সাংবিধানিক গণতন্ত্র ও নির্বাচন- পৃথিবীব্যাপী নতুন বিরোধ

পোস্টটি দেখেছেন: 44 হর্ষ দাস হালের ঘটে যাওয়া চিলি, বলিভিয়া, মার্কিন দেশ ও বিহারের নির্বাচনকে ঘিরে নতুন কোন চেহারাটা আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে তা অল্প কথায় বুঝে নেওয়া যাক।  চিলিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের  দাবিতে জনগণ লড়াইয়ের মাধ্যমে শাসকদের বাধ্য করেছে নতুন সংবিধান গঠন করতে। বাকি তিনটে দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভিতরকার ক্ষোভের কোন […]

গণতন্ত্র

হর্ষ দাস

হালের ঘটে যাওয়া চিলি, বলিভিয়া, মার্কিন দেশ ও বিহারের নির্বাচনকে ঘিরে নতুন কোন চেহারাটা আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে তা অল্প কথায় বুঝে নেওয়া যাক।

 চিলিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের  দাবিতে জনগণ লড়াইয়ের মাধ্যমে শাসকদের বাধ্য করেছে নতুন সংবিধান গঠন করতে। বাকি তিনটে দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভিতরকার ক্ষোভের কোন রূপটা প্রকাশ পেলো? যে বলিভিয়ায় দক্ষিণপন্থী অনুশাসনের মাধ্যমে কর্পোরেটদের কাছে দেশটাকে বেচে দেওয়া হয়েছিল, শুধু তাই নয় জীবনধারণের নূন্যতম  প্রয়োজন পর্যন্ত জনগণ পাচ্ছিল না, সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর জয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন দেশে ট্রাম্পের পরাজয় এবং বিহারে মহাগঠবন্ধন জিততে না  পারলেও, জাতপাতের রাজনীতির বাইরে উঠে আসা বিরোধ কী দিশা দেখায়?     

নির্বাচনকে দেখার বিভ্রম

                   নির্বাচনকে আপাতদৃষ্টিতে  কেবল ভোটের হিসাব দিয়ে বিচার করলে সেখানে নতুন কোন দ্বন্দ্বের উদ্ভবকে দেখা সম্ভব হয় না। কিন্তু অন্যভাবে গভীরে গিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে আসলে জনগণের মনে জমে থাকা ক্ষোভ উঠে আসছে নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই। এককথায় বলতে গেলে—-

 ১) চিলি — এক সামরিক অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে উপর থেকে চেপে বসা কর্পোরেট অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।   

২) বলিভিয়া — এক কর্পোরেট শাসনের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক দলের লড়াই।

৩) মার্কিন দেশ — ট্রাম্পের উগ্র শ্বেত জাতীয়তাবাদী  অনুশাসনের বিরুদ্ধে বহুত্ববাদ ও প্রকৃতি আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন জিতলেও, উল্টোদিকেও জনসমর্থন দেখা গিয়েছে প্রায় কাছাকাছি।

৪) বিহার — হিন্দু জাতীয়তাবাদী  অনুশাসনের মোড়কে কর্পোরেট অনুশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের মৌলিক দাবির উত্থান।

আমেরিকায় নির্বাচন

মার্কিন দেশের গভীরে  বিরোধ কী?

