প্রীতিলতা বিশ্বাস
মানুষের প্রাগৈতিহাসিক গোষ্ঠী সমাজে নারীর গুরুত্ব ছিল সমধিক। খাদ্য সংগ্রহের সেই পর্যায়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রাণিজগতের আর পাঁচটি প্রাণীর মতই। খাদ্যের অনিশ্চিয়তা, হিংস্র জন্তুর আক্রমণে প্রজাতির ক্ষয় তার নিত্যসঙ্গী। নারীর পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা তাকে টিকিয়ে রাখে প্রকৃতির কোলে, আর তাই সেদিন তার মাতৃত্ব ছিল পূজনীয়। খাদ্যসংগ্রহের পরবর্তী পর্যায়ে মানুষ হাতিয়ার তৈরী করতে শিখেছে। আর পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতায় গভীর জঙ্গলে শিকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই পর্যায়ে ঘটে নারী-পুরুষের মধ্যে প্রথম শ্রম বিভাজন। সন্তানসম্ভবা নারী বা নাবালক শিশুর মায়েরা ঝুঁকিপূর্ণ শিকারে না গিয়ে নিরাপদ স্থানে গেঁড়ি-গুগলি, ফল-পাকুড় বা কন্দমূল সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এই নিরাপদ গণ্ডির মধ্যে ঘোরা-ফেরা করতে করতে মেয়েরা একটি জিনিস আবিষ্কার করে ফেলে। ফলের বীজ থেকে চারা গাছ আর তার থেকে আবার ফল—এই চক্রটিকে তারা বুঝতে পারে। সেখান থেকে শুরু হয় মানব সভ্যতার প্রাথমিক কৃষিকাজ। কৃষি তাই নারীর আবিষ্কার এবং প্রথম অবস্থায় তারই দায়িত্ব। ওদিকে শিকারে যাওয়া পুরুষেরা কুকুর, গরু, ছাগল ইত্যাদির ছোট বাচ্চা না মেরে সঙ্গে করে নিয়ে আসত। ক্রমে তারা পশু প্রতিপালন এবং পুনরুৎপাদনের কাজটিও রপ্ত করে। শুরু হয় পশুপালন। পৃথিবীর সর্বত্র কৃষিকাজ ও পশুপালন—এই দুটি কাজ মানুষ একই ক্রমে শেখে নি। প্রকৃতি, পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কোনোটা আগে কোনোটা পরে শিখেছে। দুই ক্ষেত্রেই এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে মানুষের গোষ্ঠী জীবনে। এই প্রথম সে খাদ্য উৎপাদন করতে শিখলো, পেল উদ্বৃত্ত খাদ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা।
মাতৃতান্ত্রিক থেকে পুরুষতান্ত্রিকতায় যাত্রা
যে পরিবেশে কৃষিকাজকে মানুষ এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে সেখানে প্রয়োজন হয়েছে আরো অনেক কিছুর। গৃহনির্মান, মাটিরপাত্র, ঝুড়িবোনা ইত্যাদি সব কিছুই সেদিন শুরুটা হয়েছে মেয়েদের তথা মায়েদের হাতে। এমনকী এসবের জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ারগুলোও তারাই বানিয়েছে। আর শিশুদের সুস্থ-সবল করে বড় করা তো মায়েরই কাজ। সেই সূত্রে জড়ি-বুটির চিকিৎসায় হাতেখড়িও মেয়েদের কৃতিত্ব। তাই সেদিনের কৃষি নির্ভর এই সমাজগুলি ছিল মাতৃ প্রধান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমাদের প্রাচীনতম তিনটি সভ্যতা—সুমের, মিশর এবং হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো—প্রতিটিই ছিল কৃষি ভিত্তিক। যেখানে মানুষ আগে পশুপালন শিখেছে সেখানে কিন্ত তার জীবন হয়েছে যাযাবরের, আর তাতে থেকেছে পুরুষের প্রাধান্য। যদিও এই জীবনেও খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ঝুড়ি বোনা, পশুর চামড়া দিয়ে গায়ের আচ্ছাদন ইত্যাদি মেয়েরাই তৈরী করেছে।
খাদ্য নিরাপত্তা গোষ্ঠীগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজন এবং শ্রমবিভাজন দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। এই বিনিময় তার মধ্যে জন্ম দিয়েছে নতুন এক বোধের—মালিকানা বোধ। প্রাথমিক অবস্থায় এই মালিকানা ছিল গোষ্ঠী মালিকানা বা যৌথ মালিকানা। এই অবস্থায় মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিবাহ ব্যবস্থা ছিল অনেকটাই শিথিল প্রকৃতির। উন্নত পর্যায়ের কৃষিকাজে পশুর ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে