সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল অ্যাপ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জুয়ার বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে। একটি প্রচার রয়েছে – “তুমি এখানে বিনিয়োগ কর, হয়ে যাও কোটিপতি।” এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। কারণ মানুষের শ্রমে অর্জিত অর্থ চলে যাচ্ছে অন্য এক শ্রেণীর মানুষের হাতে, যারা শ্রম না করে অন্যের শ্রমে ভাগ বসায়। আবার এই অর্থ উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাবহৃত না হয়ে অনৎপাদক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সেখান থেকে প্রভূত মুনাফা অর্জিত হচ্ছে।       ডিজিটাল জুয়া মানুষকে নিঃস্ব করে চলেছে। এই বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। মানুষের জীবনে কর্মের গুরুত্ব এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যকেই মূল্য দেওয়া দরকার। শ্রম ও বিনোদন উভয়কেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমাদের প্রয়োজন সুস্থ প্রকৃতি, বিভেদহীন মানবিক সম্পর্ক ও আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটা সমাজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top