কর্পোরেটের স্বার্থে গোয়ার প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংসের মুখে: গোয়ানিজরা আন্দোলনের পথে

পোস্টটি দেখেছেন: 33 সন্তোষ সেন আমাদের দেশের সবচেয়ে ছোট রাজ্য “সানসাইন  স্টেট অফ ইন্ডিয়া” গোয়ার কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে- উত্তর থেকে দক্ষিনে সমুদ্রতট বরাবর অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত বারোটি সমুদ্র সৈকত, সমুদ্র- তটে মনমাতানো সূর্যোদয়ের ছবি, খাওয়া-দাওয়া,হই হুল্লোর। যেটা অনেকেই ভুলে যান যে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার একাংশ গোয়া পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ বারোটি জীববৈচিত্র্যে […]

goa

সন্তোষ সেন

আমাদের দেশের সবচেয়ে ছোট রাজ্য “সানসাইন  স্টেট অফ ইন্ডিয়া” গোয়ার কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে- উত্তর থেকে দক্ষিনে সমুদ্রতট বরাবর অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত বারোটি সমুদ্র সৈকত, সমুদ্র- তটে মনমাতানো সূর্যোদয়ের ছবি, খাওয়া-দাওয়া,হই হুল্লোর। যেটা অনেকেই ভুলে যান যে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার একাংশ গোয়া পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ বারোটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর “বায়োডাইভারসিটি হটস্পট”- এর মধ্যে অন্যতম। কর্পোরেটদের আরো আরো মুনাফার স্বার্থে নৈসর্গিক গোয়ার জীব-বৈচিত্র্য, ইকোলজি, ঐতিহ্য- সংস্কৃতি ধ্বংসের মুখে। এর বিরুদ্ধে গোয়ানিজরা আন্দোলনে মুখরিত। গত বছরের নভেম্বরের শুরুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি খবর সামনে আসে, যে খবর পেটোয়া সংবাদমাধ্যমে জায়গা পায় না। পয়লা নভেম্বর পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ ‘চাঁদর’ রেললাইনের উপর বসে পড়েন, যার মধ্যে মহিলা এমনকি শিশুদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। রাত দশটা থেকে পরের দিন সকাল পাঁচটা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রতিবাদে গোয়াবাসিদের মূল দাবি– ছিন্নমস্তা উন্নয়নের নামে গোয়ার জীব-বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করা চলবে না।

কাদের স্বার্থে কিসের উন্নয়ন:

যখন আমাদের দেশ সহ সারা পৃথিবী করোনা আতঙ্কে ঘরবন্দি, লকডাউন চলছে পুরোদমে, ঠিক তখনই (৭ই এপ্রিল) পরিবেশ ও বনমন্ত্রক (MoEF)  ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ড লাইফ (NBWL) এর কর্তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সিং- এর মধ্য দিয়ে গোয়াতে তিনটি প্রকল্পের ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন। সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র বিবর্ণ এই দেশ! এই ব্যবস্থার মধ্যেও চালু থাকা ছিটেফোঁটা আইনকে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক পরিবেশ বিধ্বংসী ছাড়পত্র দিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। এইসব ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রতিবাদ আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য এপ্রিল মাসেই নতুন করে এনভাইরনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (EIA-2020) বিল নিয়ে এলো পরিবেশ মন্ত্রক। কী কী  উন্নয়নের খতিয়ান পেশ করা হল এক নজরে দেখা যাক। গোয়ায় তিনটি প্রকল্পকে সামনে আনা হল– রেললাইনের সম্প্রসারণ, NH4A জাতীয় সড়ক আরো চওড়া করা এবং 400 kV  বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার স্থাপন।

কেন গোয়া বিপন্ন:

 আদানি আম্বানি জিন্দলদের সাধের এই প্রকল্পগুলি গড়ে উঠবে “ভগবান মহাবীর স্যাংচুয়ারি” এবং Mollem জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে। এর ফলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫৯,০০০ (হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন উনষাট হাজার) গাছ চিরতরে নির্বাসিত হবে প্রকৃতির বুক থেকে, উদ্বাস্তু হবে বা প্রাণে মারা পড়বে কয়েক হাজার পাখি, বন্যপ্রাণ ও মানুষের বন্ধু অনুজীবের দল। ভারতবাসী আগামী দিনে প্রস্তুত থাকুন আরো বেশি বেশি জুনোটিক ভাইরাসের সংক্রমনের মোকাবিলায়। ১৭০ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল তছনছ করে এইসব কর্মকাণ্ড চালু হয়ে গেছে। ফলে এর মধ্যেই গোয়াতে কয়লা সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ, কয়লার গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ছে রেললাইনের আশেপাশের গ্রামগুলিতে। ফলে স্থানীয় মানুষজনের কফ- কাশি, শ্বাসকষ্ট সহ ফুসফুসের নানান রোগ বেড়ে গেছে বহুল পরিমাণে।

