হর্ষ দাস: করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। কোয়ারান্টাইনে যেতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ব মানব সমাজ। মানুষ মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ককে ঘরবন্দী করে পরিত্রাণের পথ হাতড়াতে হচ্ছে। যে পৃথিবীর আঙিনা ছিল মুক্ত, অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্র, আদানপ্রদানের ক্ষেত্র তাই আজ ভাইরাসের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত। প্রকৃতির হাতে এই ভাইরাসকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে যাতে সে বিস্তার লাভ করতে না পারে। অতএব মানুষের গৃহবন্দী হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই নেই।
এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে গৃহবন্দী হয়েও মানুষ এই সঙ্কটের আড়ালে থাকা প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধানে মনোযোগ দিচ্ছেন না। সাধারণ মানুষ আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে মিডিয়ার খবরে নিজেকে সঁপেছেন, অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী মহল চীন মার্কিন খেলা দেখায় ব্যস্ত। বাণিজ্য যুদ্ধে নিজের লাগাম মজবুত করতে কে এই ভাইরাসকে কাজে লাগিয়েছে, এই সত্য খোঁজার কী সার্থকতা? কী লাভ? আসলে অনুসন্ধান চলছে দুই সুপার খুনীর মধ্যে খুনটা কে করল? জানতে পারলেই যেন কেল্লা ফতে! সব সমাধান!
বাস্তবে আজ করোনার হাত থেকে বাঁচলেও কাল আরও মারাত্বক কোনও ভাইরাস যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে আক্রমণ করবে মানব জাতিকে। মর্টালিটি রেট হয়ত আরও অনেক অনেক বেশি হবে। একথা পরিষ্কার মানবসভ্যতা আজ আক্রান্ত। কিন্তু আসল কারণটা কী? ভাইরাস সংক্রমণ এবং তার এই বিস্তারের পেছনেও তো কারণ আছে। সেই কারণ খোঁজায় মন না দিয়ে আমরা মেতে উঠছি পক্ষ অবলম্বনে। নিজেদের ভাগ করে নিচ্ছি দুই খুনীর মধ্যে।
মানব সভ্যতার অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে ৩৯ ট্রিলিয়ন মাইক্রোবস-এর উপর ভিত্তি করে, আমাদের চর্তুদিকে যে হিউম্যান মাইক্রোবায়োমের চাদর গঠন হয়েছে তার উপর। আমাদের চতুর্দিকে এবং শরীরের মধ্যে যত মাইক্রোবস আছে তার সংখ্যা আমদের শরীরে যতো কোষ আছে তার অনেক গুন। ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের মাইক্রোবস। ৩০ ট্রিলিয়ন মানব কোষের মধ্যে ৩৯ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আছে। এরা আমাদের শরীরের পরিচালনা ও প্রতিরক্ষার কাজে সাহায্য করে। এরই মধ্যে ২০ বিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া (মাইক্রোবস) ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এর ফলে তৈরি হয়েছে ফাটল মাইক্রো বায়োম শৃঙ্খলে। এই ফাটল বা গর্তের ভেতর দিয়েই ঢুকে পড়ছে অন্য প্রাণীর ভাইরাস মানুষের শরীরে। ব্যাপারটা দাঁড়ালো এইরকম এই যে ২০ বিলিয়ন বন্ধু ব্যাকটেরিয়া যা মাইক্রো বায়োমের অংশ (constituent) যা আমাদের রোগ সংক্রমণ থেকে আগলে রাখে তাকেই ধ্বংস করা হল অথচ তার কোনও অনুসন্ধান আমরা করলাম না। কেন ? কীসের স্বার্থে?
পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ল কেন? এর কারণ যুদ্ধ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহযোগিতার বিপরীতে প্রতিযোগিতার জন্য মানুষ যখন বিশ্বযুদ্ধে মেতে উঠেছিল ঠিক তখনই বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল রাসায়নিক ও অটোমোবাইল শিল্পের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই রাসায়নিক শিল্প কৃত্রিম সার ও ওষুধ তৈরির ব্যবসায় মনোনিবেশ করল আর অন্যদিকে অটোমোবাইল শিল্প পৃথিবী ব্যাপী ডলার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে নেমে পড়ল। সোনা থেকে যখন ডলারকে মুক্ত করা হল ডলার নিজের শক্তি বাড়িয়ে তুলতে নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করল তেলের উপর। খনিজ তেল ডলার ছাড়া কেনা সম্ভব নয়। অন্য মুদ্রায় কিনতে গেলেই মারণ থাবা। হাল হবে সাদ্দাম হুসেনের মতো।
এখন দেখা যাক, এই দুই শিল্পের বিকাশের পরিণাম কী?
১। গাছ কৃত্রিম সারের মাত্র ১৮% কাজে লাগায়। ফলে অব্যবহৃত বাকিটা মানে ৮২% সমুদ্রে গিয়ে মেশে বৃষ্টির জলের মধ্যে দিয়ে।
২। ডলারের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে খনিজ তেলের ব্যবহার বহু মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে। ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ গিয়েছে বেড়ে। পরিণাম পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। মাইক্রোবায়োম তৈরি হওয়ার পেছনে সমুদ্রের ব্যাপক ভূমিকা আছে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অ্যালগি বা সামুদ্রিক শ্যাওলা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এই সামুদ্রিক শ্যাওলা পৃথিবীর জীবকুলের ৯০% খাবার ও ৬০% অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে মাইক্রোবায়োমের অংশগুলি দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে।
অল্প কথায় এই কারণেই এই ভয়াবহ সঙ্কট
এই সংকটের কি পরিত্রাণ নেই? প্রযুক্তি আছে কিন্তু হাতেগোনা কিছু মানুষের স্বার্থে তা প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। জিন প্রজেক্টের সময় যখন জিন-ম্যাপিং করা হল ঠিক তখনই এই বাস্তবতা সামনে চলে আসে। যেসব বিজ্ঞানীরা এই প্রয়োগের পক্ষে সরব হয়েছিলেন তাদের ইকো টেররিস্ট দাগিয়ে মার্কিন দেশ- তাদের হয় বন্দী করে অথবা খুন করে। ব্যবসায়িক কারণে জিন প্রজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই কুড়ি বিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া নতুন ভাবে তৈরি করে যদি মাইক্রোবায়োমের চেনটিকে সুরক্ষিত করার দাবি উঠত, তাহলে পৃথিবীর থেকে সুগার, ক্যানসার, ব্লাডপ্রেসারের মতো রোগ কমে আসত। এমনকি নির্মূলও হতে পারত। এই নিত্য নতুন ভাইরাস আতঙ্কে দিন কাটাতে হতো না। কিন্তু ট্রিলিয়ন ডলারের ওষুধের বাজারকে জীবন্ত করতে গিয়ে প্রকৃতিকে করা হয়েছে জীবনের অযোগ্য। তাই আজ যখন কলকারখানা, স্কুল, কলেজ বন্ধ করে গৃহবন্দী হয়ে ইটালির মানুষ বাঁচতে চাইছে, তখনই ডলফিনের দল ইটালির সমুদ্রে ফিরে আসছে পলিউশন কমে যাওয়ার জন্য।
উৎপাদনের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক যেহেতু নিবিড় তাই উৎপাদনকে অবশ্যই হতে হবে প্রকৃতি-কেন্দ্রিক। অথচ এত বিপর্যয়ের পরেও আজকের উৎপাদন ব্যবস্থা মুনাফা-কেন্দ্রিক। এইজন্যেই মার্কিন চীন যুদ্ধ ও ভাইরাসের আক্রমণ।
এইখানেই দাঁড়িয়ে আছে আসল শত্রু। এই শত্রু অবিলম্বে চিহ্নিত হওয়া দরকার।