‘শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক সংহতি’ : ছাত্রছাত্রীরা যা করে দেখালেন
খাদ্য-সংকট এবং খাদ্যের অসম বন্টন ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অন্যতম বড় সমস্যা । তাকে খুব বেশি নগ্ন করে দিল কোভিড পরিস্থিতিতে লকডাউন । লকডাউন ঘোষনা যখন সময়ের অপেক্ষা ছিল, তখন থেকেই আন্দাজ পাচ্ছিলাম সারা দেশের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কী অবস্থা হতে চলেছে। তারপর সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন ঘোষনা ও পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘পা চালিয়ে’, ভূখা পেটে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার নিদারুন ছবি আমাদের আন্দাজকেই আরও বহুগুনে সত্যি প্রমাণ করে। চারদিকে লকডাউনের নিস্তব্ধতা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের তীব্র আর্তনাদকেই প্রকাশ করছিল। রাষ্ট্র যখন তার ব্যর্থতাকে স্পষ্টভাবে হাজির করছে, তখন সামাজিক সংহতি ছাড়া বাঁচবার পথ নেই। ফোন ও অন্য সামাজিক মাধ্যমে আমরা বন্ধুবান্ধবরা যারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছিলাম, তারাই ঠিক করে ফেলি খানিক সাহস নিয়েই ‘মাঠে নামা যাক, যা হবে পরে দেখা যাবে’। এই ঢাল তরোয়াল হীন নিধিরাম সর্দাররা বানিয়ে ফেললাম ছাত্রযুব দের নেটওয়ার্ক ‘কোয়ারেন্টাইন্ড স্টুডেন্ট-ইয়ুথ নেটওয়ার্ক ‘ বা QSYN। কিন্তু মাঠে নেমে দেখলাম মাঠে আমরা একা নই, এই সাহসটা সমাজের আরও অনেক মানুষ দেখাচ্ছেন। ক্রমশ তারা যুক্ত হতে থাকলেন নেটওয়ার্কে, অনেক আবার নিজেদের মতো করেই নিতে শুরু করলেন উদ্যোগ। সামাজিক সংহতিকে সামনে রেখেই পথ চলা শুরু হল আমাদের। কোভিড পরিস্থিতিতে স্লোগান হল ‘শারিরীক দূরত্ব, সামাজিক সংহতি’।
প্রাথমিক ভাবে কলকাতায় আটকে পরা পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার কাজে আমরা নামলাম। দু-একদিনেই বুঝে গেলাম শুধু পরিযায়ী শ্রমিক নন, ঝুপড়িবাসী, ফুটপাতবাসী মানুষ ও দিনমজুরদের অবস্থাও খুব শোচনীয়। ইতিমধ্যেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া,হুগলী,মালদা থেকে শুরু করে আলিপুরদুয়ারের চা বাগান, বারাসাতের বস্তি অঞ্চল,ভাঙড়ের গ্রাম — সামাজিক সংহতি স্থাপনে এগিয়ে এল আমাদের বন্ধুবান্ধবরা, স্থানীয় যুবক যুবতীরা। রেশন নিয়ে একটা সমস্যা দেখা গেল। কোন অঞ্চলের যারা রেশন পেলেন না তারা,যারা রেশন পেলেন তাদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন। যেনবা তারাই মূল শত্রু। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এটাই আমাদের মাথাতেও ঢুকিয়ে এসেছে চিরকাল।
এই সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে সামনে এলো গণ-হেঁশেলের প্ল্যান, নাম — পিপলস কিচেন, জনতার রান্নাঘর।
বাঁকুড়া,বীরভূমের আদিবাসী অধুষিত গ্রাম থেকে পুরুলিয়ার কুষ্ঠ রোগীদের পল্লী, বারাসাতের বস্তি অঞ্চল থেকে বরানগরের জুটমিলের শ্রমিক মহল্লা, কলেজস্ট্রীটের ফুটপাত বাসী থেকে মালদার ভাঙন অধ্যুষিত গ্রাম যেন একটি সূত্রে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে সবাই।
সবার জন্য রান্না হবে এক জায়গায়, সেই রান্না করা খাবার পৌঁছে যাবে সবার ঘরে।
