করোনা মহামারীর আবহে জামলো মকদমদের মর্মন্তুদ কাহিনী

পোস্টটি দেখেছেন: 132 মৌসুমী ঘোষ : সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ১২বছরের ছোট্ট মেয়ে  জামলোর মৃত্যুদৃশ্য ভাইরাল হয়ে গেছে। কিন্তু কেন মরতে হয় জামলোদের,কি কাজ করে ওরা? তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাটের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি -এপিল, এই সময় জুড়ে ডাক পড়ে খুদেদের। ওখানে লঙ্কা চাষের খুব রমরমা। গাছ লাগানো -পরিচর্যা- ফল তোলা- ঝাড়াই বাছাই করে প্যাকিং করা […]

মৌসুমী ঘোষ : সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ১২বছরের ছোট্ট মেয়ে  জামলোর মৃত্যুদৃশ্য ভাইরাল হয়ে গেছে। কিন্তু কেন মরতে হয় জামলোদের,কি কাজ করে ওরা? তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাটের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি -এপিল, এই সময় জুড়ে ডাক পড়ে খুদেদের। ওখানে লঙ্কা চাষের খুব রমরমা। গাছ লাগানো -পরিচর্যা- ফল তোলা- ঝাড়াই বাছাই করে প্যাকিং করা এবং গুঁড়ো লঙ্কা তৈরির কাজে প্রয়োজন পড়ে প্রচুর লোকের। বড় কৃষক বা ফার্ম  কোম্পানির মালিকরা খোঁজ করেন কম পয়সার শিশুশ্রমিকদের। যাদের হাতে কিছু পয়সা থুড়ি লাল লঙ্কা গুঁজে দিয়ে, একবেলা একপেটা খাবার দিয়ে তুলে নেওয়া যায় মাঠের সব কাজ। তাই লঙ্কা চাষের মোট কৃষিশ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি নিয়োগ করা হয় ১২ থেকে ১৪ বছরের খুদেদের। আর এই শিশু শ্রমিকদের যোগান অব্যাহত রাখেন সীমান্তবর্তী বিহার-ঝাড়খন্ড- ওড়িশার গ্রামগুলোর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতভাগ্য পিতা মাতার দল। সব জেনেও তারা বাধ্য হন তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের এইসব কাজে পাঠাতে। আমাদের জামলো ভূপালের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে আরো কিছু ছেলে মেয়ের সাথে পাড়ি দিয়েছিল তেলেঙ্গানার কান্নাইগুডা জেলার এক লঙ্কাক্ষেতে। পড়াশোনা বন্ধ রেখে শয়ে শয়ে শিশুদের ক্ষেতমজুরের দলের নাম লেখানোর প্রধান উদ্দেশ্য– তাদের পরিবারের সারা বছরের লঙ্কা যোগান দেওয়া।১২০ টাকার রোজ  হিসেবে তিনমাসে তারা পায় প্রায় এক কুইন্টাল লঙ্কা। অর্ধাহারে অপুষ্টিতে ভোগা এইসব পরিবারগুলির অন্যতম খাদ্য লাল লঙ্কা যা তাদের আধপেটা খাবারে কিছু পুষ্টির যোগান দিতে পারে।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস– জামলোরা পায় না দুবেলা পেট ভরা ভাত ডাল সব্জি। পরিযায়ী  শ্রমিকদের ঘরে ফেরার কোন ব্যবস্থা না করেই তড়িঘড়ি লক ডাউন ঘোষনা করে দেওয়ার ফলে বাড়ি  ফেরার দুর্দম বাসনায় জামলো তার সাথীদের নিয়ে পথে নেমে পড়ে। তিন দিন ধরে ১৫০ কিলোমিটার পথ হেঁটে খাবার এমনকি এক গ্লাস জল পর্যন্ত না পেয়ে ডিহাইড্রেশনে শুকিয়ে যাওয়া জামলো মকদমের শরীর বাড়ি থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে লুটিয়ে পড়ে। সংবাদপত্রে- খবরের চ্যানেলে কিছু হইচই হয়, কেউ কেউ কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন, হয়তো বা কিছু ক্ষতিপূরণ এর টাকাও পৌঁছে যাবে পরিবারের হাতে। কিন্তু জামলোরা আর ফিরে আসে না- তাদের শৈশব পড়াশুনা খেলাধুলা সব হারিয়ে যায় নিজেদের ও পরিবারের জীবনে একটু মসলার যোগান দিতে।

