মানস কুমার পন্ডিত
প্রাককথন:
কৃষি স্বভাবত প্রাকৃতিক বিষয় নয়। এটি একটি মনুষ্য-সৃষ্ট খাদ্য-উৎপাদন ব্যবস্থা- যা গাছপালা- লতাপাতা- ঘাস-বৃক্ষ ইত্যাদি উদ্ভিদ গোষ্ঠীর সাথে মানুষের একটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ককে কার্যকরী করে।
মানুষ যখন থেকে গাছপালার গৃহিকরন (domestication) শুরু করেছিল তখন থেকে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে ধীরে ধীরে আমরা শস্য-সম্পদ (crop wealth) সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা, পুষ্ট হওয়া, পরাগমিলন, ফলধারণ ও প্রজনন, বীজরক্ষা এবং সার্বিক সুরক্ষা (আবহাওয়াগত অসুবিধা, রোগ-পোকা দমন এবং ফসল সংরক্ষণ) সব বিষয়েই মানুষ ঢুকে পড়ল এবং সেইসব উদ্ভিদ মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনের যোগান নিশ্চিত করল। এই উদ্ভিদ কুলই আমাদের আজকের শস্য-উদ্ভিদ (crop plants)। শস্যক্ষেত্র ও পালিত পশুর জন্য চারণভূমির প্রয়োজন হল। এরপর যেটা ঘটা উচিত, তাই ঘটল। বনভূমি, ঝোপঝাড়, তৃণভূমি 0ইত্যাদি থেকে যে উদ্ভিদ গুলিকে আমাদের পূর্বপুরুষরা আলাদা করে উপকারী খাদ্য- উৎস বলে চিহ্নিত করেছিলেন- তাদের জিন গত এবং বহিবৈশিষ্ট্যের অনেক পরিবর্তন ঘটে চলল আমাদের হাতে। আমাদের বাসস্থানের আশপাশের জঙ্গল সাফ করে এদের আবাদ শুরু হল নতুন এক প্রক্রিয়া ও ক্রমঅভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
শ্রেণির সৃষ্টি
খাদ্য উৎপাদন পদ্ধতি ধীরে ধীরে এক শ্রেণীবিভক্ত সমাজের জন্ম দিল। জমির মালিকানা, উৎপাদনের মালিকানা, উদ্বৃত্ত ফসলের রূপান্তরকরণ আর্থিক প্রভুত্ব, প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং সর্বোপরি ক্ষুধাকে কেন্দ্রে রেখে আর্থ-রাজনৈতিক পাশার চাল সৃষ্টি করল ক্ষুধিত ও পরিপুষ্ট শ্রেণী এবং এর মাঝামাঝি আরেকটি শ্রেণী। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সেই সম্পদ ও ক্ষমতার প্রভুত্ব। খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যপ্রকার- এই বিষয়ে দুটো আম-মানুষের মূল্যবোধ ও সামাজিক অবস্থান নির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল। বর্তমান সমাজের চিত্রটা একই রকম।
প্রত্নপলীয় যুগ থেকে নব্যপলীয় যুগ (neolithic period) এর শুরুর যে সময় বিস্তার, তা প্রায় চার লক্ষ সত্তর হাজার বছর। নব্যপলীয় যুগ শুরু হয় আজ থেকে আনুমানিক তিরিশ হাজার বছর আগে এবং এই সময়কালে মানবসভ্যতায় কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে; কৃষি (ভূমি-কর্ষণ ও বীজ বপন) এর মধ্যে সর্বাগ্রগন্য। কারণ যে কোন জীবেরই খাদ্য প্রয়োজন এবং খাদ্যের যোগান, পরিমাণ, মান, স্বাদ এবং রূপান্তরকরণ তার প্রাকৃতিক নির্বাচনে এগিয়ে চলার এক অন্যতম নির্ধারক।
খাদ্য- প্রতুলতা শক্তির যোগান অব্যাহত রাখে। ফলে পরিণত প্রজননক্ষম একক জীব (individual) আরো বেশী করে প্রজনন প্রক্রিয়ায় সফল অংশগ্রহণ করে। বেশী সংখ্যক সন্তান-সন্ততি মানে একটি বিশেষ প্রজাতি বা জাতি- ধারা প্রজনন সাফল্যে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। তাদের এ সাফল্য আরো নতুন নতুন জিন- সমন্বয় সৃষ্টি করে এবং লড়াই করে প্রকৃতিতে বেঁচে থাকবার বাড়তি আয়ুধ লাভ করে- এটাকেই ডারউইন বলেছেন প্রাকৃতিক নির্বাচন।
বিবর্তন ও বিকাশ