কাজ হারিয়ে বসে যাওয়া মানুষ গুলোর খাবারের সংস্থান হচ্ছে, পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে আমাদের মতো অপটু অনভিজ্ঞ ছাত্রছাত্রীদের সাথে হেঁশেল চালানোর দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তারা নিয়েছেন। বাজার করা থেকে রান্না করা, রান্না করা খাবার বিতরণ করা সব কাজে তাদের ভূমিকাই অগ্রণী। দিনমজুর এই মানুষরাই রান্নার জ্বালানি যুগিয়েছেন, মধ্যে ছোটখাটো কাজ করে যা উপার্জন করেছেন তার থেকে সাহায্য আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। “আমরা কাজ করে খাই, রান্নাঘর খাবার দিচ্ছে, আমরা রান্নাঘরেই গতর দিবো” –সুকুমার হাঁসদা,দিনমজুর, একদিন এক গণহেঁশেলে দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন। এ কথাই বলে দেয় অনেককিছু, যা আর আলাদা করে বিশ্লেষণ করতে হয় না।
ততদিনে,প্রতিদিন টিভি,সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দেশজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাঁচার লড়াই সারা দেশ দেখছে। ট্রাকের নীচে, ট্রেনের নীচে, কড়া রোদে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিদিন মরতে হচ্ছে দেশ নির্মাতাদের। কিন্তু তাতে কি!! তারা তো পরিযায়ী, তাদের ভোটে গুরুত্ব নেই, তাই সরকারেরও তাদের নিয়ে কোন চিন্তা নেই। রামপুকার যাদবদের গগনভেদী কান্না, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে প্রকান্ড স্যুটকেসের উপর ছোট্ট শিশুর ঘুমিয়ে পরা, ছেঁড়া চপ্পলে ফোস্কা পরা পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়ে হাঁটতে থাকা বাচ্চা মেয়েটার ভিডিও তখন দেশ জুড়ে ভাইরাল। সত্যিই আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে গেছে সেইসব ছবি।
দিল্লী, হায়দ্রাবাদ,মুম্বাইয়ে আমাদের বন্ধুরা দিনরাত এক করে চেষ্টা করে গেছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর। যে কাজ সরকার,রাষ্ট্রের দায়িত্ব করার, তাদের অমানবিক অসভ্য নির্লজ্জ উদাসীনতার প্রেক্ষিতে সমাজের মানুষই সেই কাজ নিজেদের কাঁধে নিয়েছে৷ প্রায় কয়েকহাজার শ্রমিককে রেশন দেওয়া, বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার মতো কাজে হাতে লাগিয়েছিল আমাদের বন্ধুরা।
ঘরে ফিরেছেন অনেকেই, কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ ও আত্মীয়তার এক অমলিন সম্পর্কে জড়িয়েছি আমরা।
শুধু পরিযায়ী শ্রমিক নয়, প্রান্তিক যৌনতাভুক্ত মানুষ, যৌনকর্মী , দার্জিলিঙ এর কাজ হারানো শেরপাদের মধ্যেও পৌঁছেছি আমরা। আমাদের সহযোগিতায় নদীয়ার মদনপুর ও কোচবিহারে প্রন্তিক যৌনতাভুক্ত মানুষরা চালিয়েছেন পিপলস কিচেন, শ্যাওড়াফুলি ও সন্দেশখালির যৌনপল্লীতে পৌঁচেছে রেশন। রেশন পৌঁছেছে কালিম্পঙের শেরপাদের কাছেও।
কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামগুলিতে প্রায় সমস্ত কৃষক পরিবারেই অন্তত চাষ করা চাল মজুত থাকে সারাবছরের জন্য। তাই লকডাউনে চালের অভাব হুগলি,বর্ধমানের মতো কৃষিপ্রধান গ্রামগুলিতে দেখা যায় নি। হুগলির বন্ধুরা এই দেখে এক অভিনব কর্মসূচী নেয়, গ্রামে গ্রামে গিয়ে তারা অন্যত্র চলা কিচেনের জন্য চাল-ডাল সংগ্রহে নামে। ভাঙড়েও প্রায় একই রকম কর্মসূচী চলে। সেই সংগৃহীত চাল-ডাল-সব্জি পৌঁছে যায় কিচেনগুলিতে। আসলে এভাবেই গ্রামের ফসলে বেঁচে থাকে শহর মফঃস্বল। কিন্তু সেসব ভুলতে বসা আমাদের, লকডাউন যেন আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দিয়ে গেল।