প্রধান উৎপাদকের ভূমিকা গ্রহন করেছে পুরুষেরা। নারী হয়ে গেছে তার সহকারী, গৌণ। ক্রমে যৌথ-মালিকানা থেকে ব্যাক্তি মালিকানায় উত্তরোন ঘটেছে সমাজের। বিনিময় প্রথায় দেখা দিয়েছে মুদ্রার প্রচলন। গৃহ নির্মাণ, কুমোর, কামার ইত্যাদি সব কাজেই পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সন্তানের জন্ম দেওয়া ও তার প্রতিপালনের সঙ্গে অন্যান্য গৃহকাজ যেমন নারীরা সামলেছে, তেমনই ধান সিদ্ধ করে শুকানো, হাঁস-মুরগী ঘরে তোলা বা গরুকে খাবার দেবার মতো কাজ সেদিনও যেমন করেছে আজও তেমন গ্রামাঞ্চলের মায়েরা নিঃশব্দে করে থাকেন। কিন্তু অর্থনীতির নিরিখে এর কোনটাই উৎপাদনের আওতায় পড়ে না। মানব প্রজাতির পুনরুৎপাদন ও প্রতিপালনের মতো একটি কাজও কোন স্বীকৃতি ছাড়াই মেয়েরা করে চলেছে। সভ্যতার শৈশাবস্থায় যে স্বাধীনতা মেয়েরা ভোগ করত, ক্রমে ক্রমে তার সবটুকুই কেড়ে নেওয়া হয়। শ্রমবিভাজনের ফলে সমস্ত গৃহশ্রমের দায় তার উপর চেপে যায়, আর অন্যদিকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য তার উপর নেমে আসে কঠিন শৃঙ্খলার এক যাপন। যদিও পুরুষেরা তাদের বাইরের কাজের জগতে স্বাধীন এবং বহুগামীই থেকে যায়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র মেয়েরা এই পর্যায়ে গৃহবন্দী এবং অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভশীল জীবন-যাপনে বাধ্য হয়েছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে গুপ্ত যুগ থেকে উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নারীরা বিশেষতঃ বর্ণ হিন্দু নারীর জীবন ছিল দুর্বিষহ। এই প্রসঙ্গে পরে আবার ফিরবো।
শিল্প- বিপ্লবের যুগে নারী
১৭৬০—১৮৪০ এই সময়কালকে বলা হয় বৃটেনের শিল্প-বিপ্লবের যুগ। বৃটেনের শিল্প-বিপ্লব নারীকে গৃহশ্রমের বাইরে বৃহত্তর শ্রমের আঙিনায় নিয়ে এসে ফেলল। বস্ত্রশিল্পে বহু মহিলাকে নিয়োগ করা হলো। এছাড়াও কারখানার বিভিন্ন কায়িক শ্রমে তাদের নিযুক্ত করা হতে লাগল। এই নিয়োগের প্রধান কারণ পুরুষের তুলনায় অনেক কম মজুরিতেই নারীদের দিয়ে ভালো কাজ পাওয়া যেত। শিক্ষাগত দক্ষতা না থাকায় বৌদ্ধিক শ্রম থেকে তাদের দূরেই রাখা হল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীরা প্রথম প্রবেশের সুযোগ পায় ১৯৪৭ সালে। শিল্প-বিপ্লবের এটা ছিল প্রাথমিক সামাজিক অভিঘাত। শিল্প-বিপ্লবের হাত ধরে যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকাশলাভ করে তার বিশ্বব্যাপী বাজার দখলের লড়াই-এ বিংশ শতকের প্রথমার্ধে গোটা বিশ্ব আন্দোলিত হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধকালীন সময়ে পুরুষেরা যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার কারণে অনেক বেশি পরিমানে নারীরা যুক্ত হল বাইরের শ্রমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়ে যখন উপনিবেশগুলি থেকে সরাসরি হাত গুটিয়ে নিতে হল ইউরোপকে তখন মহিলাদের তুলনামূলক সস্তাশ্রমে নিয়োগ কিঞ্চিত বৃদ্ধি পেল। বাইরের শ্রমে থাকলেও তার গৃহশ্রমের দায়িত্ব কিন্ত কোন অংশে কমে নি। আর মাতৃত্বের দায়িত্ব তো তাকেই বহন করতে হবে। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে বড়জোর গৃহে একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করা সম্ভব হতো, যদিও ইউরোপে এখন আইন করে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আজও মানব সমাজে প্রয়োজনীয় কায়িক শ্রমের ৬০ শতাংশ মেয়েরা করে। শ্রমের দুনিয়ায় সস্তা হিসাব পা রাখতে দিলেও রাজনৈতিক আঙিনায় নারী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পায়নি বহুদিন। ইউরোপের প্রতিটি দেশেই নারীর ভোটাধিকার পেতে অনেক দেরি হয়। রেনাসাঁসের দেশ ফ্রান্সেই মেয়েরা ভোটাধিকার পায় ১৯৪৬ সালে।

