বিজ্ঞানে নারী: অসীমা চট্টোপাধ্যায়

পোস্টটি দেখেছেন: 54 বঙ্কিম দত্ত লিঙ্গ বৈষম্যের উৎকট প্রকাশ দেখা যায় যেসব কর্মস্থলে, বিজ্ঞান গবেষনাগারে তথা বিজ্ঞানীমহলে তার প্রমাণ স্পষ্ট। ২০২০ বর্ষকে এদেশে ‘ বিজ্ঞানে নারী’  থিম ঘোষণা করে সমস্যাটার দিকে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সমস্যাটা আন্তর্জাতিক এবং নারী ভাবনার অবমূল্যায়ণ যেভাবে হচ্ছে জগৎ জুড়ে তাতে আশ্বস্ত হবার সুযোগ কম এবং অস্বস্তি […]

অসীমা চ্যাটার্জি

বঙ্কিম দত্ত

লিঙ্গ বৈষম্যের উৎকট প্রকাশ দেখা যায় যেসব কর্মস্থলে, বিজ্ঞান গবেষনাগারে তথা বিজ্ঞানীমহলে তার প্রমাণ স্পষ্ট। ২০২০ বর্ষকে এদেশে ‘ বিজ্ঞানে নারী’  থিম ঘোষণা করে সমস্যাটার দিকে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সমস্যাটা আন্তর্জাতিক এবং নারী ভাবনার অবমূল্যায়ণ যেভাবে হচ্ছে জগৎ জুড়ে তাতে আশ্বস্ত হবার সুযোগ কম এবং অস্বস্তি বাড়ছে বৈ কমছে না। এ অবস্থায় উজ্জ্বল অতীতের অনুসন্ধান কিছুটা মুক্ত বাতাসের আস্বাদ দিতে পারে। মনুবাদী যে চিন্তা নারীকে নরকের দ্বার বলে হাজির করতে চায়, এদেশে মহিলা বিজ্ঞানীরা সেসব ভাবনার বিরুদ্ধে যোগ্য প্রতিবাদ হিসাবেই উপস্থিত হন।

              আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানে ভারতের ক্রম অবনতিকে হিন্দু ধর্মের জাতি-ব্যবস্থার অবধারিত পরিনতি হিসাবেই দেখে ছিলেন। অসীমা চট্টোপাধ্যায় আচার্যের প্রত্যক্ষ ছাত্রী হিসাবে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে রসায়ন বিভাগে ভর্ত্তি হন। সাল ১৯৩৮ । এর আগে তিনি বি.এস.সি পড়তেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। তিনিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এস.সি ক্লাসের প্রথম মহিলা ছাত্রী। তিনি এদেশে প্রথম মহিলা যিনি দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব ফিলোসফি (Ph.D) ডিগ্রী পান। বিশ্ববিদ্যালয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিষয় জৈব রসায়ন, সাল ১৯৪৪। তাঁর গবেষণা কাজের বিষয়ে যাঁরা নিয়মিত উৎসাহ দিতেন তাঁদের মধ্যে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহার নাম বিশেষ উল্লেখ্য।

তাঁর বাবা ইন্দ্রনারায়ণ মুখার্জ্জী, মা কমলা দেবী। ১৯৩৭ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্মগ্রহণ। বাবা ছিলেন ডাক্তার কিন্তু উদ্ভিদ বিদ্যায় তাঁর বাবার আগ্রহ অসীমা দেবীর মধ্যেও যে সঞ্চারিত হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ ড. চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা কাজের সিংহভাগ জুড়ে ছিল বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার দেহের রাসায়নিকের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, প্রধানত লোক অভিজ্ঞতায় যেগুলির ঔষধি মূল্য পরিচিত। দেশীয় ঐতিহ্য আর অভিজ্ঞতাকে পরিবারভিত্তিক জ্ঞানের রহস্যময়তা থেকে মুক্ত করে এক বিজ্ঞাননিষ্ঠ অবস্থানে নিয়ে যাওয়াটা ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা কাজ এবং দেশপ্রেমের প্রকৃষ্ট এক উদাহরণ। মনে হয় এব্যাপারে তিনি তাঁর শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্রের দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন।

