সুপর্ণা দে
“ইকোলজি” বা “ইকোসিস্টেম” শব্দটি আজ আমাদের শহুরে জীবনে ভীষনভাবে জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক । বিশ্ব আজ থমকে দাঁড়িয়েছে । করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাসে স্তব্ধ বিশ্ববাসী । কেউ বলে এই ভাইরাস মনুষ্য সৃষ্ট ,আবার কারোর মতে প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছ অত্যাচারের ফলপ্রসু মানুষ পেয়েছে এই মারন ভাইরাস। সে যাইহোক, সে তুল্যমূল্যের বিচার করবার জন্য রয়েছেন বিঞ্জানীমহল রাষ্ট্রব্যাবস্থা ও অনেক জ্ঞানীগুনী জন। আমার আলোচনার বিষয় অন্য–আমাদের জীবনাভ্যাস ও আমাদের ভবিষ্যৎ পরিবেশমুখী জীবন গঠনের দিশা।
এই দিশার একমাত্র জীয়নকাঠি ইকোলজি বা ইকোসিস্টেম । এই শব্দব্রহ্মটির শক্তি অপরিসীম – বসুন্ধরার যত জীবন্ত প্রাণ আছে তাদের ধারক ‘ইকোলজি’। যদি এই শব্দটির বাংলা অর্থ করি তাহলে বলতে হয়- জীবনবাণী । এই’জীবনবাণীর’ প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝিনা কিন্তু ওরা বোঝে !
একদিকে প্রত্যক্ষ পরিবেশ দূষণ অন্যদিকে পরোক্ষভাবে রোগ ,মহামারী , দুরারোগ্য ব্যধিকে আমরা সবাই মিলে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি । যদিও পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে নেতৃত্ব দান করছে ১০০ টির মত বৃহৎ কোম্পানী। আধুনিক সভ্যতা সৃষ্ট পর্বতপ্রমান এই দূষনের তলদেশে বসে ভোগবাদী মানুষ নিজের আত্মসুখে প্রকৃতিকে ভুলেছে। তাই বোধ হয় রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর বলেছিলেন
–“হে নব সভ্যতা ,হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী ,দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি ।“ দুঃখের বিষয় পরিনতি ভয়ঙ্কর জেনেও আমরা অন্ধের মতো সে পথেই এগিয়ে চলেছি । দিশেহারার মতো আমরা ছিঁড়ে ফেলছি সেই প্রাচীন ও চিরন্তন জীবন – জীবিকার ছন্দবদ্ধ সুতোগুলোকে। নীরব ভাষায় আমাদের সাবধান করে চলেছে ওরা ও অন্যান্য প্রাণীজগৎ । জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের অভ্যাসে । শুধুমাত্র অর্থিনীতীর দাসত্ব করা আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ও ভবিষ্যৎ বাণীতে বোধ হয় আমাদের আচ্ছন্ন মোহগ্রস্থ শহুরে অভ্যাস বশ মানবে না। এবার একটু ভাবুন , শিক্ষিত ও চিন্তাশীল আধুনিক আমরা কোনদিকে চলেছি ?
আদিবাসী সমাজ ও প্রকৃতি কেন্দ্রিকতা
পরিবেশ রক্ষায় আজও ওরা এগিয়ে-ওরা আদিবাসী। প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য তারা তথাকথিত অগ্রগতির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে, তার প্রমাণ আমাজনের আদিবাসী সমাজ ,আন্দামানের জাড়োয়ারা। বিশ্বজুড়ে বহু আদিবাসী সমাজ সভ্যতার অগ্রগতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিকে বাঁচিয়েছে। হয়ত ওদের মতো করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব”। ভারতবর্ষেই আমরা দেখি ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের কাছথেকে ছাড়পত্র পেয়ে বেদান্ত অ্যলুমিনিয়াম লিমিটেড- নিয়মাগিরী পাহাড় ধ্বংস করে কারখানা গড়তে চেয়েছিল কিন্তু ওখানকার আদিবাসী সমাজ তা হতে দেয়নি। কোনো অর্থনৈতিক প্রলোভন ওদের পথ রোধ করতে পারেনি। ঠিক একই ভাবে অন্য রকম আর এক প্রতিবাদ দেখি কর্ণাটকের কোকরেবেলুর গ্রামে – দেশি পাখি পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ওখানকার আদিবাসী সমাজ। বর্তমানে কর্ণার্টকের কোকরেবেলুর গ্রামে পাখি সংরক্ষন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তা ওখানকার আদিবাসীদের জন্যই – এগুলো কি প্রমান করেনা আদিবাসীদের চিন্তাচেতনার গভীরতাকে ?