রামমোহন বিদ্যাসাগরের যুগে ভারতবর্ষের মেয়েরা
এবার পুনরায় আসব ভারতের নারী সমাজ প্রসঙ্গে। রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮২৯ সালে হওয়া সতীদাহ নিবারণ এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্যোগে ১৮৫৬ সালে হওয়া বিধবা বিবাহ আইন বাংলা তথা ভারতীয় সমাজ সংস্কারে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ক্রমে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে উদার মনস্ক মানুষেরা নারী শিক্ষার কাজে এগিয়ে আসেন। বিশ শতকে ভারতীয় নারীরা যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছে তেমনই গৃহকাজের সঙ্গে বাইরের কাজের জগতেও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। আজও তার ধারাবাহিকতা চলছে। এতদসত্বেও মর্যাদা পায়নি তার গৃহশ্রম, তার মাতৃত্ব। আজও মেয়েকে বিয়ের পর শশুরবাড়িতে থাকা-খাওয়ায় বেঁচের থাকার জন্য বাবাকে দিতে হয় মোটা অংকের পণ। তবুও শেষ রক্ষা হয় না বহু ক্ষেত্রেই। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা ভারতে পণের জন্য বধূহত্যার ঘটনা ৭০০০ ছাড়িয়ে গেছে।
পুঁজিবাদী সমাজে মেয়েদের অবস্থান
শ্রমজীবী মানুষের মজুরি নির্ধারিত হয় তার পরিবারসহ জীবন চালাতে যে পরিমাণ ব্যয় হতে পারে তার হিসাবে। এখানে একজন শ্রমিক একদিন কারখানা থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে পরেরদিন পুনরায় কাজ করার শক্তি সঞ্চয় করার জন্য গৃহে যে সকল পরিষেবা দরকার হয় তার কোন মূল্যই হিসাব করা হয় না। পারিবারিক বন্ধন নামক গালভরা কথার ফাঁকি দিয়ে তা নিঃশব্দে চাপিয় দেওয়া হয় বাড়ির মহিলাদের উপর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান, পরিবার নামক এককটি তাই ভীষণ প্রয়োজনীয়। ভবিষ্যত শ্রমিকের উৎপাদন ও প্রতিপালনও এই পরিবার নামক ছত্রছায়ায় হয়ে যায়। বহুক্ষেত্রে পুরুষেরা সম্পূর্ণ দায় মায়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়। আবার সেই পুঁজিবাদই অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রমের যোগানদার হিসাবে নারীকে টেনে আনে বাইরের শ্রমের জগতে। নারীর শ্রমটুকুই শুধু শোষনের বিষয় নয়, তার শরীর, তার গোটা অস্তিত্বকেই পণ্যে পরিণত করে পুঁজি। তাই নানান পণ্যের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় তার অর্ধনগ্ন শরীর। আর দেহ-ব্যবসাকে তো বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা। যৌথ কৌম সমাজ ভেঙে যখন পরিবার ভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠে তখনই নাকি শুরু হয় এই ব্যবসা। জীবিত অবস্থায় তার দেহের মাংস বিক্রি হয়, কতবার তার হিসেব নেই। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ নারীর যৌনতাকে কেন্দ্র গড়ে তুলেছে সেক্স–ট্যুরিজমের মতো ব্যবসা। রেহাই পায় নি তার মাতৃত্বও। সারোগেটারি মাতৃত্ব এখন একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। আবার কখনও শ্রমজীবী নারীকে কাজ হারাবার ভয়ে বিসর্জন দিতে হচ্ছে তার জরায়ু। পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর শোষনের চিত্র নানাবিধ।