                     ৪০০এর বেশী  গবেষণাপত্র দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন। ভারতে উদ্ভিদ-রসায়ন (ফাইটোকেমিস্ট্রি) গবেষণার ঘরানার তিনি পথিকৃত। ৬ খন্ডে প্রকাশিত “The treatise on Indian Medicinal Plant” গ্রন্থমালার তিনি প্রধান সম্পাদক ও লেখক। অন্যতম সম্পাদক ড. সতীশ পাকড়াশি একজন বিশিষ্ট রসায়নবিদ এবং তিনি ছিলেন মিসেস চ্যাটার্জ্জীর (ছাত্র-ছাত্রীমহলে এই নামেই উল্লেখিত) প্রথম গবেষক ছাত্র। এই গ্রন্থমালা একটি অমূল্য সম্পদ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বাঙলায় লেখা (লেখক- ডা কে.পি.বিশ্বাস) ‘ভারতের বনৌষধি’ তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরবর্তি সময়ে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পুনর্লিখন করে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন যা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয়।

                ১৯৪০ সালে তিনি লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজে রসায়ন বিভাগে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসাবে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন ১৯৫৪ সালে। রসায়নে গবেষণার পরিকাঠামো তখন খুবই দুর্বল। একজন মহিলা হিসাবে বাধা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। অত্যন্ত অনমনীয় জেদে ধীরে ধীরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন জৈব রসায়নে অগ্রণী একদল চাত্রছাত্রী,  গবেষক ও গবেষণা  প্রতিষ্ঠান। একজন স্ত্রী ও মা হিসাবে নির্ধারিত পরিবারিক  দায়িত্ব পালনের পর গবেষণা কাজে দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন সমান নিষ্ঠার সঙ্গে। দেশে-বিদেশে বহু কৃতি ছাত্রছাত্রী রয়েছে ড.অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের। পেয়েছেন স্বীকৃতিও। তিনি প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসাবে অত্যন্ত সম্মানজনক শান্তিস্বরূপ ভাটনগর স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ৬২ তম অধিবেশনে তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা সভানেত্রী। সম্মানিত হয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানে। দীর্ঘ  প্রায় দশ বছর ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। পেয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট অব সায়েন্স শিরোপা। ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

             আজ ঐতিহ্যকে ফেরি করা হচ্ছে বাজারের মুখ চেয়ে। সেই প্রয়োজনে পিটুলি গোলাকে দুধ বলে খাওয়ানো চলছে। বিজ্ঞানের মোড়কে বিভ্রান্ত করার নানা পরিকল্পনা আজ স্পষ্ট। সাম্প্রতিক করোনাকালে আয়ুষ-প্যাথির রমরমা আমরা দেখছি। ঐতিহ্যের সঠিক উত্তরাধিকার খুঁজে নেওয়ার কাজটা যারপরনাই কঠিনতর আজ।

          অন্য একটা দিকও আছে। দেশের ঔষধি গাছ দেশি-বিদেশি বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিগুলোর নজরে পড়েছে। চোরাপথে বা বিভিন্ন উপায়ে তার দখলদারি আজ তাদের হাতে। এভাবে অচিরেই নিঃস্ব হবে আমাদের এই প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার যা যথেষ্টই ভাবনার। 

             ড.অসীমা চট্টোপাধ্যায়দের মতো বিজ্ঞানীরা একাজের বিরোধিতায় ও দেশের সম্পদ রক্ষায় সহায়তা দিতে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসতেন এই সময়। একাজে লোকের অভাব স্পষ্ট।  তবে তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন অনেকেরই কাছে নানা বার্তা পৌঁছে দেবে। সেটাও অনেক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top