       কোভিডকে কেন্দ্র করে মার্কিন জনগণের মধ্যে যেমন এক বিক্ষোভের উদ্ভব হয়েছে, উল্টোদিকে আবার ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন সমাজ যে আজও দ্বিধাবিভক্ত সেটাও খেয়াল করতে হবে। মার্কিন সমাজে স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে কোনো সরকারি সাহায্য নেই, উল্টে কোভিডের সময়ে লকডাউনের কারণে আয় নূন্যতম সীমায় পৌঁছেছে। ফলে জীবনধারণের জন্য নূন্যতম যে প্রয়োজন সেটাও পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যেকার বিরোধ থেকে জনগনের মধ্যেকার ক্ষোভ কিন্তু আলাদা। ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যের বিরোধ হল কর্পোরেটদের স্বার্থের ভেতরের  বিরোধ। ট্রাম্প  দেশের একদল ফাটকা পুঁজিপতিদের অনেক ছাড় দিয়েছে, বিশেষ করে যারা কর ফাঁকি দিয়ে পরিবেশের নিয়ম ভেঙে দিনের পর দিন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। ট্রাম্প যে কর্পোরেটদের এই সুযোগ দিয়েছে তাদেরকেই আবার ট্রাম্প অন্য বিপদে ফেলেছে যা বস্তুত ট্রাম্পের উগ্র শ্বেত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্কিন রাজনীতির বিরোধকে সামনে  আনছে। যে কর্পোরেটরা উৎপাদন নির্ভরশীল  তাদের সস্তা শ্রমের জগতকে ধ্বংস করছে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি। একদিকে আমেরিকায় সস্তা শ্রমের জগত ধ্বংস হয়েছে আবার উল্টোদিকে মজুরি সরকার দ্বারা বেঁধে দেওয়ার ফলে কর্পোরেটদের অতিমুনাফা আর সম্ভব হচ্ছে না। ফলত গ্লোবাল ভ্যালু চেনে এতদিনের মার্কিন আধিপত্য আজ কোণঠাসা হওয়ায়  বিশ্বব্যাপী ডলার আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়ছে। ট্রাম্প পৃথিবীব্যাপী মার্কিন রাষ্ট্রের আধিপত্যের মাধ্যমে পুরনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে শর্ট ভ্যালু চেইন গঠন করতে চাইছে। এই পরিকল্পনা আঁকড়ে ধরছে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইজরাইল ইত্যাদি দেশ। এর বিপরীতে বাইডেন চাইছে গ্লোবাল ভেল্যু চেইনকে বজায় রেখে মার্কিন ডলারের আধিপত্য বিশ্বব্যাপী কায়েম রাখতে। ফলে ট্রাম্প কিংবা বাইডেন কারো নীতিতেই জনগণের মৌলিক দাবি প্রতিফলিত হচ্ছে না। উল্টে এই নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন সমাজ জাতি বর্ণের ভিত্তিতে  দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে তা অচিরেই জাতিদাঙ্গার কদর্য চেহারা নেবে বলেই মনে হয়।

                       তবে আশার আলো মার্কিন দেশের সমাজতান্ত্রিকরা এই বিষয়ে দ্রুত নিজস্ব পার্টি গঠন করে, জনগণের মৌলিক ইস্যুগুলোকে কীভাবে তুলে আনা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। ফলে এই দ্বন্দ্বে যদি নতুন ধরনের কমিউনিস্ট রাজনীতির উত্থান হয় সেটা আশাব্যঞ্জক। দেখার বিষয় এই নতুন  কমিউনিস্ট রাজনীতি শীঘ্রই মার্কিন জাতীয় গণ্ডি ছেড়ে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে কিনা।

 বলিভিয়া ও চিলি

 চিলির রাস্তায় সরাসরি লড়াইয়ের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের দাবি করছে জনগণ। আশা করা যায় এক ধরনের পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের উত্থান ঘটবে। বলিভিয়াতে ভোটের মাধ্যমে সোশালিস্টরা ক্ষমতায় এসেছে। দুটি দেশের জনগণের মধ্যেকার আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে আজকের অর্থনীতির যেসকল সংকট সাধারণ মানুষের  ঘাড়ে চেপে বসেছে তার থেকে মুক্তি।

বিহার নির্বাচন

বিহারের নির্বাচন

       বিহার নির্বাচনে কামাই, পড়াই ও দাওয়াই এই তিনটি দাবি প্রচন্ডভাবে যুবক জনগণের মধ্যে তীব্র সাড়া তোলে যা জাতপাতের গণ্ডি অতিক্রম করে যায়। সরকার প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে সবকিছু কর্পোরেটদের হাতে বিক্রি করে দেওয়ার যে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আসলে এই তিনটে দাবি তার বিরুদ্ধেই সোচ্চার প্রতিবাদ। ফলে 370 ধারা, রাম মন্দির, এনআরসি ইত্যাদি ছেড়ে এই তিনটে দাবির  হয়ে কথা বলতেই হয়।   

আজকের নতুন প্রশ্ন  এবং করণীয় কাজ  

              আজকে বিশ্বায়নের যুগে বাইডেন বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল ভ্যালু চেইনকে শক্তিশালী করবে পার্লামেন্টরী গণতন্ত্রের আধারেই, যার মাধ্যমে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেসমেন্ট(FDI) -এ জোর  বাড়বে। বস্তুত  সেই কর্পোরেট অনুশাসনই  বহাল থাকছে কিন্তু  জাতীয় ক্ষেত্রে কর্পোরেট বিরোধী লড়াইগুলি কার্যত বৃহৎ আন্দোলনের জমি মজবুত  করতে পারবে না।                        

                অতএব প্রথমেই দরকার বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বায়িত পুঁজির থেকে মুক্তির জন্য একটা তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে সামনে রেখে দেশে দেশে মেহনতী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার। জাতীয় গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলে এই সামাজিক অবস্থা থেকে মুক্তি নেই। সেকারণেই আজকের বিশ্বব্যাপী জনগণের বিক্ষোভকে কর্পোরেট বিরোধী আন্দোলনে সংগঠিত করা যাবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top