হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট – জিন, মানুষ ও পুঁজিবাদ

পোস্টটি দেখেছেন: 95 শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য             সত্তরের দশকে প্রকৃতিবাদের সমর্থক  সবচেয়ে আধুনিক মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তাধারা ছিল সমাজ-জীববিদ্যা(sociobiology)। এই বিশেষ চিন্তাধারাটি রূপকের সাহায্যে সহজ করে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক আমাদের জীবন একটা খালি পাত্রের মতো। পরিবেশ সেই পাত্র জলে ভরিয়ে তোলে এবং আমরা তিলে তিলে বিকশিত হই। জলের পরিমাণ সামান্য হলে জীবনের প্রত্যেকটি […]

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

            সত্তরের দশকে প্রকৃতিবাদের সমর্থক  সবচেয়ে আধুনিক মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তাধারা ছিল সমাজ-জীববিদ্যা(sociobiology)। এই বিশেষ চিন্তাধারাটি রূপকের সাহায্যে সহজ করে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক আমাদের জীবন একটা খালি পাত্রের মতো। পরিবেশ সেই পাত্র জলে ভরিয়ে তোলে এবং আমরা তিলে তিলে বিকশিত হই। জলের পরিমাণ সামান্য হলে জীবনের প্রত্যেকটি পাত্রে সমান পরিমাণ সামান্য জলই জমা থাকবে। কিন্তু পরিবেশ যদি প্রচুর পরিমাণে জল সরবরাহ করে একসময় দেখা যাবে অপেক্ষাকৃত ছোটো মাপের পাত্রগুলি থেকে জল উপচে পড়ছে আর অন্যদিকে বড়ো আকারের পাত্রগুলি সুন্দর জল ধারণ করতে পারছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী স্পষ্টত মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশ জিনগত ক্ষমতা দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। আগের থেকেই ঠিক হয়ে থাকা ক্ষমতার বৈচিত্র্যের জেরেই দেখা দেয় মানুষের ভবিষ্যতের আচরণ, কর্মকাণ্ডের বৈচিত্র্য। জ্ঞানভাণ্ডার পাত্রটির আয়তন অমোঘ জেনেটিক নিয়মে ছোটোখাটো হওয়ার কারণেই নিগ্রো মানুষ সাদা চামড়ার থেকে, নারী পুরুষের থেকে, অনার্য আর্যর থেকে, মুসলিম হিন্দুর থেকে, ধনী গরিবের থেকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইহুদি জার্মান আর্যর থেকে এবং উত্তরকালে গোটা প্যলেস্টাইন ইসরায়েলের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। পিছিয়ে পড়ার কারণ হল জেনেটিক। অতএব প্রকৃতির নিয়মে ধরাবাঁধা, অপরিবর্তনীয়।

প্রখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ ও হার্ভার্ডের অধ্যাপক আর. সি লিওনটিন (R.C Leowntin) সমাজ-জীববিদ্যার বিরুদ্ধে বরাবরই সরব। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, “Sociobiology is the latest and most mystified attempt to convince people that human life is pretty much what it has to be and perhaps even ought to be… there are genes for religiosity, genes for entrepreneurship, genes for whatever characteristics are said to be built into the human psyche and human social organisation… After all, if 3 billion years of evolution have made us what we are do we really think a hundred days of revolution will change us? ”

হিউম্যান জেনম প্রজেক্ট

                          মোদ্দা কথা হল, এই তত্ত্বের মূল ভিত হায়ারার্কিকাল সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে দারুণ খাপ খায়। শুধু তাই নয় এই শ্রেণীগত জাতিগত বৈষম্য মণ্ডিত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে চিরন্তন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে এক আদর্শ চিন্তাধারা ও বটে। আরও গভীরে ডুব দিলে বেরিয়ে আসে সমষ্টির উপরে ব্যক্তিসত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সত্যটি। নাম সমাজ-জীববিদ্যা হলেও সামাজিক সম্পর্কের থেকে এখানে ব্যক্তিগত কার্যকারণই মূল বিচার্য বিষয়। অথচ স্ববিরোধী জায়গাটি হল যে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রটিকে পুষে রাখা হয় পুঁজিবাদকে দুধেভাতে রাখার জন্যই। যুক্তি হল তাদের জিনগত আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি এবং সীমাহীন আর্থিক বিকাশের সহায়ক।

দুটি ভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণ ওই সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্মলগ্নেই নিহিত হয়ে থাকা যুদ্ধপাগল জিনের অস্তিত্ব। কোনও একটি পুরুষ গোষ্ঠী যদি নারীদের নিচু চোখে দেখে এর কারণও সেই একই। সাদা চামড়ার মানুষেরা নিগ্রোদের দেখলেই যদি ঘৃণা আর অনন্ত দ্বেষের মিলিত প্রভাবে তাদের জনসমক্ষে পিষে মেরেও ফেলে তার বিচার হওয়ার কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ নেই।  আধুনিক জেনেটিক বিজ্ঞান বলছে প্রত্যেক সাদা চামড়ার মানুষের দেহকোষের নিউক্লিয়াসে অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খলায় সেজে ওঠা ডিএনএ স্থির করে রেখেছে কালো চামড়া দেখা মাত্রই তাকে ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে দেখার অদম্য এক আকাঙ্ক্ষা। সমাজ-জীববিদ্যার তত্ত্বে আখেরে সামাজিক কাঠামো তো এই ব্যক্তিমানুষগুলির পূর্বনির্ধারিত প্রবণতার প্রতিফলনেই গড়ে উঠেছে। তাকে বদলায় কে?

হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট

            ১৯৯০ সাল। প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন (nature vs nurture) বিতর্কের আবহে পৃথিবীর সেরা মস্তিষ্কগুলিকে একই ছাদের তলায় এনে হাজির করে শুরু হয় বিশ্বের সবচেয়ে জটিল, বড় ও ব্যয়সাপেক্ষ  বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড। নাম হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট (Human Genome Project)। এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল মানুষের জিনোমের সমস্ত জিনের A T C এবং G এই নিউক্লিওটাইডগুলির সম্পূর্ণ শৃংখলিত পর্যায়ক্রমটি বের করে আনা যার দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৩০০ কোটি অক্ষর সম্বলিত একটি সারি। সোজা কথায় মানুষের শরীরে অবস্থিত জিনের ম্যাপ তৈরি করা। 1984 সালে মার্কিন সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। 1990 সালে পুরোদমে কাজ শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থ সরবরাহ করেছিল মার্কিন সরকার ” National Institute of Health ” (NIH) এর মাধ্যমে। শুধু তাই নয় পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয় এই  সরকারের বাইরে। ‘Celera Corporation’ কাজ শুরু করেছিল 1998 সালে। পাশাপাশি কুড়িটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারের সহযোগিতায় মার্কিন দেশ, ব্রিটেন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি এবং চীন এই কাজে যোগ দেয়। আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসবে গড়ে ওঠা এই ম্যামথ প্রোগ্রাম শেষ হলে মানবজাতি ঠিক কী ধরণের সোনার ফসল পেতে পারে তা বোঝাতে লিওনটিন আবারও প্রশ্ন তুলে বলেছেন, “… Biological sense will have to be made, if possible, of the mind numbing sequence of three billion A’s, T’s, C’s  and G’s. What will it tell us about health and disease, happiness and misery, the meaning of human existence?” ।

হিউম্যা জেনম প্রজেক্ট

                বাস্তব বলছে যে যেকোনও  দুটি মানুষকে  গিনিপিগ ধরে নিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে  তাদের ডিএনএ থেকে পাওয়া প্রতিটি ৫০০ সংখ্যার এক একটি নিউক্লিওটাইডের সমষ্টিতে অন্ততপক্ষে একটা আলাদা। মোট তিনশ কোটির হিসেবে দাঁড়ায়  গড়ে ৬০০,০০০ নিউক্লিওটাইডই সম্পুর্ণ  অন্যরকম। এই হিসেবে দুটি সাধারণ মানুষের একটি মাত্র জিনেই গড়ে ২০ টি আলাদা নিউক্লিওটাইড দেখা যাবে।  অতএব প্রশ্ন আসে, যে জিনোম রহস্য উদঘাটন এই প্রজেক্টের প্রাণভোমরা  বিশেষ একটি মানুষের বিশেষ সেইরকম জিনোম বলে আদৌ কি কিছু আছে! পাহাড়প্রমান মানসিক ও কায়িক শ্রমের পর ডিএনএ শৃঙ্খলার যে তালিকা পাওয়া যাবে তা এক স্বকপোলকল্পিত মানুষকেই তুলে ধরবে পৃথিবী নামক গ্রহে যার আসলে কোনও অস্তিত্বই নেই। কোটি কোটি টাকার এই প্রজেক্ট নিয়ে তাহলে এত আলোড়ন কীসের? উপযোগিতা কি কিছুই নেই। অবশ্যই আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এই প্রজেক্টের প্রভূত অবদান। একথা মেনে নিয়েও প্রাসঙ্গিক বলে রাখা ভালো যে আজও চরম ব্যয় সাপেক্ষ কেমোথেরাপিই ক্যানসারের শেষ আশ্রয়। ক্যান্সার নিয়ে আজও চলছে ট্রিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবসা। লিওনটিন খোলাখুলি বলেছেন,” Nor are biotechnologies the only producer of commodities that stand to gain immensely from the human genome sequencing project…machines require the input of a variety of chemical materials all of which are sold at an immense profit by the companies that manufacture the machines. The human genome sequencing project is big business.” ।

