আমেরিকার টেক্সাসে ১৯ জন শিশুর খুনের প্রকৃত আসামী কে?

পোস্টটি দেখেছেন: 33 হর্ষ দাস টেক্সাসের উভালোডে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল (২৫ মে, ২০২২) তা এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক। এক অষ্টাদশ বয়সী তরুণের আর এক তরুণীকে মেসেজ– “এবার ব্যাপারটা করতে যাচ্ছি”। ঐপাশ থেকে তরুনীর পাল্টা প্রশ্ন– “কী করতে যাচ্ছ”। তরুণের উত্তর– “এক ঘন্টার মধ্যে জানাচ্ছি, একটা ছোট্ট সিক্রেট আছে”। এক ঘণ্টার মধ্যে মিডিয়া জগতে […]

হর্ষ দাস

টেক্সাসের উভালোডে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল (২৫ মে, ২০২২) তা এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক। এক অষ্টাদশ বয়সী তরুণের আর এক তরুণীকে মেসেজ– “এবার ব্যাপারটা করতে যাচ্ছি”। ঐপাশ থেকে তরুনীর পাল্টা প্রশ্ন– “কী করতে যাচ্ছ”। তরুণের উত্তর– “এক ঘন্টার মধ্যে জানাচ্ছি, একটা ছোট্ট সিক্রেট আছে”। এক ঘণ্টার মধ্যে মিডিয়া জগতে টেক্সাসের উভালোডের এলিমেন্টারি স্কুলের মর্মান্তিক ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল আলোর গতিতে। উক্ত তরুণের এলোপাতাড়ি গুলিতে দুজন শিক্ষিকাসহ ১৯ জন শিশুর প্রাণ কেড়ে নিল।

তরুণের পরিচয়– নাম সালভাদর র‍্যামোস, রাতের শিফটে ফাস্টফুড চেনে কাজ করত। মা মাদকাসক্ত। ছেলে ও মায়ের মধ্যে কলহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ছেলেটি তোতলা বলে স্কুলের সহপাঠীদের কাছ থেকে অপমান পাওয়াটা ছিল প্রত্যহ ঘটনা, সেই অপমানে সে স্কুল ত্যাগ করেছিল। পিতাহীন মাদকাসক্ত মায়ের সন্তান খুনি হবে এটাই যেন মনে হয় স্বাভাবিক ঘটনা।

কিন্তু ঘটনার  অন্য দিকটা কি:

এই ঘটনায় বাইডেনের হতাশা প্রকাশ– “আর পারছিনা আমি ক্লান্ত। (আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এর বিরোধী) বন্দুক লবির বিরুদ্ধে কবে আমরা একজোটে রুখে দাঁড়াব”?  উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের কথা– “অনেক হয়েছে, এবার আমাদের সাহসী পদক্ষেপ করতেই হবে”।

আমাদের জানতে ইচ্ছা করে বাইডেন হতাশ কেন? আর কমলা হ্যারিসের সাহসী পদক্ষেপ কি?

আমেরিকার রাজনীতিতে বন্দুক নিয়ে বিতর্কটা কেমন:

রিপাবলিকানদের এক বড় অংশের সমর্থন বন্দুক লবির সঙ্গে রয়েছে। তাদের যুক্তি,  ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তার অধিকারের সঙ্গেই আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকারের প্রশ্নটি জড়িত। কোনরকম নিয়ন্ত্রণ এনে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি সুরক্ষায় হাত দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তি হলো– অবাধে আগ্নেয়াস্ত্র বিকিকিনি হতে থাকলে ব্যক্তি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে গণ নিরাপত্তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।

মার্কিন রাজনৈতিক বিতর্কে দুটি বিষয়  পরস্পরের বিপরীতে সামনে উঠে এল– ব্যক্তি মালিকানার সুরক্ষা ও গণজীবনের সুরক্ষা। এই কারণেই কি বাইডেন হতাশ? বাইডেন দীর্ঘদিন ধরে, প্রায় ১৯৭৪ সাল থেকে মার্কিন রাষ্ট্রের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে বেশ উচ্চমহলে অবস্থান করেছেন চাকুরি ও রাজনীতির সুবাদে। অর্থাৎ রাজনীতিতে আসার আগে ও পরে। অর্থাৎ  সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র উৎপাটন করে, সেই সকল দেশে ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠা করার নায়কও ছিলেন এই বাইডেন এন্ড কোম্পানি। এই ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক পুঁজিবাদ বাড়ার সাথে সাথে ডলার আধিপত্যবাদের উত্থান। যা মানুষকে একদিকে ফেলে দিয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, আর পরিবেশকে করেছে ধ্বংস। মানুষকে আজ শুধুমাত্র পাশবিক প্রয়োজন মেটাবার জন্যই পরিশ্রম করতে হচ্ছে প্রায় ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা। যার উপরে দাঁড়িয়ে গিগ অর্থনীতির জন্ম।

এই গিগ অর্থনীতির সংজ্ঞা:

 “Labour market characterized the prevalence of short-term contracts or freelance work as opposed to permanent jobs. Working in the gig economy means constantly being subjected to last minute  scheduling.”

