ধাতৃগৃহ থেকে কবরস্থান—ভারত ও পাকিস্তানে ঘৃণার চাষ

এই ঘৃণা হঠাৎ তৈরী  হয়েছে  এমনটা  নয় । এটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। দেশভাগের সময়কার আতঙ্ক, অসমাধিত নানা বিরোধ, প্রতিশোধমূলক হিংসাত্মক ঘটনা—এমন অনেক কিছু মিলিয়েই তৈরি হয়েছে শত্রুতার এই বন্ধুর  প্রান্তর।

ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব

ভারত ও পাকিস্তানে শিশুদের দানব বা শয়তানকে ভয় পাওয়া শেখানো হয় না, শেখানো হয় নিজের প্রতিবেশীকে ভয় পেতে। ‘শত্রু’ বলা হয় তাকে। ইতিহাসের এমন সব বর্ণনার ভিত্তিতে একটি কল্পিত ছবি গড়ে তোলা হয়, যা তারা কখনও নিজেরা অনুভব করেনি, যেসব ঘৃণার তারা কোনোদিন অংশ ছিল না। ভারত ও পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মননে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এক ধরনের সামাজিক পাঠক্রম—যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ‘আমরা বনাম ওরা’র যুদ্ধের মঞ্চ। এ যুদ্ধ ট্যাঙ্ক বা পারমাণবিক অস্ত্রের নয়, বরং অনেক বেশি নিষ্ঠুর—এটি মানুষের মনের গভীরে শিকড় ছড়ানো ঘৃণার যুদ্ধ। দু’ভাইয়ের মতো জাতির নাগরিকরা ধর্মের উন্মাদনায় বিভোর ও বিবাদমান।

এই ঘৃণা হঠাৎ তৈরী  হয়েছে  এমনটা  নয় । এটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে। দেশভাগের সময়কার আতঙ্ক, অসমাধিত নানা বিরোধ, প্রতিশোধমূলক হিংসাত্মক ঘটনা—এমন অনেক কিছু মিলিয়েই তৈরি হয়েছে শত্রুতার এই বন্ধুর  প্রান্তর। আজকের ডিজিটাল যুগে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধুই যোগাযোগের জায়গা নয়—এটা হয়ে উঠছে জাতীয়তাবাদের প্রতিধ্বনি কক্ষ, একধরনের চমৎকার মানসিকপ্রভাব বিস্তারকারী অস্ত্র। এই  মাধ্যমের দূরত্ব এবং গোপনীয়তা, ঘৃণা ছড়ানোর জন্য আদর্শ জমি তৈরি করে দিয়েছে। এখন ঘৃণা পোস্ট করা যায়, লাইক করা যায়, শেয়ার করা যায়।

এই সাইবার জাতীয়তাবাদ  দীর্ঘায়ু  সন্ত্রাসবাদের চেয়েও বিপজ্জনক। এসব অনলাইন যোদ্ধারা বন্দুক বহন করে না, তারা বহন করে এমনসব বর্ণনা যা জাতীয়তাবাদের উত্তেজনা ছড়ায় এবং বিপরীত পক্ষের জন্য ঘৃণার চাষ করে। যখন ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে, বলে যে এটা পাহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের (যেখানে ২৬ জন পর্যটক নিহত হন) প্রতিশোধে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযান,  যদিও পাকিস্তান একে যুদ্ধ ঘোষণা বলে আখ্যা দেয় এবং দাবি করে যে এতে বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।

কিন্তু কূটনীতিকরা কথা বলার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ইনস্টাগ্রাম, টুইটার,  এবং হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদিতে ( কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াসহ—অনুবাদক। Accountability of the media in sensitive timesপাকিস্তানপন্থী বলে দাবি করা অ্যাকাউন্টগুলো পুরনো ও সম্পর্কহীন ভিডিওকে অপারেশন সিঁদুরের ফলাফল বলে শেয়ার করে ।  অপরদিকে, ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলো দেশপ্রেমের স্লোগান ‘জয় হিন্দ’ ছড়িয়ে দেয়, যার সাথে থাকে পাকিস্তান ও পাকিস্তানিদের প্রতি বিষাক্ত গালিগালাজ। ধর্মভিত্তিক অশ্রাব্য কুটুক্তি দেশপ্রেমকে রূপান্তর করে উগ্রজাতীয়তাবাদে।  আরও ভয়াবহ উদাহরণ হলো— যখন একজন ভারতীয় অলিম্পিক খেলোয়াড়  কেবলমাত্র এক পাকিস্তানির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার কারণে অবর্ণনীয় গালিগালাজের শিকার হন।

