কৃষি-আন্দোলন দিকে দিকে – একটি সমীক্ষা

পোস্টটি দেখেছেন: 52 তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য  আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নয়া কৃষিবিলের বিরুদ্ধে সারাদেশের কৃষক সমাজ উত্তাল । কৃষক এখন বুঝতে পেরেছে যে মধ্যস্বত্বভোগীদের অপসারণের আড়ালে সরকার পুরো কৃষিজাত ফসলকে  তার কর্পোরেট বন্ধুদের হাতে তুলে দিতে চায়। সারা ভারতের ২৫০ টি কৃষক সংগঠন নিয়ে গড়া মোর্চা “ অল ইন্ডিয়া কিষাণ সঙ্ঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি” (AIKSCC ) আগামী ২৫-২৬ নভেম্বর […]

কৃষি আইন

তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য

 আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি

নয়া কৃষিবিলের বিরুদ্ধে সারাদেশের কৃষক সমাজ উত্তাল । কৃষক এখন বুঝতে পেরেছে যে মধ্যস্বত্বভোগীদের অপসারণের আড়ালে সরকার পুরো কৃষিজাত ফসলকে  তার কর্পোরেট বন্ধুদের হাতে তুলে দিতে চায়। সারা ভারতের ২৫০ টি কৃষক সংগঠন নিয়ে গড়া মোর্চা “ অল ইন্ডিয়া কিষাণ সঙ্ঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি” (AIKSCC ) আগামী ২৫-২৬ নভেম্বর পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দিয়েছে । গত দু’সপ্তাহ ধরে পাঞ্জাবের কৃষকরা রেল লাইনের উপর ধর্না চালিয়ে যাচ্ছে। জানা গেছে যে পাঞ্জাবের কৃষকরা রিলায়েন্সের মল, পেট্রোল পাম্প এবং তাদের আউটলেটগুলি দখল করেছেন। আদানির শস্য গুদামগুলিতেও কৃষকরা একই কাজ করেছেন। কৃষিনির্ভর হরিয়ানা বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। অন্ধ্রে- গুজরাটে- মহারাষ্ট্রে- তেলেঙ্গানায় এর আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে । তেলেঙ্গানার হলুদ ও ভুট্টা চাষিরা MSP এর মাধ্যমে বিক্রয়ের গ্যারান্টি চায় । কেরলে ভ্যানিলা চাষিরা MSP এর জন্যে আন্দোলন করছে । ২০০২-০৩ সালে যেখানে কেজি প্রতি ৪ হাজার টাকা দরে ভ্যানিলা বিক্রি করেছে সেখানেই কোন বছর তাদের ৭০ টাকা দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে ভুট্টা চাষিরা ভুট্টাচাষে লোকসান করছে । ৬০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকার মধ্যে ভুট্টা বিক্রি হয় ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে । এসব ক্ষোভের জন্যে প্রত্যেক রাজ্যের চাষিদের  বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষিপ্তভাবে রাস্তা অবরোধ, ঘেরাও কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে । আমরা বিস্তারিতভাবে বুঝতে চাইব চাষিরা এই আন্দোলনে কেন?   

 ভারতে কৃষির কর্পোরেটাইজেশন নিয়ে গত ২রা অক্টোবর পরিপ্রশ্ন ওয়েব-পত্রিকায় আলোচনার ধারাবাহিকতায় বর্তমান লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা । যাঁরা এটা পড়েন নি তাঁদের  প্রয়োজনে এই লিঙ্কটি দিলাম বোঝার সুবিধের জন্যে। 

আমরা আলোচনা করব সরকার কিভাবে এই দীর্ঘ ৩০ বছরে সংস্কারের নামে চাষির কী ক্ষতি করেছে

১৯৯৫ সালে GATT কে সরিয়ে WTO সমস্ত বিশ্ব-রাষ্ট্রকে নিয়ে কৃষি চুক্তি করে তিনটি পয়েন্টে । ১) Domestic support ২) Export subsidy ৩) Market access. উন্নত দেশগুলিতে দানাশষ্য , চিনি, দুগ্ধজাত পণ্যতে ভর্তুকি  অনেক বেশী, যেমন কৃষিপণ্যের দামের উপর আমেরিকা ৭০০ গুণ ভর্তুকি বাড়িয়েছিল । অন্যদিকে ২০০০ সালে ভারতে কৃষিপণ্যের আমদানির কোটা তুলে দিতে বলা হয়েছিল । ইউরোপীয় ইউনিয়ন সর্ববৃহত কৃষিভর্তুকি প্রদানকারী। অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশ তৃতীয় বিশ্বে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার বৈশ্বিক চাপকে মান্যতা দেয়নি। তা সত্বেও ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি হয়েছে ক্রমশ , আর সেটা হয়েছে কৃষকের আত্মত্যাগেই ।

