হর্ষ দাস

উপরের ছবিতে ভারতবর্ষের বেকারত্বের হারের ঊর্ধ্বগতি পরিষ্কার। ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যেখানে চাকরির পরিমাণ ছিল ৪০৪০ লাখ, সেখানে কোভিড-১৯ আসার শুরুতেই ৮০ লাখ চাকরি কমে যায়। মার্চ ও এপ্রিল মাসে ৩৯৬০ লাখ থেকে কমে দাঁড়ায় ২৮২০ লাখে। এর মানে ১১৪০ লাখ চাকরি হ্রাস পেয়েছে। শুধুমাত্র এক দিনের নোটিসে দিল্লিসহ বড় বড় শহর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বার করে দেওয়া হয়। এই চাকরির হ্রাস ভারতবর্ষের খেটে খাওয়া মানুষের ওপর প্রচণ্ড এক চাপ বাড়াতে শুরু করে।
এই বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ কী
কোভিড শুরুর পর ১১৪০ লাখ চাকরি হ্রাসের কারণ যদি কোভিড ধরে নেওয়া হয় তাহলে কোভিড প্রাদুর্ভাবের আগে ৮০ লাখ চাকরি হ্রাসের কারণ কি? এর নেপথ্যেই প্রকৃত রহস্য লুকিয়ে আছে। সেটা ঠিক কী দেখা যাক।
(১) একদিকে ক্যাপিটাল গুডস-এর মূল্য হ্রাস, অন্যদিকে অনুন্নত দেশে বা উন্নয়নশীল দেশে মজুরি বৃদ্ধি। এর কারণ গ্রামীণ জগতে বাজার বিকাশের জন্য সরকার কর্তৃক বিভিন্ন অনুদান। মিড ডে মিল, দু টাকা কেজি দরে রেশনের চাল এবং ১০০ দিনের কাজ গ্রামসহ শহরে অল্প মজুরির জগতে মজুরি বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি মানুষের এই সুযোগগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে এগোতে হবে যা কেন্দ্রীয় সরকার করছে নাকি অন্যরকম ভাবার সুযোগ আছে। এই অন্য ভাবনায় কেন ঢুকছে না সরকার? আসলে এই সামাজিক কারণের বিপরীতে অন্য এক রাজনৈতিক স্বার্থ জড়ানো কারণ রয়েছে।
(২) একদিকে যেমন পিছিয়ে পড়া গ্রামে আজকে হারভেস্টিং মেশিনের মতো মেশিন ব্যবহার হচ্ছে ঠিক তেমনি আবার উন্নত প্রযুক্তির জগতে, বিশেষ করে আইটি সেক্টরে – আর্টিফিশিয়াল ইন্তেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে ফলত দুই দিক থেকেই বেড়ে চলেছে বেকারত্ব। এর সঙ্গে করোনাকালের লকডাউনে ভারতবর্ষের জিডিপি -২৪% এসে দাঁড়িয়েছে ।
বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণকে ইউনাইটেড নেশন এবং তার অধীনে সংগঠন আইএলও ও ইউনিসেফ কীভাবে দেখছে
২০০০ সালে ইউনাইটেড নেশন ২০১৫ সালের মধ্যে যে “মিলিয়ন ডেভেলপমেন্ট গোল” (এম ডি জি) নিয়েছিল দারিদ্র দূরীকরণের জন্য, তা কিন্তু কাজ করেনি। দারিদ্র দূরীকরণ করার জন্য তারা যেগুলোকে লক্ষ্য হিসেবে ধরেছিল সেটা হল -ক্ষুধা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মায়েদের শরীরের উন্নতি ঘটানো, এইচ আই ভি এইডস ও ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, পৃথিবীকে প্রাকৃতিকভাবে বাসযোগ্য করে রাখা, এই কাজগুলিকে করার জন্য পৃথিবীব্যাপী দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে তোলা।
কিন্তু ২০১৫ সালে এসে তারা দেখল এই কাজগুলি এগোয়নি, উল্টে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় উপরোক্ত কারণগুলোর জন্য দারিদ্র্য আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে।বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা দেখাচ্ছেন—একদিকে উন্নত প্রযুক্তি, অন্যদিকে গ্রীন হাউজ গ্যাস কমানোর জন্য পৃথিবী ব্যাপী উৎপাদনের সংকোচন হয়েছে এবং সেই কারণে বেকারত্ব বাড়ছে। ২০০৮ সাল থেকে পুঁজির যে সংকটের বৃদ্ধি হয়েছে, সেখানে পৃথিবীর প্রত্যেকটি বৃহৎ দেশ অন্য দেশের ঘাড়ে এবং নিজের দেশের মেহনতী মানুষের ঘাড়ে সংকট চাপিয়ে দেওয়ার ফলে বিরোধ বেড়েই চলেছে। ফলে বেশ কিছু মার্কিন কোম্পানি চীন যাত্রা বন্ধ করায় চাকরির ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সেই কারণে ২০১৫ সাল থেকে ইউনাইটেড নেশন “সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গ্রোথ” (এস ডি জি)-এর কথা বলছে। তারা বলছেন- মানুষের মধ্যেকার সহযোগিতামূলক অবস্থানের ভাঙনের ফলে ধর্মীয় ও জাতিগত বিরোধের কারণে এবং পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংসের কারণে প্রায় ৬০০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইউনিসেফের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর Anthony Lake-র মতে “In setting broad Global goals the MDG’s inadvertently encourage Nations to measure progress through national averages, shifting the focuses away from those needs.”(How do the SDG’s differ from MDG’s-wikiprogress.org)
উন্নয়নকে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির গড় অর্থাৎ জিডিপির বাড়ানোর ভিতর দিয়ে দেখার ফলে উক্ত প্রয়োজনগুলি গুরুত্ব পায়নি।
“সাসটেনেবেল ডেভলপমেন্ট গ্রোথ”(এস ডি জি) দূর করতে পারবে না কেন?”