বিশ্বায়নের যুগে পুঁজির চলন হয়েছে অবাধ। তেমনই শিল্প-বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ে ল্যাপটপ আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজকের প্রজন্মের নারী ঘরে বসেই পা রাখছে বিশ্বের শ্রমবাজারে। উনবিংশ শতকের সমাজ সংস্কারের হাত ধরে যে নারী বাইরের কাজের দুনিয়ায় পা রেখেছিল তার সঙ্গে এই নতুন প্রজন্মের নারীর মননে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন প্রকাশ পাচ্ছে সামাজিক দ্বন্দ্বরূপে। ভারতীয় সমাজে যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ চোখে পড়ে শাবরীমালা বিতর্কে। কেরলের চিরকুমার ব্রহ্মচারী দেবতা আয়াপ্পার মন্দির শবরীমালাতে এতদিন ১০-৫০ বছরের নারীর অর্থাৎ প্রজননক্ষম নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এযাবৎকাল নারী এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ধর্ম তার রজঃস্বলা অবস্থাকে দূষিত, অপবিত্র ভাবতে বাধ্য করেছে, যা কিনা মনুষ্য প্রজাতির ধারাবাহিকতাকে অক্ষুন্ন রাখে। এই প্রজন্মের শিক্ষিত নারী তা আর মানতে রাজি নয়। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে আইন করে এই নিয়ম রদ করলেও সমাজে পিতৃতন্ত্র তথা প্রাচীনপন্থার সঙ্গে যুক্তিবাদের বিরোধ আজও চলছে। শিক্ষার হার শতকরা ১০০ শতাংশ যে রাজ্যে সেখানেও সমাজ ভাবনায় এই পিছুটান। অথচ ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে, যেখানে এখনও আদিবাসী সমাজ অনেকাংশে অক্ষুন্ন আছে এবং পুঁজির দৌরাত্ম সেইভাবে থাবা বসাতে পারে নি, সেই অঞ্চলে কামরূপ কামাক্ষ্যায় অম্বুবাচীতে দেবীর রজঃস্বলারূপই পূজিত হয়। অর্থাৎ নারীর মাতৃরূপের উৎস এই সমাজে তার হিউমিলিয়েশানের কারণ হয় না। যদি খাশি, গারো ইত্যাদি উপজাতির সমাজ জীবন লক্ষ্য করা যায় তাহলে দেখব এখানে শ্রমবিভাজনে নারী আছে বাইরের শ্রমে, অর্থনীতির কেন্দ্রে। কিন্তু সেই সমাজে পুরুষ নিপীড়িত, অবদমিত এমন খবর আমার অন্তত জানা নেই। নারীর দ্বারা পুরুষের অবদমনের কোন কাহিনী অতীত সমাজের পুরান কথাতেও কখনও শোনা যায় না।
পরিশেষে
তাহলে এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে যে, সমাজ জীবনে এগিয়ে আসা, প্রাথাগত শিক্ষা, তথাকথিত স্বাধীনতা নারীর জীবনে কী অর্থ বহন করে? পুঁজির দ্বারা শোষিত হওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠা, নাকী পণ্যের বাজারে মূল্যবান হয়ে ওঠা!! ইতিহাস বলে যে, অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ যত বিকশিত হয়েছে সমাজ জীবনে পিতৃতান্ত্রিক প্রাধান্য তত বৃদ্ধি পেয়েছে। পুঁজির সাধনায় মানুষ কেবলই ধ্বস্ত করেছে প্রকৃতিকে, জল-জমি-জঙ্গল—সবের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে। মানুষ ভুলেই গেছে এই প্রকৃতির মালিক সে নয়, পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সুস্থ প্রকৃতিকে তুলে দেওয়ায় তার বাঁচার শর্ত। সেই রকম পুরুষও সমাজে তার আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে ভুলেই যায় নারীর জীবন বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠার অর্থ পরবর্তী প্রজন্মের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠা। সমগ্র জীবকূল, প্রতিটি অনুজীবানু, পাহাড়, সাগর, নদী নিয়ে গঠিত যে প্রকৃতি মানুষ তার অংশ মাত্র। সমাজ জীবনেও নারী পুরুষের সহনাগরিক। কোথাও কারও উপর কারও আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্ন আসে না। প্রকৃতি ও নারীর পুনরুৎপাদনই এই জীব বৈচিত্র্যময় জগত সংসার এবং মানব সভ্যতার উৎস। তাই নারী ও প্রকৃতির সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার উপরেই নির্ভর করবে আগামীদিনে মানব প্রজাতির টিকে থাকা।।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞানের ছাত্রী, গণিতে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন এক দশকের উপর। বর্তমানে প্রবাসী এবং ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে জানা বোঝায় আগ্রহী।
যোগাযোগ:
ভারতীয় সভ্যতা সম্বন্ধে লেখিকার মতামত আরও জানতে পারলে ভাল লাগত।