দেশের চাষিদের যা ক্ষতি

১) ২০১৬ সালে  কৃষিতে একশ’ শতাংশ FDI (প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ) সরকার লাগু করেছে ফলে কৃষিতে বিদেশী বৃহৎ পুঁজির অবাধ লগ্নি ঘটেছে। যে দেশের কৃষিজ রপ্তানি বৈদেশিক আয়ের ১১/১২ শতাংশ  । জিডিপি যেখানে -২৩.৯% সেখানে একমাত্র পজিটিভ গ্রোথ ৩.৪% কৃষিতে ।

২) ১৯৯২ সালে Fertilizer Corporation Of India Ltd. (FCI) যা ammonia, ইউরিয়া জাতীয় সার প্রস্তুত করত তাকে রুগ্ন ঘোষণা করে ২০০২ সালে বন্ধ করে দেওয়া হল ।

৩) দেশের বীজ পরীক্ষা ও সংরক্ষনাগারগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল। মনস্যান্টো কোম্পানির তুলো বীজ কিনে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে প্রচুর চাষি আত্মহত্যা করল এটা আমরা জানি ।

৪) জিএম খাদ্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বিটি শস্য যেগুলো কীটপতঙ্গকে মেরে ফেলতে সক্ষম সে সব শস্য মানুষের দেহেও বিষাক্ততা তৈরি করতে পারে। বিটি টক্সিন বিষাক্ততা সৃষ্টি করার জন্য যে পরিবেশ এবং নির্দিষ্ট রিসেপ্টর (Receptor) দরকার হয় তা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষতিকর কীটপতঙ্গেই আছে।

৫) কীটনাশকের বহুল ব্যবহারের ফলে উপকারি ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অনুজীবীদের, সেই সাথে ব্যাঙ মাছ ও অন্যান্য মেঠো প্রাণীকিট-পতঙ্গদের ধ্বংস করেছে ।

৬) জমির উর্বরতাশক্তি দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । মাটির নীচের জলের স্তর ক্রমশ নেমে যাচ্ছে , ফলে চাষের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্বেও সরকার যা বাস্তবায়িত করেনি

১) সি -২ Comprehensive Cost (বিস্তৃত ব্যয়) : এই ব্যয়টি A2 + FL এর বেশি, ২৪টি উৎপাদন খরচ ধরে ফসলের দাম নির্ধারন করা হয়। এই সূত্রটি কৃষকদের জন্য সেরা হিসাবে বিবেচিত হয়। এতে ঐ জমির ব্যয় (infrastructure cost) যুক্ত হয় যেখানে শস্য ফলন হয় । এর মধ্যে জমি ভাড়া এবং জমিতে কৃষিকাজে নিযুক্ত স্থায়ী মূলধনের সুদও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে মোট কৃষি মূলধনের সুদও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সরকার A-2 +FL এই ফর্মুলায় ৫০% সাপোর্টিং প্রাইস যুক্ত করে MSP দেয় । অর্থাৎ , C-2 ফর্মুলা ধরলে সহায়ক মূল্য ১৫% হয় , এটা সরকারের মস্ত চালাকি । অর্থাৎ সরকার পঞ্চাশ শতাংশ সহায়ক মূল্য দেয় না । এর উপর সরকারের ঘোষণা ছিল ২০২২ নাগাদ ফসলে ১০০ শতাংশ MSP দেবে সরকার । A-2 বা A-2 +FL এই খরচের হিসাব যা স্বামীনাথন রিপোর্টে বলা নেই ।      

২) নারেগা প্রকল্পকে  কৃষির সাথে সংযুক্ত করা -এই প্রতিশ্রুতিমতো  নারেগাকে কৃষির সাথে যুক্ত করা হয়নি।

৩) ২০১৫ সালে সরকার দেশের প্রতিটি খামারে সেচ নিশ্চিত করতে  জলেসেচের লক্ষ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কৃষিসেচ (Krishi Sinchai Yojana ) যোজনা চালু করে। প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ৫৩০০ কোটি টাকা দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ৫০০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। ভূমি সম্পদ বিভাগ  কিন্তু এর  ফলে কী লাভ হয়েছে তার রিপোর্ট আজ অবধি দিতে পারছে না।

৪) মনমোহন সিং সরকার প্রবর্তিত “বীজ-প্রবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে”র পুনর্মুল্যায়ন করা হয়নি ।

৫) ভারতের জৈব কৃষিকাজ ও সার কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। সরকার এখনও এ জাতীয় কোনও কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

৬) কৃষি মন্ত্রণালয় বীজ-পরীক্ষাগারগুলির সংখ্যা ১৩০ থেকে বাড়িয়ে ৭১৮৩ টি করার পরিকল্পনা করেছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোন লক্ষ্যই সরকারের নেই ।

৭) মিনিমাম সাপোর্টিং প্রাইস বা MSP-কে আইনি অন্তর্ভুক্তি না দিয়ে সরকার চাষিদের সাথে গদ্দারি করে যাচ্ছে । বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির সামনে চাষিদের অবাধ স্বাধীনতা যে থাকে না এটা একটা শিশুও বোঝে। চাষিকে ভ্যাল্যু চেন সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত করে একচেটিয়া বাজারের  মুখে ঠেলে দেওয়ার দায়বদ্ধতা পালন করছে সরকার ।