২০১৫ সাল থেকে ২০৩০ সাল অব্দি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গ্রোথের যে কর্মসূচীর কথা বলা হয়েছে, সেখানেই বলা হয়েছে এমডিজির ফেলের কারণ গুলি – ” However, communicable diseases and gender/income inequality still persisted, millions remind in extreme poverty and 60 millions were displaced by conflict, and climate change disproportionately affected poor communities and reversed economic gains”
এই কারণেই এসডিজিতে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার উন্নতি, পরিবেশের উন্নতি এইসব নিয়ে প্রায় ১৭ টি লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। কিন্তু এসডিজি তো আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে রুখতে পারবে না বা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেও ঠিক জায়গায় আনতে পারবে না কারণ এসডিজিরও লক্ষ্য হচ্ছে উৎপাদন কেন্দ্রিক।
কেন উৎপাদন কেন্দ্রিকতা আজকের সমাধান নয়
মানুষ বিবর্তনের বিপরীত মুখে হাঁটতে পারে না। মানুষ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল শ্রম লাঘব করার জন্য। আজকে পৃথিবীতে যে যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছে তাতে মানুষের দ্বারা উৎপাদন না করে যন্ত্রের দ্বারা উৎপাদন করা সম্ভব। তাহলে কেন মানুষকে উৎপাদনে নিয়ে আসা হচ্ছে। পুঁজিবাদের কাছে মানুষও একটা যন্ত্র, তাই তার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে কখন সস্তায় কোন যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে, কৃত্তিম যন্ত্র না মানুষ নামক যন্ত্র। যন্ত্রপাতির দাম বেশি হওয়ায় উন্নত দেশের দামি শ্রমিকের বদলে অনুন্নত দেশের সস্তা শ্রম ব্যবহার হচ্ছিল। এখন অনুন্নত দেশের সস্তা শ্রমের থেকেও যন্ত্রপাতির দাম সস্তা হয়েছে। পাশাপাশি লকডাউনের কারণে অনলাইন কাজের গতি বৃদ্ধিও এই প্রযুক্তির ব্যবহারকে বাড়িয়ে তুলেছে।
তাহলে বেকারত্ব দূর হবে কি করে
ইউনিসেফ জিডিপি কেন্দ্রিক উন্নয়নের ভিতর দিয়ে যেমন উন্নয়ন হবে না বলছে কিন্তু কীভাবে উন্নয়ন হবে তা নিয়েও তারা নীরব । উন্নয়নের জন্য আজ প্রকৃতি কেন্দ্রিকতায় যেতে হবে। আজ জিডিপি কেন্দ্রিক উন্নয়ন সমুদ্র কলুষিত করেছে, আকাশ ছেয়ে ফেলেছে গ্রিনহাউস গ্যাসে, সমুদ্রের জলস্তরকে বাড়িয়েছে, পৃথিবীর ভিতরের ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমিয়ে দিয়েছে। এই বিপর্যয় আজ কীভাবে ঠিক হবে? এর উত্তর এড়িয়ে গিয়ে পৃথিবীতে উৎপাদন করতে গেলেই পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই সবার আগে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাকে মেরামত করা দরকার।
এই কাজ কীভাবে হবে
পৃথিবীকে এই স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে কর্পোরেট জগত। কর্পোরেট জগতের মুনাফার হার পৃথিবীব্যাপী মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় তাদের মুনাফা করার ক্ষেত্রকেও স্তব্ধ করে দিচ্ছে। আজ সরকারের কাজ হওয়া উচিৎ কর্পোরেট জগতের উপর উচ্চ হারে ট্যাক্স চাপিয়ে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার কাজ সৃষ্টি করা। এই কাজ বেকার সমস্যাকে দূর করবে, পৃথিবীকে বাসযোগ্যও করে তুলবে। আমরা দেখছি সরকার উল্টে কর্পোরেটদের সুযোগ দিচ্ছে সস্তা শ্রম ও প্রকৃতিকে শোষণ করার। যারা বিরুদ্ধাচারণ করছে তাদেরকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে। আর এক ধরনের রাজনীতির জন্ম দেওয়া হচ্ছে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার জন্য। ফল হিসেবে বেড়ে চলেছে মানুষের মধ্যে জাতপাত সংক্রান্ত ধর্মীয় বিরোধ। তাই সমস্ত মানুষকে আজ প্রাকৃতিক পরিচয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষ ও পৃথিবীর মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেই আমাদের আজ মানুষ হিসেবে বাঁচতে হবে।
তথ্যসূত্র:
খুব ভালো বিশ্লষণ। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ভাবিয়ে তোলে। মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে না আনলে এর থেকে নিস্তার নেই।