রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য: অনাসক্ত বস্তুবাদী

পোস্টটি দেখেছেন: 42 রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য: অনাসক্ত বস্তুবাদী অভিজিৎ বসু [This is the Bengali version of an earlier English piece titled ‘Ramkrishna Bhattacharya: Doyen of Indian Materialism’. Professor Bhattacharya belongs to a breed of idealistic Bengali intellectuals from Kolkata whose likes are becoming more and more of a rarity these days.]   ছোটবেলা থেকেই রামকৃষ্ণদার একটা […]

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য: অনাসক্ত বস্তুবাদী

অভিজিৎ বসু

[This is the Bengali version of an earlier English piece titled ‘Ramkrishna Bhattacharya: Doyen of Indian Materialism’. Professor Bhattacharya belongs to a breed of idealistic Bengali intellectuals from Kolkata whose likes are becoming more and more of a rarity these days.]

 

ছোটবেলা থেকেই রামকৃষ্ণদার একটা যেন ব্যতিক্রমী ভাবমূর্তি দেখেছি। অহংকার নয়, জ্ঞানের দম্ভ নয়, সৌম্য শান্ত একজন মানুষ, যাঁর মাপাজোকা কথা থেকেই কিছুটা হদিস পাওয়া যেত অন্তর্ভূত এক গভীর যুক্তিধর্মী বিদ্যাবত্তার।তরুণ বয়সেই ওঁর বিতর্কদক্ষতা যেমন লক্ষণীয় ছিল তেমনই  আকর্ষক ছিল ওঁর লেখার ক্ষমতা।সমসাময়িক প্রবণতার তাগিদে উনি মার্কসীয় বিচারবুদ্ধিতে অনুপ্রাণিত হন সেই ষাটের দশকেই।কিন্তু অন্য অনেক সেযুগের বামপন্থীদের প্রতিতুলনায় ওঁর বেলা সে প্রেরণায় কখনো ভাঁটা পড়েনি।এ ব্যাপারে কিছুটা মিল দেখেছি ওঁরই সতীর্থ আর আমার দাদা গৌতম বসুর সঙ্গে।দাদা কলেজ-ইউনিভার্সিটি তে বামঘেঁষা ছাত্র রাজনীতি করে পরে আই. এ. এস হন, কিন্তু কখনো সরকারি কাজের জাঁতাকলে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ও সাম্যবাদী মতাদর্শের ক্ষয় হতে দেননি।

দুজনে ছিলেন আমাদের স্কটিশ চার্চ স্কুলের গৌরবশালী ১৯৬৩ উচ্চ মাধ্যমিক ব্যাচের কৃতী ছাত্র। জুনিয়র ছেলে হিসেবে তখন আমি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে একটু দূর থেকেই প্রীতিমেশানো শ্রদ্ধার নজরে দেখতাম। কিশোর বয়সে তিন বছরের ব্যাবধান অনেকটাই যেন স্ট্যাটাসের দেয়াল খাড়া করে দিত। অবশ্য পুরনো স্কুলের একটা যোগসূত্র তো থাকেই। তারই দৌলতে অনেকদিন বাদে – ২০১১ সালে – রামকৃষ্ণদার সঙ্গে প্রত্যক্ষতর পরিচয় হলো। সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে আমার লেখা একটা ইংরেজি বইয়ের খসড়া দেখানোর উদ্দেশ্যে দাদার সঙ্গে যাই শ্যামবাজারে ওঁদের ৩ নং মোহনলাল স্ট্রীটের বাড়িতে। তখন থেকে শুরু হলো একটা (আমার পক্ষে) তৃপ্তিকর পারস্পরিক আলাপ আলোচনার – ইমেল, টেলিফোন ও সময়ান্তরে দেখাসাক্ষাতের সূত্রে। সে সব আলোচনা থেকে আরো অবগত হতাম ইংরেজির অধ্যাপক ভদ্রলোকের পাণ্ডিত্যের বিস্তার ও গভীরতার বিষয়ে। ভারতীয় বা প্রতীচ্য, ক্লাসিকাল বা আধুনিক সাহিত্য ও দর্শন, সবকিছুতে যেন ওঁর দখল। তবে তার মধ্যে প্রধান কৃতি নিঃসন্দেহে চার্বাক-লোকায়ত দর্শনে পৃথিবীখ্যাত সমকালীন ভাষ্যকার-বিশেষজ্ঞের পরিচয়ে। নানাত্ববাদী ভারতের এই বাস্তবদর্শন বিকশিত হয় খ্রিস্টীয় আট থেকে বারো শতকের মধ্যে, বৈদিক ব্রাহ্মণত্ববাদ আর অবৈদিক বৌদ্ধ-জৈন মতের প্রবল জুড়ির এক যুক্তিবাদী বিকল্প রূপে। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বিতর্কপ্রিয় মনকে বোধহয় স্বাভাবিক ভাবেই আকৃষ্ট করে এইরকমের বাস্তবভিত্তিক তর্কবাদ। তার সঙ্গে চলে ওঁর অন্যান্য চিন্তাভাবনা। এই বহুমুখী উৎসেচনের ফলস্বরূপ উনি লেখেন নানা বই আর গবেষণাপ্রবন্ধ – ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য, পাঠমূলক সমালোচনা, ইতিহাস ও মার্কসবাদ নিয়ে সব লেখা। তবে ওঁর ম্যাগনাম ওপাস নিঃসন্দেহে ২০০৯ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ, ‘স্টাডিজ অন দি চার্বাক/লোকায়ত’। লেখকের বিচার বিশ্লেষণ বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে বইটার খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