তথ্য বলছে- মোট শিশুশ্রমিকের ৬৯.৫ শতাংশই কাজ করে বিভিন্ন মসলার চাষ সহ  কৃষিক্ষেত্রের নানা কাজে (2013 report– “Findings on the worst forms of child labour” by the US Department of Labour)। অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রের  বেশিরভাগ কাজটাই তুলে নেওয়া হয় খুব কম মজুরিতে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ করে। “সেভ দ্য চিলড্রেন” সংস্থাটির রিপোর্ট  বলছে – মসলা চাষে কর্মরত শিশুদের ৪৪ শতাংশই স্কুলছুট এবং একই  সময় ধরে একই কাজে যুক্ত থেকেও বয়স্কদের তুলনায় শিশুশ্রমিকরা পায় তিরিশ শতাংশ কম মজুরি। গ্রীষ্মকালীন লঙ্কা চাষের কাজে যুক্ত খুদেরা সানস্ট্রোক,শ্বাসকষ্টের সমস্যায় জর্জরিত হয় বারে বারে। টকটকে লাল লঙ্কা খাওয়ার আগে একবার কি মনে পড়বে আধপেটা খেয়ে থাকা রোগ জর্জরিত এই শিশুগুলোর মুখ?

ILO ও ইউনিসেফের এক যৌথ বিবৃতি (১২.০৬.২০২০) থেকে জানা যাচ্ছে- করোনা মহামারী বিশ্ব জুড়েই শিশুশ্রমিকদের পড়াশোনার জগতে ভয়ানক প্রভাব ফেলবে। মহামারীর  বিশ্বজোড়া প্রকোপ, অর্থনৈতিক সংকট, অসংখ্য শ্রমিকদের কাজ হারানো, কম মজুরিতে বেশি সময় ধরে কাজ- সব মিলিয়ে একটা বড়ো অংশের জনগণের স্বাভাবিক জীবন যাপন ভয়ানকভাবে বিপর্যস্ত হবে। দুর্ভাগ্যবশত শিশুরাই সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে। লক্ষ লক্ষ সহজলভ্য ছোট ছোট  ছেলেমেয়েরা নতুন করে শিশুশ্রমিকদের  দলে নাম লেখাতে বাধ্য হবে বা পথেঘাটে ভিক্ষে করে বেড়াবে। উল্লেখ্য-ILO র পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ২২ কোটি শিশুশ্রমিকদের মধ্যে সাত কোটি শিশুই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত।

২০২১ সালকে “শিশু শ্রমিক নিরসনের আন্তর্জাতিক বর্ষ” হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ভারতবর্ষ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক বড় অংশ মানুষের  আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হলে, দারিদ্র না ঘুচলে, শিক্ষার আলো না পৌঁছালে বিশ্বজুড়ে শিশুশ্রমিকদের ভয়াবহ যন্ত্রণা কি এইসব দিবস, বর্ষ পালন করে,মন ভোলানো ভালো ভালো কিছু কথা বলে আদো কমবে? শিশুরা কি তাদের ধুলো কাদা কালিঝুলি মাখা হাত ধুয়ে ফিরে যেতে পারবে তাদের শিক্ষাঙ্গনে, তারা কি ফিরে পাবে তাদের শৈশব, খেলার মাঠ ? চিরতরে কি মুছে যাবে শিশুশ্রমিক নামটা?

4 thoughts on “করোনা মহামারীর আবহে জামলো মকদমদের মর্মন্তুদ কাহিনী”

  1. সন্তোষ সেন

    এই লেখাটি বেশ ভালো লাগলো। পরের সংখ্যার জন্য লেখা পাঠান।

  2. লেখাটি খুবই মর্মগ্রাহী এবং সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত। নিজের অভিজ্ঞতা ও কিছুটা বিভিন্ন সময বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা থেকে যা বুঝেছি তা হল, যতই আমরা ILO আর UNICEF এর কথা বোলিন কেন, এ রকমটা চলবেই । চেতনা জাগ্রত যে কবে হবে জানি না।

  3. মামনী পোদ্দার

    লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে পড়ে ভালো লেগেছে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top