প্রকৃত আদিম মানুষ কম করে দশ লক্ষ বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিল। সেই তখন থেকে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় পঁচিশ হাজার বছর পূর্ব- সময়কাল পর্যন্ত (অর্থাৎ ক্রো ম্যাগনন মানব) অবধি কৃষির কোন নিদর্শন নেই। শিকার- সংগ্রহণ এবং পরবর্তিকালে পশু পালন- এই যাপন-ধরনটি চলতে থাকে। দশ থেকে আট হাজার বছর আগে কৃষির উদ্ভব হয়। ক্রো ম্যাগননরা খুবই কর্মঠ ও পরিশ্রমী ছিল এবং অনেক নৃতত্ত্ববিদ মনে করেন, এরাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে নতুন মানব সমাজ তৈরি করেছে। দলবদ্ধ শ্রম আধুনিক মানুষকে চরিত্রগত ভাবে বিবর্তিত করেছিল তা থেকে মানুষ ক্রমশ অভিজ্ঞ হয়েছিল কিভাবে যৌথ জীবন-যাপন এর মাধ্যমে শ্রম-সাশ্রয়ী খাদ্য আহরণ ও বেঁচে থাকার অন্যান্য উপাদান প্রকৃতি থেকে আদায় করা যায়। সে বড় সুখের সময়- কোন ব্যক্তিস্বার্থ নেই, সবাই সবার জন্য, নেই কোন উচ্চ-নিচ, শোষক- শোষিত ভেদাভেদ।
মানব বিকাশের আধুনিকতম পর্যায়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর মানুষের বিবর্তনের প্রধান প্রভাব ও হেতু হিসেবে প্রশমিত হল। বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও প্রাকৃতিক কারণ গুলির যৌথ প্রভাবে মানব শাখার বিভিন্ন বর্গে অন্য অনেক নতুন ও মিশ্র বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
নদী ভিত্তিক কৃষি সভ্যতা মানুষকে শিকার-মাছ ধরা – ফলমূল-সবজি সংগ্রহের অনিশ্চিত জীবন থেকে স্থায়ী বসবাস ও খাদ্য স্বয়ম্বর হতে সাহায্য করেছিল। নব্য প্রস্তর যুগের শেষ ভাগ পর্যন্ত কোন শ্রেণী বৈষম্য-শঠতা দেখা যায় নি। কিন্তু এই যুগের অন্তিম লগ্ন থেকে কৃষি সভত্যার বিকাশ এবং খাদ্য-নিরাপত্তা মানব সমাজের অন্য ইতিহাস লিখতে শুরু করে। এই পরিসরে প্রসঙ্গটি সবিস্তার বলা যাবে না। খাদ্যের প্রতুল যোগান জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করল, শিশুমৃত্যুর হার কমল, বেশি বেশি সংখ্যায় মানুষ পরিণত বয়স্ক-স্তরে পৌঁছাতে শুরু করল। অর্থাৎ প্রাণ ধারনের প্রাথমিক শর্ত- খাদ্য প্রাচুর্য পেল, হয়ত উদ্বৃত্তও হল। এই উদ্বৃত্ত খাদ্য মজুত করার কলা কৌশল মানুষ ধীরে ধীরে আয়ত্ত করে, কিন্তু তা থেকে যায় মুষ্টিমেয়র হাতে। ফলে এক বড় অংশের মানুষ খাদ্যাভাবের কবলে পড়ে যায়। ক্ষুধাকাতর মানুষকে দরিদ্র বলা হয়, অর্থাৎ তার খাদ্য সংগ্রহের শক্তি সীমিত। তাই তার শ্রমকে নিংড়ে নিতে অসুবিধা হয় না ।
ক্ষুধার বেসাতি করে সমাজে যে শ্রেণীবিভাগ তৈরি হল তা সামাজিক শোষণ ও উত্পীড়নের সরনি বেয়ে এসে দাঁড়াল জোতদার- জমিদার- বহুজাতিক একচেটিয়া পুঁজির করাল গ্রাসে।
খাদ্য সংকটের পাঁচালী
২০১৮সালের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৮২ কোটি মানুষ অর্ধভুক্ত অবস্থায় আছে। সাব-সাহারা আফ্রিকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এখানে প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ অর্ধভুক্ত- অপুষ্ট এবং ক্ষুধা ক্লিষ্ট। তারপরের স্থান ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের (১৭.৭%) এবং এশিয়ার গড় অর্ধভুক্ত মানুষের হিসাব১২% এর বেশি। যদিও সংখ্যার বিচারে এশিয়া অন্যদের থেকে এগিয়ে। বিশ্বের ৮২ কোটি অর্ধভুক্ত মানুষের মধ্যে এশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৫৩ কোটি। সার্বিক ভাবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মিলিতভাবে ক্ষুধাপিড়িত-অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা ৭৯ কোটির কিছু বেশি। আর্থৎ ক্রনিক অপুষ্টিতে ভোগা বিশ্বের ৯০% মানুষেই এই দেশগুলিতে বসবাস করে।
