” কুষ্ঠ “

পোস্টটি দেখেছেন: 22 বাঁকুড়া থেকে সমব‍্যথীর শুভদীপ লেখাটি পাঠিয়েছে। পরিপ্রশ্নের বন্ধু দের সাথে শেয়ার করলাম। বন্ধুরা পুরো টা পড়ুন। স্নেহা লয়ের নোনতা জলে স্নান করে উঠবেন। _-_————_—-++++———————————- ” কুষ্ঠ ” রোগটা প্রথম শুনেছিলাম,রাজা হরিশ্চন্দ্রের গল্পে,রানী শৈবা নিজেকে বিক্রয় করেন ৫০০ সহস্র মুদ্রার বিনিময়ে,এক কুষ্ঠরোগীর সেবার্থে। তারপর ছোটোবেলা কেটেছে,বড়ো হয়েছি,শুনেছি ভারতবর্ষ কুষ্ঠ মুক্ত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে…আরো […]

বাঁকুড়া থেকে সমব‍্যথীর শুভদীপ লেখাটি পাঠিয়েছে। পরিপ্রশ্নের বন্ধু দের সাথে শেয়ার করলাম। বন্ধুরা পুরো টা পড়ুন। স্নেহা লয়ের নোনতা জলে স্নান করে উঠবেন।
_-_————_—-++++———————————-

” কুষ্ঠ ” রোগটা প্রথম শুনেছিলাম,রাজা হরিশ্চন্দ্রের গল্পে,রানী শৈবা নিজেকে বিক্রয় করেন ৫০০ সহস্র মুদ্রার বিনিময়ে,এক কুষ্ঠরোগীর সেবার্থে। তারপর ছোটোবেলা কেটেছে,বড়ো হয়েছি,শুনেছি ভারতবর্ষ কুষ্ঠ মুক্ত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে…আরো শুনেছি উন্নয়ন,কু-সংস্কার দূরীকরণ,অস্পৃশ্যতার প্রতি প্রতিবাদ…!!

কিন্তু অনেক সময় প্রদীপের তলার অন্ধকারটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, সেরকমই এক অন্ধকার আর কিছু মানুষের অভিযোগহীন কষ্টযন্ত্রনাগ্লানির একটা প্রতিচ্ছবির নাম, “স্নেহালয়”,একটি কুষ্ঠাশ্রম।

জায়গাটার প্রথম খোঁজ পেয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে,শুনেছিলাম একাকিত্বের আঙ্গিকে কতগুলো মানুষের জীবন যাপনের গল্প।
গল্পটা খুব বুকে দাগ কেটেছিলো,তাই এবছর মহালয়ার দিন কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কিছুটাকা জোগাড় করে, কিছু নতুন জামাকাপড় নিয়ে স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিলাম গল্পকথায় বাস্তব কতটুকু।

জায়গাটা কিন্তু ভারী সুন্দর…। খোলামেলা চত্বর, বাঁধানো চাতাল.।ছোট্ট একটা পুকুর, তাতে কিলবিল করছে মাছ আর ডুব লাগাচ্ছে ব্যাঙাচি, ব্রিটিশ যুগের পুরানো কিছু ঘরবাড়ী,বড়ো বড়ো গাছের ছায়া,মায়ার আদলে গড়ে তোলা বেদী।
চার দিক পরিস্কার,বাগানে ফুটে রয়েছে নানারকমের ফুল,গাছের শুকনো পাতাগুলোও একপ্রান্তে যত্ন করে গুটিয়ে রাখা, মানুষগুলোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট টের পাওয়া যায় চোখ মেললেই…।
চার দিকে চোখ মেললে যতটা সবুজ দেখা যায়, স্নেহ দেখা যায় আরো বেশি…।

হবে না কেন, ঠিকানাটার নামটাই তো স্নেহালয়…। সত্যিই স্নেহের আলয়…। এক বার সেখানে পৌঁছলে সে স্নেহের জলে না ভিজে ফেরা যায় না…। স্নেহের জলের স্বাদ কিন্তু ঈষৎ নোনতা,নোনতা এই কারনেই যে এতোটা শান্তি এতোটা সবুজের মাঝে ইতিউতি ফুটে রয়েছে দুঃখকষ্টআক্ষেপ।

আমরা প্রথমে গিয়ে যখন ওদের সাথে দেখা করলাম,একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি পেয়েছিলাম অনেকটা ঠিক বহুদিন পর বাড়ী ফিরলে পরিবার যেমন খুশীতে থৈ থৈ করে ওঠে হুবহু এক,যেন কতবছরের চেনাজানা এই অচেনামুখগুলো,এক অদ্ভুত রকমের মায়া ছিলো স্নেহ ছিলো মানুষগুলোর চোখে মুখে।
আমরা আলাপ করলাম,গান করলাম,ওরা আমাদের গান শোনালো আর শোনোলো একআকাশ আক্ষেপের কথা,ঠিক যেমন ভাবে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের বলি।