একটা ছোট উদাহরণ তুলে ধরি পাঠকদের কাছে। গোয়ার এরোসিম অঞ্চলে ত্রয়োদশ বর্ষীয় এক বালক শ্বাসকষ্টের সমস্যায় মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। এই শিশুটির মা (Ella Mascarenhas) সিদ্ধান্ত নেন- এখানে আর নয়, গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে একটা নিরাপদ (!) আশ্রয়ের খোঁজে করতেই হবে এবার। একমাস পর তাঁর  উপলব্ধি আমাদের চমকে দেয়। তিনি বলেন-” নিজের পরিবারকে বাঁচাতে শহরে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করার ক্ষমতা ছিল আমার, কিন্তু যে সমস্ত মায়েরা / বাবারা এই ব্যবস্থা করতে পারবেন না তাদের কি হবে?” তাই তিনি ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থেকে গেছেন এবং গোয়ার পরিবেশ আন্দোলনের এখন তিনি একজন সক্রিয় কর্মী।

কর্পোরেট ও তার সেবাদাস রাষ্ট্র কি চাইছে:

নতুন নতুন ক্ষেত্রে বহুজাতিক কর্পোরেটদের পুঁজি বিনিয়োগ ও আরো আরো মুনাফার ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রগুলি এখন মরিয়া। এর জন্য জল জঙ্গল জমিন লুঠ, প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস ও মানুষের জীবন বিপন্ন করা- কোন কিছুতেই তাদের হাত কাঁপে না।

তাই নয়া কৃষি- আইনে চুক্তি চাষের মধ্য দিয়ে বেনিয়াদের মর্জিমাফিক অর্থকরী চাষ ও বিদেশে তার রপ্তানির ব্যবস্থা করা। এই আইন লাগু হলে কৃষকরা আরো বেশি করে জমি থেকে উৎখাত হবেন। অর্থকরী ফসলের অতি উৎপাদনের জন্য হাইব্রিড বীজ, অতিরিক্ত জলসেচ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বহুল ব্যবহার প্রকৃতিকে আরো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। কৃষিব্যবস্থা, কৃষক, দেশের মানুষ উচ্ছনে যায় যাক- পুঁজির সঞ্চয়ন ও মুনাফাই বড় কথা। তাই কৃষকদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েও সরকার পিছু হটতে রাজি নয়। কারণ পিছু হটলে আদানি আম্বানিদের মনোবাসনা পূরণ হবে না। কেন্দ্রীয় ও নানান রাজ্য সরকারের মূলমন্ত্র হলো কর্পোরেটদের মর্জিমাফিক চলা ও সমস্ত কিছুর বিনিময়ে তাদের পাহাড় প্রমাণ মুনাফার বন্দোবস্ত করা। এই আলোকেই দেখতে হবে পরিবেশ ধ্বংস করে গোয়া সহ নানান রাজ্যে তথাকথিত উন্নয়নের প্রকল্পগুলিকে।

 গোয়ার উন্নয়ন:

গোয়ার উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতেও তিন হাঙ্গর বহুজাতিকের নাম উঠে এসেছে- আদানি গ্রপ, জিন্দাল গ্রুপ ও বেদান্ত লিমিটেড। পুঁজিপতিদের সেবাদাস সরকার অনেক আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছিল। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সাগরমালা’ প্রকল্পে গোয়ার প্রধান বন্দর মরমুগাও পোতের ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। যাতে করে ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৫১০ লক্ষ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করা যায়। আসলে কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে আদানি ও আম্বানি গ্রুপের স্টিল ফ্যাক্টরি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা জোগান দেওয়ার জন্যই বিদেশ থেকে জাহাজে আনা কয়লা গোয়া বন্দর দিয়ে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে গোয়াকে কোল-হাব হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তাই জাতীয় সড়ক ও রেল লাইন সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা। একেই বলে value-added chain -এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে বিশ্ব গ্রামে পরিণত করার উদার অর্থনীতি।