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো লকডাউনের উপর হাজির হয় সুপার সাইক্লোন আম্ফান। লকডাউন জীবিকা কেড়েছিল, আম্ফান মাথা গোঁজার ছাদটাও উড়িয়ে নিয়ে গেল। কলকাতায় বসে ঝড়ের যে তীব্রতা আমরা অনুভব করেছিলাম, তা আমরা কেন আমাদের বাপ-মাও তাদের জীবনে করেননি। কলকাতাকে যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল আম্ফান, দুই চব্বিশ পরগণা ও মেদিনীপুর-এর কোস্টাল অঞ্চলে কী হয়েছে তা ভেবেই আতঙ্কিত হয়েছিলাম। বুঝেছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছানো দরকার এই অঞ্চলগুলোতে ৷ সাহায্য পেয়ে যাই আমাদের নেটওয়ার্কেই কাজ করা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের যারা নিয়মিত সুন্দরবন অঞ্চলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সায়েন্স ক্যাম্প, সায়েন্স অ্যাক্টিভিটি করেন। সুন্দরবনের সেই সমস্ত স্কুল পড়ুয়া এবং শিক্ষকরা এগিয়ে এলেন সবার আগে। সুন্দরবনের যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে সেসব জায়গায় তাদের সহযোগিতায় পৌঁছাল QSYN। সামাজিক মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য চাইলাম আমরা, পেলাম দুর্দান্ত সাড়া। বহু মানুষ এগিয়ে এলেন। পাথরপ্রতিমা, সাগর,গোসাবা, মথুরাপুর, জয়নগর, হিঙ্গলগঞ্জ,হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, দীঘা,জুনপুট, হাওড়া,উলুবেড়িয়া–বিস্তীর্ণ আম্ফানদুর্গত স্থানে পৌঁচেছি আমরা।
বোঝার চেষ্টা করেছি তাদের লড়াই এর আখ্যান, তাদের দাবী-বঞ্চনার কথা, পঞ্চায়েতের দুর্নীতির পাহাড়ে কীভাবে আটকা থাকে তাদের হকের পাওনা। শাসক দল হোক কিম্বা বিরোধী, যার দখলেই থাকুক না কেন পঞ্চায়েত, এরকম দুর্যোগ পঞ্চায়েতের কর্তাদের কাছে লটারি পাওয়ার সমান। দুর্যোগের তীব্রতা যত বেশি, আর্থিক প্যাকেজ যত বেশি, লুঠপাটও তত বেশি। লকডাউনে কাজ গেছে, হাতে টাকা নেই এমতাবস্থায় সরকারি সাহায্যই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু সিংহভাগ জায়গাতেই সেই সাহায্য গেছে পঞ্চায়েত কর্তা, শাসক-বিরোধী নেতানেত্রীদের পকেটে।
এই অবস্থায়,প্রায় ১৫ টির বেশি পিপলস কিচেন চলেছে আম্ফান দুর্গত অঞ্চল গুলিতে, একমাসের বেশি সময় ধরে। এখানে নিয়মিত খাবার পেয়েছেন ৮০০০ এর বেশি মানুষ। প্রায় ৭৫০০ মানুষের কাছে আমরা পৌছে দিয়েছি ত্রিপল, রেশন পেয়েছেন প্রায় ১৪০০০ জন। বন্যার নোনাজল শুধু চাষের জমি ধ্বংস করেছে তাই নয়, গ্রামের নিত্যদিনের ব্যবহারের(স্নান করা, কাপড় কাচা, মাছধরা) পুকুর গুলিকেও করেছিল নোনতা,বিষাক্ত৷ গোসাবা,হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ,সন্দেশখালির বিভিন্ন জায়গায় আমরা প্রায় ১৩০০ কাঠা পুকুর সংস্কারের কাজে হাত লাগাই, যা আসলে পঞ্চায়েতেরই করা দরকার ছিল। এছাড়াও প্রায় ৪০০ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিই সোলার ল্যাম্পসহ পড়াশোনার অন্য সামগ্রী। এমনিতেই উল্লেখিত অঞ্চলগুলিতে পরিবারের পর পরিবার পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়েছে বিগত ২৫-৩০ বছরে। আয়লার পর এই হার আরও তীব্রগতিতে বেড়েছে। চাষের জমিগুলি রাতারাতি মাছের ভেড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। স্কুলছুটের মাত্রা বেড়েছে অনেকগুণ, বেড়েছে শিশুশ্রম ও নারীপাচারের ঘটনাও। লকডাউন ও আম্ফান ফের আরেকবার এইগুলিকে ত্বরান্বিত করবে তা কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায়।