উড়িস্যা, বিহার, ছোটনাগপুরের আদিবাসীরা নিজেদের ঘর নিজেরাই বানায় , ইটের বদলে তারা মাটির দেওয়াল গড়ে। বিশ্বায়নের যুগেও ওরা ওদের নিজস্ব পরম্পরাগত চাষের পদ্ধতিতে চাষবাস করে চলেছে – রাসায়নিক সারের পরিবর্তে পরম্পরাগতভাবে জৈব সার ব্যবহার করে এরা প্রমান করেছে আদিবাসী সমাজ কতটা পরিবেশমুখী। আদিবাসী জনগোষ্টীর মানুষের মধ্যে তথাকথিত শিক্ষার অভাব থাকলেও , কোন গাছের থেকে কোন ঔষধ তৈরী হয় তা তারা জানে ও নিজেদের রোগ নিরাময়ের জন্য নিজস্ব চিকিৎসাপদ্ধতি তারা ব্যবহার করে । অরুনাচলপ্রদেশের বহু আদিবাসী গাছ-গাছড়া থেকে ঔষধ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে। ওখানকার বাসিন্দাদের কাছে সে ঔষধগুলি খুবই জনপ্রিয় , যদিও মেডিকেল সায়েন্সে এই ঔষধের মান্যতা দেয়নি। সে বিষয়ে কোন দ্বন্দ্ব উত্থাপন আমার লক্ষ্য নয়। আমার লক্ষ্য– আমাদের চারপাশের প্রতিবেশীদের জীবনাভ্যাসের চিত্র তুলে ধরা। আদিবাসীরা পরিবেশ দূষণকারী ইউক্যালিপটাস গাছকে বর্জন করেছে । তারা জানে এ গাছে পাখি বাসা বাঁধেনা ,গাছের নীচে ঘাস জন্মায় না ,পরিবেশের অবক্ষয় ঘটে – এসব তথ্যের সত্যতা বিজ্ঞান অবশ্য অনেক পরে মেনে নিয়েছে । আদিবাসী মানুষেরা মহুয়া গাছের যত্ন নেয়, শালগাছকে পূজো করে। ধামসা মাদলের ছন্দে আদিবাসীরা মেতে ওঠে ‘’ শারুল’’ পরবে বা শালগাছের পূজায় । এদের বিয়ের অনুষ্ঠানে গাছ একটি গুরুত্বপূ্র্ণ অঙ্গ। বর বিয়ে করতে যাওয়ার আগে আমগাছকে ও কনে মহুয়াগাছকে বিহা করে । গাছ দেবতার পূজা করে এরা যে কোন শুভ কাজ করে । সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় উৎসব সাহরাই — নতুন ফসলকে কেন্দ্র করে এই উৎসব । আসুন না আমাদের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী চিন্তাশীল বিবেচনাবোধ নিয়ে পরম্পরাগত আদিবাসী সংস্কৃতির দিকে একটু ফিরে তাকাই……….।
পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের সচেতন করতে হচ্ছে , বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে কিন্তু অরণ্য ভূমিশ্রীর এই সব পু্ত্র-পু্ত্রীদের কোন সচেতনতার প্রয়োজন নেই । মজার বিষয় তারা যা কিছু করে তার সাথে ব্যক্তিগত ভালোমন্দের বিশেষ যোগ নেই । আত্মসুখের জন্য প্রকৃতির নিয়ম, সমাজর নিয়ম এরা ভাঙে না, ব্যক্তিমালিকানা তত্ত্বে এরা বিশ্বাসী নয়। আদিবাসী সমাজ বংশপরম্পরায় প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ওরা প্রকৃতই অরণ্য ভূমিশ্রীর পুত্র-পুত্রী , ওদের জীবনবৃত্তের কোন শাখাই প্রকৃতিহীন নয়। আমাদের জীবনকে পরিবেশমুখী করে তোলার সময় হয়েছে – আজ থেকেই ভাবতে হবে…অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে ।
তথ্যসুত্র :
বুদ্ধিজীবীর নোটবই: সম্পাদক – সুধীর চক্রবর্তী।
বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ: সম্পাদক-
ড. দুলাল চৌধুরী।
ঝাড়গ্রাম নিউজ অ্যান্ড ইনফরমেশন ।
লেখক পরিচিতি:
লোক সংস্কৃতির গবেষক ও পরিবেশ কর্মী এবং নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত।
চমৎকা। এই বিষয়ে আরো জানার আশা রাখলাম লেখিকার কাছ থেকে।
Excellent writing, need of this hour is to save our planet.
Author nicely shows a path ( the life and habits of Adivasis) which is correct way to save our lovely planet I suppose.