              এই প্রজেক্ট ২০০৩ সালে বন্ধ হয়। বন্ধ হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণটির কথা না বললেই নয়। এই প্রজেক্ট চলাকালীন বিজ্ঞানীরা মূলত  দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একদলের চিন্তাধারা ছিল গবেষণাটিকে সকল মানুষের স্বার্থে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, অন্যটির লক্ষ্য কর্পোরেট পার্টনারদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে সুরক্ষা দেওয়া। তাই এই দলটি ভেতরে ভেতরে বরাবরই চেয়ে এসেছে কর্পোরেট পার্টনারদের স্বার্থে ডিএনএ-এর জিন সিকুয়েন্স গুলিকে পেটেন্ট করে নিতে। সমষ্টিগত মানবিক প্রচেষ্টা অবশেষে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যর কাছে হার মানল। সেই সময় Myriad Genetics Company স্তন ক্যান্সারের দুটি জিন (BRCA1, BRCA2)  পেটেন্ট করতে যায় অথচ দেখা  যায় যে জিনদুটি আসলে তাদের আবিষ্কারই নয়, প্রকৃত আবিষ্কারক Mike Stratton-এর নেতৃত্বে লন্ডনের ‘Institute of Cancer Research’ -র ল্যাব। Utah তে অবস্থিত Myriad Genetics  Research-এর  ল্যাবের নেতৃত্বে ছিলেন Mark Sholnick। দুটি ল্যাব যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করলেও  Myrid Genetics সহযোগিতাকে অস্বীকার করে ১৯৯৮ সালে অনৈতিক ভাবে এই দুটি জিন পেটেন্ট করতে যাওয়াতেই কার্যত বিতর্কের সুত্রপাত। বেশ কিছুকাল পরে ২০১৩ সালে অবশ্য মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, মানুষের ডিএনএ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, তার উপরে পেটেন্ট করা যাবে না। কিন্তু পেটেন্ট সংক্রান্ত বিতর্ক শুরু হওয়ার সময় থেকেই একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে পেটেন্ট করে মুনাফার রাস্তা অবিসংবাদিতভাবে মসৃণ করে রাখা আর সম্ভব হয় না। ফলত মুনাফার আশায় বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করা বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অংশীদার অনেক কর্পোরেট সংস্থা একে একে উৎসাহ হারায়। একই সঙ্গে জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদের বিপক্ষেও তত্ব গড়ে উঠতে থাকে।

   সামাজিক এবং জৈবিক এই দুই অস্তিত্ব নিয়েই পূর্নাঙ্গ মানুষ। মানুষের বিকাশে জিন এবং পরিবেশ এই দুইয়ের কোনওটিকেই অস্বীকার করা যায় না। অথচ এই প্রজেক্ট শুরু থেকেই মানুষের সামাজিক অস্তিত্বকে প্রায় অস্বীকার করে জৈবিক অস্তিত্বকেই প্রধান করে দেখাতে চেয়েছিল। তার সঙ্গে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল পুঁজির স্বার্থ। এইসকলই ছিল হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের বুনিয়াদ এবং প্রকৃত  উদ্দেশ্যে, বস্তুত তা ধাক্কা খাওয়ার ফলে ২০০৩ সালে এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়।

                প্রকৃতি বনাম প্রতিপালনের মূর্ত দিকটি বুঝে সেইসঙ্গে পুনুরুদ্ধার করা প্রয়োজন মানুষ ও প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া কথোপকথন। শুধু সাম্প্রতিক করোনা নয়, আদতে ভাইরাসের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে রয়েছে সমগ্র মানব জাতি । যে কোন মুহূর্তে তার বিস্ফোরণ হতে পারে। জানাচ্ছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, মানুষের স্বাস্থ্য অন্য প্রাণীজগত বা সামগ্রিক পরিবেশ থেকে কোনওভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়। একথা বুঝে নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। অতএব আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন এই বিন্দুগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরি করে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতের পৃথিবী আরও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে। মানুষের জিনের উপর কর্পোরেট দখলদারী, বৈষম্যকে উৎসাহ দেওয়া গবেষণা, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা এগুলি কোনোটিই আকাঙ্ক্ষিত নয়। এমন হওয়াটাই আসলে এক অপ্রাকৃতিক ব্যাপার। সদিচ্ছা এবং মানবিক মতাদর্শী মানুষের অভাব না ঘটলে মানুষ ও প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক বাঁচিয়ে তোলাই হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের  উদ্দেশ্য হতে পারত।

তথ্যসূত্র :

1. All in the genes?, Biology as Ideology, R Lewontin, Page – 28, Harpercollins, 1991.

2.https://www.yourgenome.org/stories/how-did-patenting-cause-conflicts-within-the-human-genome-project

লেখক পরিচিতি:

লেখক তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী। ছোট গল্প, সমাজ- বিজ্ঞান, পরিবেশ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে নানান নিবন্ধ লেখেন নিয়মিত।

Contact:

bhattacharya.sankhadeep@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top