দারিদ্রের সঙ্গে ক্ষুধার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। বন্টন ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সম্পদ ও উৎস-অধিকরের সামাজিক নৈরাজ্যের শিকার হন সর্বাগ্রে একেবারে প্রান্তিক মানুষরা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় খাদ্য সম্ভার যথেষ্ট হলেও, গরীব মানুষ তা সংগ্রহ করতে পারেন না। স্বাভাবিক কারণেই তারা ক্ষুধার্ত ও অপুষ্ট থাকবেন।
ক্ষুধা বা অপুষ্টির একটা অন্যদিকও আছে। আমরা সবাই জানি মোটামুটিভাবে আমেরিকা খাদ্য স্বয়ম্ভর দেশ। কিন্তু স্প্যনিশীয়- আমেরিকানরা ১.৫ গুন, কালো মানুষেরা ২ গুন এবং একক মাতৃ-কেন্দ্রিক (single mom parent) পরিবার গুলি তিন গুণ হারে খাদ্য অপ্রতুলতা ও খাদ্য- হীনতার (cumulative food insecurity) আওতায় পড়েন। এই জনগোষ্ঠীর ছেলে-বুড়ো- মহিলা সবারই বিভিন্ন রোগ-ভোগ লেগেই থাকে। ডাক্তার- ওষুধ-পথ্য এসবের জন্য অর্থের যোগান food insecurity র বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। মানসিক অবসাদ বাড়ে। আমেরিকার মতো দেশেও এদের রোজগার করে বেঁচে- বর্তে থাকার চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়ে যায়।
অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক খাদ্যাভাস
উদ্ভিদ নির্ভর যে খাবার আমেরিকানরা খান, তাতে ভুট্টা এবং সয়াবিনের প্রাধান্য বেশি থাকে। ৭৫ শতাংশ আমেরিকাবাসী শাকসবজি সমৃদ্ধ খাদ্য- রীতির ধার- কাছ দিয়েও যান না। ফলে পুষ্টি সুরক্ষার বিষয়টি তলায় তলায় ব্যাহত হতে থাকে। ২০১৯ এর হিসাব অনুযায়ী (USDA) ৪.৩ কোটি আমেরিকান পরিবার ফুড ইনসিকিউরিটির আওতায় আছেন। তাহলে বাকি পৃথিবীর চিত্রটা সহজেই অনুমেয়।
উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই এই প্রবণতার গভীরে প্রোথিত থাকে বহুজাতিকের ব্যবসা-বাসনা। বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায় সব ‘উচিত’ এর মুখ। খাদ্য- সামগ্রীই বা ব্যতিক্রম হবে কেন? মানুষের জীবন যত জটিল হচ্ছে, ‘একা’ হচ্ছে, মানুষ ততই ফাস্ট ফুডের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পাসওয়ার্ড সব লুকিয়ে আছে বহুজাতিকের হাতের মুঠোয়। সম্প্রতি ওট বা জই খুব প্রচার পাচ্ছে। সন্দেহ নেই ওট খুবই পুষ্টিকর। কিন্তু বোকা-বাক্সে কোন তারকা বলছেন বলেই স্বাস্থ্য উদ্বিগ্ন ভারতীয় মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তরা দুবেলা ওট খাচ্ছেন। ওট এখন মহতী ফাস্টফুড- সে দানা, চিপস বা ওটরোল যাই হোক না কেন। এর সাথে অসার খাদ্যও এসে যাচ্ছে।
যেমন-নরম পানীয়, চিপস এধরনের আরো কত কি। সারা বিশ্বে এখন oat pack এর বাজার সাড়ে দশ হাজার মিলিয়ন ডলার। কারগিল, আর্চার- ড্যানিয়েল আপনার পুষ্টি সুরক্ষা নিয়ে ভাবছে- একথা বিশ্বাস করাটা নিজেকে উপহাস করার সামিল। ওরা জানে আপনার হাতে সময় নেই। তাই হয় ভয় দেখাও, নয় প্রলুব্ধ কর, যাদের হাতে খাবার তৈরি সময় নেই তারাই এই তৈরি খাবার দু- মিনিটে তৈরি করছেন। ভাবছেন ‘এই বেশ ভাল আছি’।
পৃথিবীতে ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ, মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু মাত্র ১৫ টি ফসল থেকে মানুষ তার প্রয়োজনীয় ৯০% শক্তি আহরণ করতে পারেন। আর এই ৯০ শতাংশের দুই তৃতীয়াংশ আসে ধান, গম ও ভুট্টা থেকে। আজকের কোম্পানি মার্কা কৃত্রিম খাদ্য থেকে আসে না।স্থানীয় দেশজ খাদ্য- সবজি সম্মিলিত খাদ্য সুরক্ষাই গরিব ক্ষুধাদীর্ণ মানুষের বাঁচার জিয়ন কাঠি। এই লড়াইটাই এখন খুব জরুরী।।
স্যার,আমরা অনেক সমৃদ্ধ হলাম। এই বিষয়ের ওপর নানান দিক দিয়ে আলোচনা হোক,আরো লিখুন।