গোয়ার মানুষজন কী ভাবছেন:

 গত বছরের এপ্রিল থেকে মূলত অনলাইন ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আমরা দেখলাম পয়লা নভেম্বর কয়েক হাজার মানুষের রেললাইনে রাতব্যাপী ধর্না। প্রকল্পগুলি বাতিল করার দাবিতে গোয়ানিজদের আন্দোলন জারি আছে নানান ধারায় নানান দিশায়। আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী, যুবা বাহিনী ও সমাজের নানান স্তরের মানুষ। উল্লেখ্য, পঞ্চাশের বেশি বিজ্ঞানী, গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড  কমিটির (CEC) কাছে ছাড়পত্র পাওয়া প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে তাদের গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। সাধারন গোয়াবাসিদের সাথে বিশিষ্ট মানুষজন কেন এত উদ্বিগ্ন? আসলে প্রকল্পগুলি রূপায়িত হলে গোয়ার জীববৈচিত্র্য ও ইকোলজি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হবে। কয়েক হাজার বছর ধরে টিকে থাকা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এই জঙ্গল চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে ইতিহাসের গর্ভে। পরিবেশের উপর যার ভয়ানক প্রভাব পড়বে।

অগাস্ট মাসে NBWL-এর প্রাক্তন সদস্য ও লেখক প্রেরণা বিন্দ্রা CEC কে লিখেছেন-” Under section 38(O) of the Wildlife protection Act,1972 forest diversion can’t be allowed for ecologically unsustainable use, except in public interest with the approval of NBWL on the advice of National Tiger Conservation Authority and it appears that these were not referred to the NTCA despite this area being an important Tiger habitat”.

বর্তমান পরিবেশ মন্ত্রকের বিরুদ্ধে প্রাক্তন সরকারি আমলার বেশ গুরুতর অভিযোগ। বাঘেদের করিডর হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটিকে জানানোই হয়নি।

কয়েক শত মানুষের এরকম হাজারো আবেদন-নিবেদনের উত্তরে শক্তি ও পরিবেশ দপ্তরের মন্ত্রী জানিয়েছেন -” শিক্ষক আইনজ্ঞদের সাথে সাধারণ মানুষ যারা প্রতিবাদ করছেন তারা এমনভাবে বলছেন যেন পুরো অভয়ারণ্যটি ধ্বংস হয়ে যাবে। গাছ কাটা পড়বে ঠিকই (উন্নয়নের স্বার্থে), কিন্তু প্রতি একটি কেটে ফেলা গাছের পরিবর্তে তিনটি করে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা হবে”। কি হাস্যকর যুক্তি। হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা ঘন সবুজ জঙ্গল ও জীব-বৈচিত্র্যকে কি তৈরি করা যায় মন্ত্রী প্রবর?

করণীয় কী:

গোয়াতে আন্দোলনকর্মীরা স্পষ্ট ভাবে বলেছেন- “নিজেদের জীবন বাঁচাতে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শন আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার”। ঠিকই তো, গণতন্ত্র বা অধিকার শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নয়। মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা, স্বাস্থ্য-শিক্ষার সুব্যবস্থা, পরিবেশ রক্ষার দাবি সমাজ সচেতন যুক্তিবাদী মানুষ করবেনই।

সময়ের দাবি- কর্পোরেটের ক্রীড়নক রাষ্ট্র ও তাদের ধামাধরা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে লড়তে হলে এবং

বহুজাতিক কর্পোরেটের সর্বগ্রাসী মুনাফার কবল থেকে নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে

সমাজে জারি থাকা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্দোলন, নারী-নির্যাতন ও প্রবল নারী-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নারীদের আন্দোলন, নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের লড়াকু মনোভাবকে শ্রম আইন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে শ্রমিক (তথ্য-প্রযুক্তি  ও পরিযায়ী শ্রমিক সহ) আন্দোলনের সাথে মেলাতে হবে। শতফুল একসূত্রে গেঁথে এক বড় মালা তৈরীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সভ্যতার টিকে থাকার প্রশ্নটি।

তথ্যসূত্র:

https://www.thehindubusinessline.com/blink/cover/anti-coal-handling-protests-in-goa-gain-momentum/article33356217.ece

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।

Contact: santoshsen66@gmail.com

1 thought on “কর্পোরেটের স্বার্থে গোয়ার প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংসের মুখে: গোয়ানিজরা আন্দোলনের পথে”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top