‘সেই আঠেরো বছর বয়সে এসেছিলাম, এখন তিয়াত্তর…মনে নেই কিছু…।’’
‘‘বর চুপিচুপি খোঁজ নেয়, ছেলেমেয়েরা জানেনা যে আমি বেঁচে আছি,।’’
“দোকানে গেলে আমাদের জিনিষ দেয়না দোকানদার, ডাক্তার দেখতে চায়না ”
“আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়,একবার বাড়ী যাওয়ার,” বাকীকথা টুকু কান্নায় চাপা পড়ে গিয়েছিলো।

আর এই আক্ষেপগুলো শুনে আমাদের চোখে জলের সাথে এসেছিলো প্রশ্ন…. কেনো আজও এরা এমন ভাবে দিন কাটাচ্ছে,বেঁচে থেকে মৃতের ভূমিকা পাঠ করছে রোজ।এরা সবাই সুস্থ, আমার আপনার সবার মতোই,রোগমুক্তির কারো ১০বছর কারোর আবার ১৫বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও আজও তারা স্বাভাবিক মানুষের স্বীকৃতি পেয়ে ওঠেনি,এই উন্নয়নশীল দেশের সবচেয়ে বড়ো অবনয়নের উদাহরণ হয়ে বেঁচে আছে মানুষগুলো।

যেহেতু এরা সবাই কুষ্ঠ সারভাইভার,তাই অনেকের আঙুল নেই,পা নেই,চোখ আছে অথচ দেখা নেই,কিন্তু সবাই সুস্থ,তাদের সাথে মিশলে না জীবানু ছড়াবে, না কুষ্ঠ হবে।
যে সিস্টার ওনাদের দেখভাল করেন, তিনি নিজের উদাহরণ দিয়ে বল্লেন আমি এতোকাল এদের শুশ্রূষা করছি,যদি ওদের রোগ ছড়াত তবে সবার আগে তো আমার হতো। কিন্তু তবুও পরিবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি,কেউ মারা গেলে বাড়ীর লোক বলে তারা দেহ নেবেনা, দোকানে গেলে দোকানদার জিনিষ নেই বলে দূর থেকে তাড়িয়ে দেয়,বয়সজনিত কারনে কাউকে বাইরে ডাক্তারের চেম্বারে দেখাতে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু বলেন “এদের প্লিজ এখানে আনবেন না, আমি জানি এরা সুস্থ,কিন্তু এই আঙুল না থাকা হাত,কাঠের পা এসব দেখে আমার অন্যরুগীরা আসবে না”।
অদ্ভুত লাগেনা? একজন ডাক্তার যাকে আমরা দ্বিতীয় ঈশ্বর মনে করি তিনি সহাস্যমুখে কিভাবে এড়িয়ে যায়,কিরকম ভাবে ব্যবসায়ী রুপ ধারন করেন।

লেপ্রোসি মিশনের অধীন এই কুষ্ঠ-আশ্রমটায় আগে মিশনের তরফে পর্যাপ্ত ফান্ডিং আসত বিদেশ থেকে…। কিন্তু ২০০৫ সালে ভারতকে ‘লেপ্রোসি-ফ্রি কান্ট্রি’ হিসেবে ঘোষণা হবার পর ফান্ডের পরিমাণ শূন্য।
যে রোগ মুছে গেছে তা নিয়ে আর ভাবতে চাননা কেউই….
কিন্তু যে রোগটা মনে থেকে গেছে? মানুষের মনের গভীরে গেঁথে থাকা স্টিগমা, ট্যাবু নামের সামাজিক রোগগুলো যাবে কোথায়…? কুষ্ঠ রোগ নিয়ে ছড়িয়ে থাকা ভুল ধারণাগুলো যাবে কোথায়…?!

প্রায় একবছর হতে চললো ওদের সাথে আমাদের পরিচয়-আত্মীয়তা-সম্পর্কের, আমরা মাঝেমধ্যে জামাকাপড়, বেডশিট,খাবারদাবার নিয়ে যাই বা বাইরের কোনো এন.জি.ও কে বলে ওদের জুতো বা ব্যবহারীক সামগ্রী জোগাড় করি, বা কোনোবার এমনিই যাই গল্প করতে, দোলনায় দোল খেতে,মন্টু দা, কাজল দিদি কেমন আছে দেখতে,ব্যানার্জি পিসি খুব আবেগী,কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে, “বাবা এতোদিন দেরী করে কেনো এলে?” “কেমন আছো?” “পড়াশুনো করছো কেমন ” এসব প্রশ্ন করে,সিস্টার চা খাওয়ান।

বেঁচেথাকার জন্য একটু খাবার আর সামান্য যা কিছু দরকার তা জুটে যায়,যেটার অভাব বেশী তা হলো ভালোবাসার,চাইলে আপনি কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসতেই পারেন,কথাদিচ্ছি আপনি স্নেহালয়ে গেলে যতটা স্নেহ পাবেন,যতটা আন্তরিকতা পাবেন, তা এই চারপাশে আগাছার মতো ছড়িয়ে থাকা মেকি ভালোবাসার চেয়ে অনেক নিখাদ, অনেক আপন।

-শুভদীপ গিরি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top