অন-লাইনেই আছি দাদা

পোস্টটি দেখেছেন: 87 অনিরুদ্ধ দত্ত : করোনা লাঞ্ছিত সময়ে একটা শব্দবন্ধ ‘অনলাইন ক্লাস’,  অনেকেই জেনে গেছি । তা সে বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক। পরিস্থিতি  এমন যে কেবল  শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্কের  খাঁজে-খন্দে নয়, অনলাইন এডুকেশন নিয়ে কথা  আপন আপন ঢঙে সব মহলের আলোচনায় পৌঁচেছে।  শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রয়োজনে সহায়ক সামগ্রীর ব্যবহার  চক আর ডাস্টারে দীর্ঘদিন […]

অনিরুদ্ধ দত্ত : করোনা লাঞ্ছিত সময়ে একটা শব্দবন্ধ ‘অনলাইন ক্লাস’,  অনেকেই জেনে গেছি । তা সে বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক। পরিস্থিতি  এমন যে কেবল  শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্কের  খাঁজে-খন্দে নয়, অনলাইন এডুকেশন নিয়ে কথা  আপন আপন ঢঙে সব মহলের আলোচনায় পৌঁচেছে।

 শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রয়োজনে সহায়ক সামগ্রীর ব্যবহার  চক আর ডাস্টারে দীর্ঘদিন আটকে ছিল।  এখনো তা স্কুল-কলেজের ক্লাসরুমে, তুলনায় অনেক বেশি ব্যবহৃত। তবে অবস্থার বেশ কিছুটা পরিবর্তন এসেছে ‘পেডাগজি’র আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে।  টি.এল.এম (টিচিং লার্নিং মেটেরিয়াল) শব্দটা শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই জানেন যদিও তার ব্যবহার নেহাতই কম । বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই  এল. সি. ডি প্রজেক্টর মাধ্যমে  স্লাইডসহ  বিষয়কে বোঝানোটা শিক্ষার্থীদের যে আকর্ষণ করে তাতে সন্দেহ নেই।  কিন্তু  সে আয়োজনে খামতি আছে নানা কারনে। বিদ্যালয় বা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেটের ব্যবহার, যতটা কম্পিউটার শিক্ষার সিলেবাসের অংশ, টি. এল. এম হিসাবে তা তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। এর থেকে আর একটু এগোতে পারলে স্মার্ট ক্লাস, নিদেনপক্ষে স্মার্ট বোর্ড ।

এই সমস্ত ব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হ’লো একটা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দুতরফেরই শারিরীক  উপস্থিতি এবং পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া । অনলাইন নামে সম্প্রতি দাপিয়ে বেড়ানো পদ্ধতিটি এসবের চেয়ে গুণগতভাবে আলাদা। চালু শিক্ষা-আদর্শের সামনে তাই এটা একটা চ্যালেঞ্জ।

শিক্ষা বা সোজাসাপটা বললে পড়াশুনা, সে তো কেবল একজন মানে শিক্ষক পড়াবেন আর ছাত্রছাত্রীরা কান পেতে নিশ্চলভাবে শুনবে এমনটা নয়। এখানে চোখে- চোখ  রাখাটাও খুব জরুরী কারণ তা শিক্ষার্থীদের মনের আয়না।

অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাটিতে পাঠক্রমের মত শিক্ষক- শিক্ষার্থী  উভয়ই অস্পর্শকারী (intangible) । কোন নির্দিষ্ট শ্রেণিকক্ষ নেই, শিক্ষার্থী ধরা ছোঁয়ার বাইরে।  অন্যান্য শিক্ষা সহায়ক সামগ্রী নিদেনপক্ষে চক ডাস্টারের ব্যবহার খুবই কম। বইখাতা না থাকলেও চলবে।  চাই এমন একটা ফোন যা অ্যান্ড্রয়েড ধরনের সফটওয়্যার ব্যবস্থা ধারণ করতে পারে এবং অবশ্যই থাকতে হবে ছেদহীন ইন্টারনেট  সংযোগ । করোনা অধ্যুষিত সময়ে, লকডাউন পর্বে, ঘরে আটকে থাকাটাই নিয়মসিদ্ধ। যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দীর্ঘ দিন বন্ধ, শিক্ষার্থী শিক্ষকের মধ্যে  অনলাইন ব্যবস্থায় পাঠদান- পাঠগ্রহণ একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। লকডাউনের সময় এর কোন বিকল্প নেই , অন্যথায় সমস্ত পাঠদান ব্যবস্থাটি দীর্ঘদিন বন্ধ রাখাটাই হবে কর্তৃপক্ষের তরফে একমাত্র সিদ্ধান্ত। অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাকাজ পরিচালনার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকা যেমন কথাগুলো পৌঁছে দিতে পারছেন, অন্যদিকে  স্ক্রিন শেয়ার ইত্যাদির মাধ্যমে স্লাইড ব্যবহার করতে পারছেন পড়ানোর প্রয়োজনে। এমন কি চাইলে ভিডিও ক্লিপিংসও। তাছাড়া বোর্ড বা খাতায় লিখে তা বোঝানোও সম্ভব। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রশ্ন পাঠাতে পারছে চ্যাট বক্স এর মাধ্যমে অথবা সরাসরি প্রশ্ন করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই পাঠাতে পারছেন নোটস। ক্লাসরুম শিক্ষার পরিপূরক ব্যবস্থা হিসাবে এই অন- লাইন ব্যবস্থাটি খুব কম শিক্ষা পরিচালকেরই মাথায় ছিল এযাবত। লকডাউন সে ব্যবস্থাকেই করলো সর্বেসর্বা, একমেবদ্বিতীয়ম।  ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার, অনলাইন পড়াশুনার মধ্যে দিয়ে সোচ্চারে প্রদর্শন করছে তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষমতার একটা দিক।

তবু প্রশ্ন আছে এবং প্রশ্ন উঠছে। কিছু প্রশ্ন উঠছে  চালু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুষঙ্গে, বাকীটা  আজকের শিক্ষাদর্শনকে  নিয়ে। আলোচনার টেবিলে নয়, বাস্তবিকই কাঠগড়ায় আজ অনলাইন- এডুকেশন।

শিক্ষা বা সোজাসাপটা বললে পড়াশুনা, সে তো কেবল একজন মানে শিক্ষক পড়াবেন আর ছাত্রছাত্রীরা কান পেতে নিশ্চলভাবে শুনবে এমনটা নয়। এখানে চোখে- চোখ  রাখাটাও খুব জরুরী কারণ তা শিক্ষার্থীদের মনের আয়না। সেইজন্য শ্রেণিকক্ষে ( গাছতলাও হলেও) একটা  মুখোমুখি ব্যাপার থাকে যা জরুরি । ডিজিটাল ব্যবস্থায় এই ত্রিমাত্রিক অবস্থানটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তার সঙ্গে অনুপস্থিত ক্লাসের জানালার ফাঁক দিয়ে আসা তির্যক রোদ্দুর, কাছেই গাছের ডালে বসা ছটপটে পাখিটার ফুরুত- ফুরুত ওড়া, দূরের খেলার মাঠ, দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়েই ছুট্টে পালানো নীচু ক্লাসের দুষ্টু ছেলেটা। আর এসব মিলিয়েই তৈরী হওয়া মানবিক পরিবেশটাই তো শিক্ষার অক্সিজেন যা এখনো শিক্ষার ধুকপুকানি চালিয়ে নিয়ে যায়। ডিজিটাল ব্যবস্থা এখানে হেরে ভূত। ক্লাসে পড়ানোর  স্বকীয় পদ্ধতি নিয়ে অনেক ইতিহাস তৈরী হয়ে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত এমন অনেক নাম যা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। আঞ্চলিকস্তরেও আকর্ষণীয় এমন শিক্ষক – শিক্ষিকা পাওয়া যায় অনেক। আর এসবেরই যোগফলে মহাবিদ্যালয়ে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় কিছু ক্লাসে বেঞ্চ ভর্তি  অথচ অন্য ক্লাসে তা খালি ( স্কুলে সুযোগটা কম)। অন-লাইনে আমাজন, ফ্লিপকার্ট  কারুরই এই পাঠদান নামের ইনট্যাঞ্জেবল এসেটটির সাপ্লাই চেন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অনলাইন এডুকেশন এখানেও দুয়ো খাবে। বরং অনলাইন এই স্বকীয়তার উপর কড়া নজরদারি চালিয়ে মুড়ি- মিছরি এক করতে চাইবে পাঠদানকে, জ্ঞান-শ্রমিকের শ্রম