প্রতিবেদক : স্বাগত চক্রবর্তী
পরিপ্রশ্ন আয়োজিত ওয়েব সেমিনার
লকডাউন পর্বে প্রতিমাসের প্রথম আর তৃতীয় রবিবার নানান বিষয়ের উপর সেমিনার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলী। এই পরিকল্পনার হাত ধরে প্রথম সেমিনারের বিষয় ছিল -পরিবেশ আন্দোলন : ভাব ও বস্তুগত সমস্যা।
রবিবার, ২১ শে জুন, ২০২০
দুপুর ৩-৩০ মি থেকে বিকাল ৫টা৩০ মি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হ’লো । কমবেশী ৩০ জন অংশগ্রহণ করেন। সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সন্তোষ সেন সভায় সকলকে স্বাগত জানান। পত্রিকার ওয়েবসাইট (www.pariprashna.in) মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠকদের অবহিত হবার ও পত্রিকার ব্লগ ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করেন তিনি । সভা পরিচালনা করেন প্রধান সম্পাদক বঙ্কিম দত্ত। পরিপ্রশ্ন পত্রিকা মুদ্রিত রূপ বজায় রেখে আগামী কিছুদিনের মধ্যে ই-পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্তের কথা তিনি সভাকে জানান ।
প্রথম সেমিনারের বক্তা ছিলেন অরূপ ঘোষ-পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য, প্রাবন্ধিক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক। তিনি বিশদে পরিবেশ বিপর্যয় প্রসঙ্গে মাইক্রোবায়োম বিনষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং বিপাকীয় ফাটল সংক্রান্ত আলোচনাকে সময়োপযোগী করে উপস্থাপিত করেন। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যেকার গুণগত সম্পর্ক ও তার বির্বতনের ধারা কীভাবে অর্থের পরিমানগত বৈশিষ্টের চাপে আক্রান্ত তা তিনি সহজ করে বুঝিয়ে বলেন। সমাধান সূত্র বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উত্পাদন- পুনরুত্পাদন সংক্রান্ত ভাবনাকে বিস্তার ঘটান বক্তা।
শ্রুতি-দৃশ্য মাধ্যমে আয়োজিত সভার শেষ পর্বে উপস্থিতজনের একাধিক প্রশ্নে বক্তার উত্তর ও উপস্থিত কয়েকজনের মননশীল মন্তব্য সভাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
পরিপ্রশ্ন-র দ্বিতীয় ওয়েব সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় ৫ই অগাস্ট। এই ওয়েব-সেমিনারে প্রধান আলোচক ছিলেন ডঃ পার্থসারথি রায়, জীব- অনুবিদ্যার গবেষক ও অধ্যাপক (Indian Institute of Science Education and Research , Kolkata )। Indian Institute of Science, Bangalore -এ ছাত্র-গবেষক থাকাকালীন নিজস্ব আগ্রহে ভাষাবিদ্যায় আগ্রহী হন ও চর্চা করেন বিষয়টি । সেমিনারের বিষয় ছিল –
ইন্দো-ইউরোপীয়দের সন্ধানে ভাষাতত্ত্ব থেকে জিনবিদ্যা।
দুপুর ৪টে থেকে বিকাল ৬ টা-৩০মি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তা ড.