তথ্যবহুল ও সারগ্রাহী এই আকরগ্রন্থের একটা বড় গুণ এর মৌলিক বিশ্লেষণ – যা ভারতের বস্তুবাদ সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণার নিরসনে সাহায্য করে। একটা বড় ভ্রম এই যে চার্বাক-লোকায়ত দর্শনের প্রবক্তারা প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া অন্য কোন প্রতীতির সাধিত্র (ইন্সট্রুমেন্ট অফ কগনিশন)মানেন না। এ প্রসঙ্গে প্রথমে বোঝা প্রয়োজন ‘লোকায়ত’ শব্দের ব্যুৎপত্তি। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (এ বিষয়ে রামকৃষ্ণদার পূর্বতন পণ্ডিত ও গাইড) ঐ শব্দের সুন্দর এটিমোলজি বুঝিয়েছেন, লোকেষু আয়ত = লোকায়ত, এই রকম। রামকৃষ্ণ বাবু দেখিয়েছেন যে চার্বাকবাদীরা অন্য বৈপরীত্য সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া অনুমান বা ইনফারেন্সকেও লোকমধ্যে প্রচলনের ইন্সট্রুমেন্ট রূপে স্বীকার করেন, তবে এই পর্যন্ত যে অনুমানের প্রতিষ্ঠা অনুভব বা পারসেপশনের ভিত্তিতে হতে হবে।

বইতে আরো যে এক ভুল ধারণার নিরসন করা হয়েছে তা হলো এই যে চার্বাক অনুগামীরা নাকি শুধুই অবিমিশ্র ভোগপরায়ণতার সমর্থক। চার্বাকদের এ ইন্দ্রিয়প্রবণ ‘হেডনিস্ট’ অপবাদের মূলে রয়েছে মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের একটা বহুলপ্রচারিত শ্লোক:

যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।

ভষ্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ॥

[যতদিন বাঁচার সুখে বাঁচো, ঋণ করেও ঘি খাও। এ দেহ তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তখন আর ফিরবে কি করে?]

এ প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণ বাবু সূক্ষ্ম পাঠ-বিশ্লেষক যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে ঐ শ্লোকের প্রথম লাইনের শেষার্ধ খুব সম্ভবত একটা উদ্ভাবন, যার উদ্দেশ্য ছিল চার্বাকদের ছোট করা, এবং যার প্রমাণ একই শ্লোকাংশের এই পাঠান্তর, যেটার উল্লেখ অন্যান্য ভাষ্যকার ছাড়াও মাধবাচার্য নিজে পূর্ববর্তী এক পরিচ্ছেদে করেছেন: ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ, নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ’ [যতদিন বাঁচার সুখে বাঁচো, মৃত্যুর পর আর কিছু নেই]। আর যদি সুখে বাঁচার কথা ওঠে, তা কি সর্বসাধারণের স্বাভাবিক মনোবৃত্তি নয়? রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য জোরের সঙ্গে অতীত যুগের বস্তুবাদী পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে ভোগলিপ্সার অপবাদ খণ্ডন করেছেন: “পুরন্দর, অবিদ্ধকর্ণ, উদ্ভটভট্ট প্রমুখ বিদগ্ধ নৈয়ায়িকরা কেবল ইন্দ্রিয়বিলাসী ছিলেন, এর চেয়ে অসঙ্গত কথা আর কি হতে পারে?”

