বাসুদেব মুখোপাধ্যায়
সমাজের প্রধানপ্রবাহে যেখানে আমরা বসবাস করি সেখানে দুই ধরনের পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্মপরিচয় রয়েছে এক নারী, দুই পুরুষ। এরাই সমাজের প্রধান দুটি লিঙ্গ। এই দুই ধরনের মানুষ সমাজ পরিবারে দুটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। জন্মানোর পর গড়ে ওঠার বয়স থেকে ক্রমশ আমরা উপলব্ধি করি আরও কিছু প্রকারের মানুষজন আমাদের মধ্যে রয়েছে। এরা নানা কারণে প্রধান প্রবাহে আসতে বাধা পাচ্ছে।
প্রশ্ন হল, এরা কী পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়? তারা কী প্রতিবন্ধী? প্রশ্ন হল, তাহলে কেমন করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ বিচার করা সম্ভব হয়? দেহ ও মনে যারা প্রতিবন্ধী তারাও কী এই দলে পড়ে? দেখা যাচ্ছে অন্য লিঙ্গের মানুষজনও আমাদের মধ্যে রয়েছে। যৌনক্ষমতার বিচারে এই অন্য লিঙ্গের মানুষজন অপূর্ণ। তাই এদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলা হয়, কারণ এরা প্রধান দুটি লিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত নয়।
এই দুটি লিঙ্গের কিছু কিছু ভূমিকা এরা পালন করতে অপরাগ। প্রধানত জিনগত কারণে এরা কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের পূর্ণতা পায়নি। এসবকে জন্মগত ত্রুটি-বিচ্যুতি বলা যায়, যা এদেরও বোঝানো হয়। এদের দেহে পুরুষ ও নারী উভয় লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ফলে কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ বিকাশ হয় না।
আমাদের সমাজে এমন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজনদের হিজরে বা নপুংসক বলা হয়। এদের ‘বৃহন্নলা’ও বলা হয়। এমন মানুষজনদের পরিবারে ও সমাজে মানিয়ে নিয়ে চলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এইসব কারণে তাদের সামগ্রিক অবস্থা জটিল ও কঠিন হয়, তা ক্রমাগত কঠিন হয় প্রধানত দারিদ্র্যের কারণে, নির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকায়। কেননা এরা প্রধানপ্রবাহ থেকে ছিটকে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ হয়ে দাঁড়ায়।
এরা প্রধানত মেয়েদের পোশাক পছন্দ করে। এদের আচার-আচরণও হয় নারীদের মতো, বলা যায় এরা এই আচরণ পছন্দ করে বেছে নেয়। কারণ পুরুষদের কাছে থেকে এরা বেশি পীড়ন পায়। তুলনায় নারীরা এদের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায়। আর্থসামাজিক বিচারে কখনই তারা পৃথক কোনো শ্রেণী নয়। এটাই স্বাভাবিক যে গরিব ঘরের হিজরেদের সব থেকে বেশি দুর্ভোগ পোয়াতে হয়। অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে তারা এমন পেশায় নিযুক্ত হয় যা সকলের বিরক্তি উৎপাদন করে।
অথচ চাইলে সমাজের যে কোনো উৎপাদনমূলক কাজে তারা অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রধানত ভেদভাবের জন্য আমরা তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ বানিয়ে ফেলি। এই কারণে দল বেঁধে তারা সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়। কোনো বিচারেই এই হিজরেরা প্রতিবন্ধী মানুষ নয়। যৌনক্ষমতা বিচার না করলে তারা আমাদের মতো পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
তাদের আর পাঁচজন মানুষের মতো ভাবতে হবে। এর জন্য ছেলেবেলা থেকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন প্রয়োজন। যৌনক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এদের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থাকে। এই কারণে এরা নিজেদের সমস্ত দিক থেকে বঞ্চিত মনে করে। আমাদের পরিবার বা সমাজ এদের নিচু চোখে দেখে। এই কারণেও এদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ থাকে।
এই সমস্ত নানা কারণে প্রধানপ্রবাহের সঙ্গে এদের ব্যবধান বাড়তেই থাকে। প্রথাগত প্রশিক্ষণ এবং দারিদ্র দূরীকরণ এদের পুনর্বাসনের সর্বাপেক্ষা বড় শর্ত। পরিবার ও সমাজে থেকে আমাদের শিখতে হবে কেমন করে আমরা এদেরকে মানিয়ে নিতে পারি। সমাজের প্রধানপ্রবাহের মধ্যেই এদের আত্মমর্যাদা ফিরে পেতে হবে। প্রধানপ্রবাহ থেকে সরে গিয়ে এরা কখনও কোনো স্বীকৃতি পাবে না, জীবনযাপনের রসদও পাবে না।
লেখক পরিচিতি:
লেখক- মনো-চিকিত্সক।
বিশিষ্ট সমাজ গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
Contact: Basudev98@gmail.com