পার্থসারথী রায় ভারতের জনমাজের উদ্ভব ও বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ, ভারতে আর্যদের আগমন প্রসঙ্গে ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব থেকে আধুনিক জীব বিজ্ঞানের গবেষণার ভুমিকা নিয়ে মনোগ্রাহী ও তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেন। স্মরণাতীত কাল থেকে খৃষ্টপূর্ব ১০০০ সন অবধি বিভিন্ন সময়ে ভারতমুখী অভিবাসন (migration) বিষয়ে তিনি গভীর আলোচনা করেন। কালপ্রবাহে এদেশে বহু ভাষাগোষ্ঠী, ধর্মীয়গোষ্ঠী, জাতি এসেছে এবং সংমিশ্রিত ও বির্বতিত হয়ে আজকের সামাজিক পরিচিতি ও বিন্যাস লাভ করেছে ইতিহাসের নিয়মে। কোষের গঠন বিশ্লেষণ কীভাবে এই অভিবাসনের স্বাক্ষ্য বহন করছে সে ব্যাপারে বক্তা বিস্তৃতভাবে বলেন এবং ধর্ম, জাতপাতে অপ্রাকৃতিকভাবে বিভাজিত মানবজাতির অন্তর্লীন ঐক্যের দিকটিকে নির্দেশ করেন।
এদেশে আর্যরা এসেছে বাইরে থেকে এযাবৎ এই যে ধারণা ভারত ইতিহাসের অংশ –তাকে নস্যাৎ করে দেবার চেষ্টা হচ্ছে সংঘ পরিবারের প্ররোচনায়। দেশজুড়ে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে বৈদিক সভ্যতা হিসাবে যা গ্রাহ্য, তা আসলে সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিকতায় এদেশেই গড়ে ওঠা। দাবীর সমর্থনে জিন গবেষণার প্রাপ্তিকে সম্পূর্ণ উল্টোপথে হাঁটাচ্ছে আর.এস.এস. পন্থী বুদ্ধিজীবি ও একদল বিজ্ঞানী। এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে, সত্য অনুসন্ধানের লক্ষ্যে আয়োজিত ওয়েব-সেমিনারে ৭৯ জন অংশগ্রহণ করেন। অনেকটা সময় ধরে বক্তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন আলোচক।
তৃতীয় সেমিনারের বিষয় ছিল-
করোনাকালে বাংলাদেশ: সমাজ, প্রকৃতি ও অর্থনীতি
মুখ্য আলোচক ছিলেন অধ্যাপক ডঃ আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গির বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯ শে জুলাই, দুপুর চারটে থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত।
বক্তা অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করলেন- করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা, ক্ষুদ্র শিল্প সহ সামগ্রিক অর্থনীতি ধ্বসে যাওয়া, কাজের সংকট এবং সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা ব্যহত হওয়ার মতো বিষয়গুলো। বিশ্বব্যাংক, আই. এম.এফ এর ঋণবন্ধনের শর্তে আবদ্ধ বাংলাদেশে খাদ্য গণবন্টন ব্যবস্থা নেই, সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব খুব বেশী। এসবের কারণে ক্ষুধা ও ভাইরাসের যৌথ আক্রমণ চূড়ান্ত বিপর্যয় হিসাবে নেমে এসেছে বাংলাদেশে। পাশপাশি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ করোনা মহামারীর সাথে পরিবেশ দূষণের বিষয়টিকেও সামনে আনেন। তিনি বললেন- বাংলাদেশে ইঁটভাটা নির্মাণ , কারখানার দূষণ, সারা পৃথিবীর সাথে সাথে বাংলাদেশের নদী নালা খালবিলগুলোও আজ সম্পূর্ণ বিপন্ন। ৮০০ টির মতো বড় নদীর মধ্যে কমতে কমতে আজ ২০০ তে এসে ঠেকেছে। নদীর জল বিষাক্ত, ঢাকা শহরে গাছপালা নেই বললেই চলে। চট্টগ্রাম সহ সারা দেশেই প্রাকৃতিক বন খুব কমে গেছে। তিনি এও বলেন যে, বিপন্ন সুন্দরবন উপকূলে রামপাল বিদ্যুত প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের বিক্ষোভ প্রতিবাদ কর্মসূচি জারি আছে। বক্তা জানান যে এই প্রকল্পে ভারতের শ্রমিকরা এখন কাজ করছেন। তিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলেন- সুন্দরবন ধ্বংস হলে দুই দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বিপদের সন্মুখিন হবেন। তাই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশকে ধ্বংস করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দুই দেশের আপামর মানুষ সরব হোন,পথে নামুন এই আবেদন রাখেন ডঃ মুহাম্মদ।
তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ- প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ বিনাশী উন্নয়নকে নতুন ভাবে ভাবা, উপলব্ধি করার প্রক্রিয়া বিশ্ব জুড়েই শুরু হয়েছে, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। করোনা কালে প্রধান শিক্ষা- প্রকৃতি ও মানুষকে বাঁচিয়েই উন্নয়ন হোক- এই দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে তিনি প্রাথমিক বক্তব্য শেষ করেন। প্রায় ষাট জন শ্রোতার মধ্যে বেশ কয়েক জন প্রশ্ন রাখলে তিনি সাবলীলভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
পরিপ্রশ্ন -র ৪ র্থ ওয়েব- সেমিনারের(২/৮) শিরোনাম ছিল “অতিমারীর অর্থনীতি”। বক্তা অর্থনীতি- বিশেষজ্ঞ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ রতন খাসনবিশ। ৯৫ জন উপস্থিত ছিলেন এবং বিকাল ৪টের সময় শুরু হয়ে দু’ঘন্টার বেশি সময় ধরে চলে বক্তব্য উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর।
করোনার বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের আবহে অর্থনীতির বেহাল দশা স্পষ্ট। মানুষের জীবন নষ্ট হচ্ছে নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে। এই ধরনের অতিমারী এর আগেও ঘটেছে। বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমের ভূমিকা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজতা এই অতিমারীকে প্রবলভাবে আলোচ্য করে তুলেছে। স্প্যানিশ ফ্লু ঘটেছিল ১৯১৮ সালে। এই একশ বছরে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। স্প্যানিশ ফ্লু আটকাতে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের উজ্জ্বল ভূমিকার মূল্যায়ন করে ডঃ খাসনবিশ আজকের পরিস্থিতিতে বিপন্ন রাষ্ট্রের ভূমিকার পার্থক্য তুলে ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকার ব্যর্থতার বিভিন্ন দিকের উপর বিশদ আলোচনা করেন যা সপ্রশংস উল্লেখের দাবী রাখে।
এই প্রসঙ্গেই তিনি ভারত রাষ্ট্রের আর্থিক পদক্ষেপ কী হলে তা কিছুটা সুরাহা দিত খেটে খাওয়া মানুষকে তা বিশদে বলেন। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থে কীভাবে ঘরে থেকে কাজের নামে সারাদিন শ্রম-শোষন, মজুরি হ্রাস, কর্মচ্যুতি, শ্রমিক আইন ও পরিবেশ আইনের পরিবর্তন করা হচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতি গভীর সংকটে নিমজ্জিত যার থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে পুঁজিবাদ দেশে দেশে মানুষকে আরো কঠিন আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যাবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। ভারতের মানুষ অচিরেই জাত-পাত – ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির বাইরে বার হবেন এবং সব হাতে কাজ, সকলের জন্য খাদ্য ও বাসস্থান- স্বাস্থ্য -শিক্ষার দাবীতে সংঘবদ্ধ হবেন এই আশা ব্যক্ত করেন বক্তা।
আগামীদিনে সমসাময়িক নানান বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বক্তাদের সমাহারে এই ওয়েব সেমিনার চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবো, এই আশা পোষণ করি আমরা। আপনাদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।
সম্পাদকমণ্ডলী।