হিসাবে। কেন্দ্রীয়  সার্ভারের ‘ বিগ বস ওয়াচিং ‘ এর সামনে ক্লাসরুমের মতো করে পাঠ্যবস্তুকে দেশ-কালের নিরিখে উল্টেপাল্টে দেখাটা অনলাইনে নেহাতই অসম্ভব। কারণ সমস্ত এপিসোডটি কোথাও অলক্ষ্যে রেকর্ড হতে থাকে যা চাইলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা সময়ে ব্যবহার করা সম্ভব। অথচ পাঠ, প্রধানত সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ, এভাবে না এগিয়ে নিতে পারা মানে অনলাইন শিক্ষা গিয়ে মিলবে রাষ্ট্র নির্দেশিত ‘হ্যাঁ’-এর বদ্ধজলায়। অবশ্য এমন চাওয়াটাই  আজকের দস্তুর, অনলাইন এডুকেশন নিয়ে তাই এত উদ্যোগ। সেই প্রয়োজনে আগামীদিনে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট যোগাযোগ ইত্যাদি সরকারী সাহায্যে অনেকটা কম খরচে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো অসম্ভব নয় । তখন পরিবারের একমাত্র উপার্জ্জনশীল দুধেল গাইটি বিক্রি করে সন্তানের জন্য একটা স্মার্টফোন কিনতে বাধ্য হওয়া অথবা ফোন না থাকায় পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ার আতঙ্কে আত্মহত্যার ঘটনা কমবে । কমবে ‘ডিজিটাল ডিভিসন’ (https://www.thestatesman.com/opinion/digital-divide-indias-education-1502899472.html )।

 বেসরকারি দেশি – বিদেশি বিনিয়োগ গড়ে ওঠার প্রয়োজনে এই জমি তৈরী করে দেওয়াটা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব।  চালু অর্থনীতির দাবীও তাই। সদ্যঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতির ( National  Education Policy) ভালোকথার ভাঁজে-ভাঁজে তা খুবই স্পষ্ট

(https://www.thehindu.com/education/the-hindu-explains-what-has-the-national-education-policy-2020-proposed/article32249788.ece)।

এরপরেও  থেকে যাবে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’।

এ দেশে শতকরা ৬০ ভাগের বেশী মানুষই অবয়বধারী প্রাণী, দারিদ্র যাদের মহান তো করেই নি বরং যারা ভুখা পেটে রাতে ঘুমোতে যায়। সরকারী চাল-গমের বদান্যতায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটলেও শিক্ষা আর ‘মিড ডে মিল’ এদের কাছে সমার্থক। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় এদের উপস্থিতি অপ্রাসঙ্গিক। ক্রেতা হয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এই অংশের জন্য বরাদ্দ নয় (হাতে পরিবারপিছু টাকা দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহা স্পষ্ট)। প্রান্তবাসী থেকে ধীরেধীরে  অন্তজ হয়ে যাওয়াটাই যেন ভবিতব্য। শিক্ষার আঙিনায় যতদিন থাকবেন এই পরিবারের সন্তান-সন্ততি, তাদের পেটের জন্য থাকবে ‘মিড ডে মিল’। আর  মাথার জন্য বরাদ্দ হবে শিক্ষানীতি নির্ধারিত গো-চোনা আর গো-মলের বিজ্ঞান, হাতে- কলমে গোনাইল প্রস্তুতি (vvm.org.in)। জ্ঞান- অর্থনীতির অনুষঙ্গে মোবাইল-ইন্টারনেট অধ্যুষিত অনলাইন এডুকেশন চলবে এদের বাদ রেখেই National Exclusive Policy হিসাবে। জ্ঞান অর্থনীতির পথ এদের থেকে  ‘গেছে বেঁকে, গেছে বেঁকে……’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top