অর্থাৎ স্থায়ী চাকরি থেকে ছাঁটাই করে, শ্রমিকদেরকে ঠেলে দেওয়া যাবে অনিশ্চিত এক জগতে, যেখানে যেকোন মজুরিতে তাকে কাজ করানো যাবে, শ্রম-ঘণ্টারও কোনো বাধা থাকবে না। অর্থাৎ আটঘন্টার জায়গায় ষোল ঘণ্টাও কাজ করানো যাবে। একদিকে চরম মূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে চাকরি ক্ষণস্থায়ী ও মজুরি কম, এই চাপ শ্রমিক জীবনে চরম এক বিদ্রোহের জন্ম দিচ্ছে। যার প্রকাশ সঠিক পথে রূপ পারছে না বলেই আমেরিকার মতো দেশে একের পর এক গুলি চালানো ও খুনের ঘটনা।  

এই অর্থনীতি একদিনে তৈরি হয়নি। প্রথমে মার্কিন দেশ সোভিয়েতের ভিতর থেকে গর্ভাচোভের মতন সুবিধাবাদীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ব্যবস্থাটিকে ভেঙেছে। রাষ্ট্রীয় শিল্প ও  বৃহৎ শিল্প গুলিকে ভেঙে টুকরো করে দিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী বাজারের অধীনে আউটসোর্স  করে দিয়েছে। যাতে পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীকে ক্ষমতাহীন করা যায়। চীনের রাষ্ট্রনেতা চিনপিংও খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল  বাইডেনের এই বিষয়ে। ২০০৩ সালে সাদ্দাম যখন তেল কেনাবেচাকে ইউরোতে নিয়ে যায় ডলারকে ছেড়ে, তখন মিথ্যা  অজুহাতে ইরাকের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে সাদ্দামকে খুন করা হয়, এমনকি শিশুখাদ্য কারখানার ওপরও বোমা মারে মার্কিন দেশ। সেদিন বাইডেন হতাশ তো হয়নি, বরং এইসব পরিকল্পনাকে ভিতর থেকে মদত জুগিয়েছে। ফলে গণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে যে ব্যক্তি মালিকানার উত্থান হয়েছে ডলারের মধ্যে দিয়ে, সেই তৈরি করেছে আজকের এই হিংস্রতা-দ্বেষ-ঘৃণা। শুধু তাই নয় এই হিংস্রতাকে  ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে সমাজের একদম বাচ্চাদের স্তর অবধি। এই হিংস্রতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণ হলো– সহযোগিতার বিপরীতে মানুষের মধ্যে হিংস্র এক প্রতিযোগিতার জন্ম দেওয়া। আর তাই বাচ্চাদের ভিডিও গেমগুলিতেও শত মানুষকে খুন করে নিজের ব্যক্তিমানুষের উত্থানের খেলা দেখানো হয়।

্যামোসের মধ্যে এই বিদ্রোহের কারণগুলি:

 যে সমাজে সহযোগিতার বিপরীতে, প্রতিমুহূর্তে প্রতিযোগিতাকেই মূলমন্ত্র করে তুলছে, সেই সমাজে স্বভাবতই র‍্যামোসের তোতলামিকে সহপাঠীরা সবসময় বিদ্রুপ করবেই। ফলে ছাত্রাবস্থায় সমাজ থেকে কোন সহযোগিতা পায়নি র‍্যামোস। বাড়িতেও মাদকাসক্ত মায়ের কাছ থেকেও কোনরূপ সহযোগিতা সে পায়নি। তার মাও আবার প্রচন্ড এক যন্ত্রণাকাতর  জীবনকে ভুলে থাকার জন্যই  মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারপরে তিনি যখন চাকরিতে গেলেন সেখানকার অবস্থাটা কি? আপনারা জোম্যাটো ও সুইজির ডেলিভারি বয় এবং যে সকল রেস্টুরেন্ট থেকে তারা খাবার তোলে সেখানকার রাঁধুনিদের অবস্থার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন যে, এক ভয়ঙ্কর অমানবিক শাসনের যাঁতাকলে পড়ে আছে মানুষগুলি। যে যাঁতাকলের নাম গিগ অর্থনীতিতে ‘সার্ভিলেন্স এন্ড অডিট’। খাবার অর্ডার করার আধ ঘণ্টার মধ্যেই গরম গরম খাবার পৌঁছে দিতে হবে অর্ডারকারীদের ঘরে। মায়ের মাদকাসাক্ত হওয়ার কারণ এইরূপ এক যন্ত্রণাকাতর পরিস্থিতিকে ভুলে থাকার জন্য। এই হচ্ছে মার্কিনদেশে এক শ্রমিকের সংসার, যেখানে  বিদ্রোহ জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু এই বিদ্রোহকে সংগঠিত করার সাহস কি কমলা হ্যারিসদের আছে? আসলে এই বিদ্রোহকে নিয়ে যেতে হবে ডলার নামক বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিমালিকানাকে উচ্ছেদ করে, মানুষ  এবং প্রকৃতির ভবিষ্যতকে সুনিশ্চিত করে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাকে প্রাকৃতিক করে ও ভবিষ্যতের প্রকৃতিকে সুরক্ষা করে।

তথ্যসূত্র:

আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ মে ২০২২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top