ফিরে আসি আমাদের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের আলোচনায়।গত বছরের (২০১৭) ডিসেম্বর মাসে আমি ঐ ৩ নং মোহনলাল স্ট্রীটের বাড়িতে যাই স্কুলের বন্ধু নেপচুন শ্রীমলকে সঙ্গে নিয়ে। ঘরে ফেরা পাখির মত দুজনেই আমরা ফি বছর শীতকালে কলকাতায় আসি – আমি গুরগাঁও আর নেপচুন সুদূর ফ্লোরিডা থেকে, যেখানে ও আছে ফ্লোরিডা ইন্টারনেশনাল ইউনিভার্সিটিতে জিওলজির অধ্যাপক হয়ে। নেপচুন পুরনো কলকাতারই সুপরিচিত ‘শহর-ওয়ালে-জৈন’ কুলের বংশধর (যাদের আদিবাড়ি মুর্শিদাবাদে)। সেবার ও আমায় বলে রামকৃষ্ণদার সঙ্গে দেখা করতে চায়, পুনর্মিলনের আনন্দ ছাড়াও জৈনদর্শনের বিশেষজ্ঞদের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধানের জন্য। উদ্দেশ্য – ফ্লোরিডার এক জৈন ফাউন্ডেশনের হয়ে একটা দর্শন সংকলন প্রকাশ। তখনই কথা বললাম রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে ল্যান্ডলাইন ফোনে। [গ্যাজেট-নির্ভরতার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে উনি বলেছিলেন, “আমি আদৌ গ্যাজেট-বিরোধী নই; কম্পিউটর আর নেট ছাড়া আমার চলেই না। তবে মুঠোফোন ব্যবহার করি না, এই যা।”] তখনি উনি জানালেন সাদর আমন্ত্রণ, যে কোন সময়ে। সুতরাং, নির্ধারিত দিনে বেলা ১১টা নাগাদ দুজনে পৌছে গেলাম ওঁর বাড়ির দোরগোড়ায়। প্রাচীন বাড়িটার অন্তঃস্থিত উঠোন পরিক্রমা করে, আঁকাবাঁকা প্যাসেজের অলিগলি দিয়ে পৌছুলাম সিঁড়ির প্রথম ধাপে। তারপর উঠলাম চারতলার ছাতের নিরিবিলি ঘরে, যেখানে দেখা পেলাম বইয়ে ডুবে থাকা আবাসিক মানববাদীর।

শুরু হলো উদ্দীপক আলোচনা, বিভিন্ন বিষয়ে, কিছু খোশগল্পের সহযোগে। তারই মধ্যে এল চা-বিস্কুট, নিয়ে এলেন গৃহকর্তার ছোটবোন ও বর্তমান ‘গার্জেন’। চতুর্দিকে বই আর কাগজপত্র – তন্মধ্যে উদার আহ্বান পেলাম কাপ ও প্লেট ন্যস্ত করার, শুধু এইটুকু খেয়াল করে যে ঐগুলো যেন খালি চোখে দৃশ্যমান হয়, কোন সময়ে পরিষ্করণের জন্য। কেউ কখনো ঐ অবিন্যস্ত স্টাডি বা বইপত্রের কিছু গোছগাছ করে কিনা আমাদের এ প্রশ্নের অকপট উত্তর পেলাম: “না” । নেপচুনের স্বভাবসুলভ সোজাসাপটা প্রশ্ন: “বিয়ে করনি কেন?” একটু হেসে, চারপাশের সারস্বত অব্যবস্থা দেখিয়ে ভট্টাচার্য মশায়ের সরল উত্তর: “যাতে কাউকে বিরক্ত না করে এসব করতে পারি ।” আমার মনে পড়ে গেল সমানধর্মা জীবনসঙ্গী পাওয়ার সেই চণ্ডীপ্রার্থনা: ‘ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম’ [হে দেবি, আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী মনোরমা ভার্যা দাও।] কতজন পুরুষ বা নারীরই বা জোটে এরকম চিরসঙ্গী?

নেপচুনের প্রাকৃত জৈন পুঁথিপত্র খোঁজ ফলপ্রদ হলো যখন রামকৃষ্ণদা দিলেন বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পণ্ডিতের হদিশ। আরো জানালেন যে পূর্ব ভারতে এখন আর তেমন সংস্থা নেই যেখানে এসব নিয়ে বেশি চর্চা হয়। দুঃখের কথা এই যে প্রাকৃত ভাষার পণ্ডিত এখন দুর্লভ, যে কারণে মৌলিক জৈন সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার অনেকটা অবিজ্ঞাত রয়ে গেছে।

ভারতীয় বস্তুবাদের বিষয়ে আমি উল্লেখ করলাম কিছুদিন আগে প্রকাশিত ইতালিয় পণ্ডিত কৃষ্ণ দেল তোসোর ‘রামকৃষ্ণ ভট্টাচর্যের সঙ্গে কথোপকথন’ শীর্ষক লেখার, যা পড়ে আমার ভালো লেগেছিল, চার্বাক দর্শনের ওপর এতে যে সহজবোধ্য পর্যালোচনা আছে তার কারণে । [লেখাটা পাওয়া যেতে পারে, এই ইন্টারনেট লিংকে: https://www.carvaka4india.com/2014/12/the-wolfs-footprints-indian-materialism.html ] কৌতূহল বশে জিজ্ঞেস করলাম ইতালিয়ান ভদ্রলোকের ‘কৃষ্ণ’ নামের কারণ। ভট্টাচার্য মশাই খোলসা করলেন – দেল তোসোর জনক ছিলেন ভগবদ-গীতার বিশেষ অনুরাগী, তাই দুই ছিলের নাম রেখেছিলেন ‘কৃষ্ণ’ ও ‘অর্জুন’।

কখন দেড় ঘন্টা কেটে গেছে খেয়ালই করিনি। অন্য একজন জ্ঞানার্থী টোকা দিলেন মানবাদর্শবাদী জ্ঞানীর দরজায়। আমরা বিদায় নিলাম। অন্য বারের মতই মনের মধ্যে রয়ে গেল স্থিতপ্রজ্ঞ চিরব্রহ্মচারীর সান্নিধ্যের সুন্দর এক আমেজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top