এছাড়াও সরকার ঘোষিত নীতি মোতাবেক যা যা করেনি তার মধ্যে আছে যেমনঃ- ক্লাস্টার ভিত্তিক স্টোরেজ সিস্টেম তৈরির জন্য সরকার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ভেষজ পণ্যগুলির মাধ্যমে রোটেশনাল কৃষিকাজকে বাড়ানোর এখনও পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেয়নি সরকার। সরকারের এই ঘোষণা-বুজরুকির সংখ্যা বাড়িয়ে তোলার ইচ্ছে আমার নেই ।

উপসংহারে

আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা বলেছে সারা বিশ্বের ৬০ শতাংশ শ্রমজীবীর আয় কমেছে । স্বাভাবিক ভাবেই দেশের ১৫ কোটি ক্ষেতমজুরের আয়ও নিম্নগামী । এর উপরে যদি চাষির বিক্ষোভ বাড়তে থাকে তাহলে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে । সারা বিস্বে কৃষিব্যবস্থাই ভর্তুকিতে চলে । আমেরিকার মতো উন্নত দেশে , জাপানের মতো উন্নত দেশে কৃষিতে সরকারি সহায়তা ব্যাপক , ভর্তুকির পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে সেখানে। অথচ আমাদের সরকার প্রতি বাজেট বরাদ্দে ব্যয় করে জিডিপির ০.৩ শতাংশ । আমেরিকায় জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্যে সরকার ক্ষতিপুরণ দিয়ে বছর অন্তর জমি অকৃষিযোগ্য ফেলে রাখে । আমাদের দেশে কৃষিঋণ নিয়ে চাষির হাঁসফাঁস অবস্থা । এই প্যান্ডেমিক পরিস্থিতিতে সরকার আরো ৬০ হাজার কোটি টাকা কিষান ক্রেডিট কার্ডে বরাদ্দ করল । অথচ কৃষিঋণের ব্যাঙ্কিং ইতিহাস বলছে , তিন বছর অন্তর কৃষিঋণকে পুনর্গঠন করে, মানে নন-পারফরমিং এসেট থেকে পারফরমিং এসেটে পরিণত করা হয়ে থাকে। ফলে ব্যাঙ্কঋণ চাষির আর একটি মৃত্যুফাঁদ ।

         বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া চাষির আর অন্য উপায় নেই । রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা ক্রমশ বাড়বে । অর্থনীতিতে কৃষির ১৬ শতাংশ অবদান , কৃষির রপ্তানি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে গোটা সমাজটাই পঙ্গু হয়ে যাবে । তাই অবাধ প্রতিযোগিতার মিথ্যা বুজরুকিকে নস্যাৎ করে একচেটিয়া পুঁজির বাজার অর্থনীতির নীতিকে গণ-আন্দোলনের তীব্রতায় বাতিল না করতে পারলে কৃষিভিত্তিক সমাজকে বাঁচানো যাবে না ।

লেখক পরিচিত

নাট্যকর্মী, পরিবেশকর্মী

tarash01@gmail.com

2 thoughts on “কৃষি-আন্দোলন দিকে দিকে – একটি সমীক্ষা”

  1. বিপ্লব ব্যানার্জি

    উন্নত দেশে কৃষির সঙ্গে যুক্ত নাগরিকের সংখ্যা, জিডিপি তে কৃষির যোগান, কৃষক প্রতি জমির পরিমাণ, সহ অনেক গুলো বিষয় আমাদের সাথে মিলে বলে মনে হয় না। পশ্চাৎপদ অর্থনৈতিক অবস্থা, শিল্পের যথাযথ বিকাশের অভাব, জমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ড, বিঘা প্রতি নিযুক্ত শ্রম, ইত্যাদি বিচার করে দেশের কৃষি নীতি গ্রহণ করা উচিত ছিল। তার বদলে রাষ্ট্র পুরো কৃষি ব্যবস্থা টাই কর্পোরেট হাতে তুলে দিতে উদগ্রীব।

  2. Manash Ranjan Ghosh

    প্রায় ৩০০ বছর আগের ইতিহাসের ঘটনা মনে পড়ল। মারাঠী বর্গীদের বেপরোয়া সংবদ্ধ লুঠপাট, সন্ত্রাসের ক্ষতচিহ্ন বাংলার মানুষের এখনও হয় তো মনে আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৌলতে সেই বর্গীরা আজ ভূবনময় সংবদ্ধ । রাজনৈতিক কতৃত্ব হাতের মুঠো করে নব সাজে সজ্জিত বর্গীরা দেশ জুড়ে ফিরে আসার অপেক্ষায়। ভারতের নয়া কৃষিবিল সেই রকম একটি ব্যবস্থা। যন্ত্র সভ্যতা নির্ভর কর্পোরেট দুনিয়া নানা সমস্যায় জর্জরিত। সমীকরণ অদল বদলেও মুনাফার রেখাচিত্র একটি সম্পৃক্ত অবস্থানে উপস্থিত। এই সন্ধিক্ষণে মুনাফালোভীরা কৃষি উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার উপর কতৃত্ব আরোপে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে চলেছে। আপনার লেখনী তে সেই চিত্র সুস্পষ্ট।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top