পরিপ্রশ্ন -র শ্রদ্ধার্ঘঃ অমলেন্দু স্যার প্রয়াত হলেন

পোস্টটি দেখেছেন: 46 প্রয়াত হলেন (২২-০৬-২০২০) ড. অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৩০ এর ২ ফেব্রুয়ারী, হাওড়া জেলার মুগকল্যান গ্রামে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের  আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন সংস্থা “International Astronomical Union” এর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের “Royal Astronomical Society” ও এই ধরনের বহু জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার তিনি ছিলেন ফেলো। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর আগ্রহের বীজ অন্তরে লালিত হয়েছিল এম. এস.সি ক্লাসে। তাঁর […]

প্রয়াত হলেন (২২-০৬-২০২০) ড. অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৩০ এর ২ ফেব্রুয়ারী, হাওড়া জেলার মুগকল্যান গ্রামে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের  আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন সংস্থা “International Astronomical Union” এর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের “Royal Astronomical Society” ও এই ধরনের বহু জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার তিনি ছিলেন ফেলো। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর আগ্রহের বীজ অন্তরে লালিত হয়েছিল এম. এস.সি

ক্লাসে। তাঁর শিক্ষক গণিতবিদ ভি ভি নারলিকার (প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের বাবা) এ বিষয়ে তাঁকে গবেষণায় আগ্রহী করে তোলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একাধিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৫০-এর বেশি। গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে চলে যান বেনারস। ভর্তি হন হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলিত গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান।

দীর্ঘদিন (১৯৬৮-১৯৮৮) প্রথমে নটিক্যাল অ্যালামনাক ও পরে এই সংস্থার নাম পরিবর্তন হয়ে তৈরি পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার-এর প্রথম অধিকর্তা ছিলেন ড. অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, বিভিন্ন তিথিগণনা, চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্তের সময় মাপা, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের  তারিখ, সময় ধরে পূর্বাভাস দেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটা বৈজ্ঞানিক ভাবে ভারতে  একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানেই হয়।

পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার একটি আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান যা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার ফল। যদিও এটি প্রতিষ্ঠার  আগেই মেঘনাদ সাহা হঠাৎই মারা যান (১৯৫৬) ৷ যাদের ধারাবাহিক পরিশ্রমে চিন ও জাপান ছাড়া এশিয়া মহাদেশের তৃতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি রূপ পায় ড. অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অগ্রণী ও অন্যতম প্রধান। সরকারী চাকরি জীবন শেষে আমৃত্যু বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে কলকাতার বিড়লা তারামন্ডলে যুক্ত ছিলেন।

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা চাইতেন সমাজে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হোক জনসাধারণের মধ্যে। এজন্য তিনি বিজ্ঞান প্রচারকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। খুব কম বিজ্ঞানী এদেশে এধরণের সামাজিক ভূমিকা নিয়ে থাকেন। মেঘনাদ অনুগামী ডঃ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও মহাকাশ নিয়ে মানুষের মনে আগ্রহ ও এই বিষয়ে ভুল ধারণা দূর করার জন্য সর্বসাধারণের উপযোগী বই লিখেছেন, রেডিও-দূরদর্শনে বক্তৃতা করেছেন,জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে সহজ ভাষায় প্রচুর প্রবন্ধ (আড়াই হাজারের বেশি) লিখেছেন। প্রথমদিকে টেলিস্কোপ নিয়ে কিছুদিন মহাকাশ পরিচিতি ঘটানোর কাজে ব্যপ্ত থাকেন তিনি। পরে আমৃত্যু প্রোজেক্টরের মাধ্যমে স্থিরচিত্রের সাহায্যে হাজার হাজার বার (প্রায় ন’ হাজার) আলোচনা করতে ছুটে বেড়িয়েছেন দূর-দূরান্তের গ্রাম-শহরে।

জ্যোতিষশাস্ত্রের অসারতা স্পষ্ট করে তুলে ধরতে স্লাইড প্রদর্শনগুলোতে তিনি কোনো বাগাড়ম্বর নয়, ব্যবহার করতেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যকে। আর এ বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞা ছিল অপরিসীম।

জ্যোতিষশাস্ত্রের কারবারিরা বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থার সংগৃহিত ও গবেষণালব্ধ তথ্যগুলো ব্যবহার করেন।  কিন্তু দুর্বোধ্য আঁকিবুকি কেটে গ্রহের সঙ্গে মানুষের ভাগ্যের স্বকল্পিত যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন জ্যোতিষীরা। অমলেন্দু বাবু এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ করতেন সব সময়। তাঁর লেখা ‘জ্যোতিষশাস্ত্র কি বিজ্ঞান?’ বইটি বহুল প্রচারিত৷ বইটির ইংরাজি অনুবাদও যথেষ্ট জনপ্রিয়। বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে জ্যোতিষীদের ভ্রান্ত ধারণা প্রচার ও মানুষকে প্রতারণা তিনি মেনে নেননি কখনোই। এই জন্য তাঁর জীবনসংশয় হাজির হয়েছিল একসময়।

নব্বই বছর বয়স পার করেও এই বিশিষ্ট   জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং সক্রিয়। এর রহস্য কী জানতে চাইলে, উত্তরে বলতেন, আনন্দের সঙ্গে কাজ, স্বল্পাহার, সরল ও নিয়মানুগ জীবনযাপন।   বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণের কাজের স্বীকৃতি হিসাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসাবে ডঃ অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে সারস্বত সমাজ মর্যাদা দিয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা পত্র, রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ (পঞ্জিকা)-র পাতা ওল্টালে তিথি নক্ষত্রের সঙ্গে, বিজ্ঞানীমহলে নক্ষত্রসম মেঘনাদ সাহার সঙ্গে, অন্য আরো কয়েকজনের নাম আসবে।  তাঁদের অন্যতম অবশ্যই অমলেন্দু স্যার। বিজ্ঞান অনুরাগী মানুষ, প্রধানত ছাত্রীছাত্রদের মনে পড়বে সৌম্যদর্শন এক শিক্ষকের অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন স্লাইডসহ বিস্ময়কর মহাজগত ও মহাজাগতিক নানা ঘটনার অনির্বচনীয় আলোচনার কথা। বিজ্ঞান কর্মীদের কাছে তিনি অনুকরণীয় আর্দশ হিসাবে থাকবেন একজন জ্ঞানী অথচ মাটির কাছাকাছি মানুষ হিসাবে, বিজ্ঞান প্রচারক হিসাবে। গণবিজ্ঞান আন্দোলনের ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করবে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতারণার বিরুদ্ধে এক ক্রুসেডার ও ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার এক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকার হিসাবে। পরিচিত সর্বজনের কাছে তিনি ছিলেন একজন অমল মানুষ।  তাঁর স্মৃতি দীর্ঘজীবি হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top