পাহেলগাঁওয়ে যা ঘটেছে তা মানবতাবিরোধী, নৃশংস এবং কঠোরভাবে নিন্দনীয়। এই ঘটনার বিচার হওয়া উচিত শান্তির মাধ্যমে। কিন্তু যেটা আজকের মিডিয়ার জগতে ঘটছে তা আরও বিষাক্ত এবং অমানবিক। এটা শুধু সরকারের নীতির ফল নয়, বরং ছোটবেলা থেকেই সমাজে ঢুকিয়ে দেওয়া মতাদর্শগত শিক্ষা। অনেকে সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ‘অন্যকে ঘৃণা করাই দেশপ্রেম’—যে ভারতীয় বা পাকিস্তানিকে গালি দেওয়াই নাকি জাতীয় কর্তব্য। কিন্তু এটা দেশপ্রেম নয়। এটা আদর্শিক সন্ত্রাসবাদ—যা শারীরিক সন্ত্রাসের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক, কারণ এটা নৈতিকতার মুখোশ পরে থাকে।

কমপক্ষে একজন সন্ত্রাসবাদী জানে সে কীসের জন্য লড়ছে, কিন্তু এসব সোশ্যাল মিডিয়া যোদ্ধারা লড়ে শুধুই এক শূন্যতা থেকে—যেটা তৈরি হয় ভয়, ভুল তথ্য এবং সমাজের শেখানো বিভাজনমূলক মানসিকতার মাধ্যমে। এই শূন্যতা তৈরি হয় শৈশব থেকে—যখন ভালোবাসার শিক্ষা নয়, বরং ভয়কে ভালোবাসতে শেখানো হয়। ভালোবাসার মানে যদি ঘৃণা হয়, তাহলে তা আর ভালোবাসা নয়। যদি ভালোবাসার জন্য শত্রু দরকার হয়, তাহলে তা আসলে নিরাপত্তাহীনতা।

১৯৪৭ সাল থেকে ইতিহাস শেখাতে গিয়ে আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো করুণা শেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় পরিচয় গড়ার তাড়ায় তারা মানবতার সাধারণ নীতিগুলো ভুলে গেছে। শিশুদের বড় হওয়ার সাথে সাথে মিডিয়া এই পক্ষপাত আরও গভীর করে তোলে। সত্য ও প্রচারের মাঝে পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়, সুশৃঙ্খল সমালোচনামূলক চিন্তার  জায়গা দখল করে  গল্পকথার ঝাঁক । সত্য তখন ঐচ্ছিক হয়ে যায়, বিচার হয়ে ওঠে আনুগত্যের বিষয়।

যখন জীবন ধ্বংস হয় এবং পরিচয় অস্ত্রে পরিণত হয়—তখন আইন কোথায়? আন্তর্জাতিক আইন এই ঘৃণার সামনে অসহায়। ‘আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ’ -এর অনুচ্ছেদ ২০(২) বলে — কোনো জাতীয়, জাতিগত বা ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর মতো কাজ যা বৈষম্য, শত্রুতা বা হিংসা উসকে দেয়—তা আইনত নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু এই আইনের সম্মান হয় শুধুই লঙ্ঘনের মাধ্যমে।

‘গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি প্রদান’ সংক্রান্ত কনভেনশনের অনুচ্ছেদ II(২) বলছে—“মানসিক ক্ষতি” গণহত্যার অন্তর্ভুক্ত। তাহলে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসীদের কে দায়ী করবে তাদের মানসিক গণহত্যার জন্য?এসবের সংস্কার কি বাধ্যতামূলক নয়? একটা ভালো বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়ন কি বাধ্যতামূলক নয়? আন্তর্জাতিক আইন স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোর কি দায়িত্ব নয় তা প্রয়োগ করা?

সমস্যা আইনের অভাব নয় বরং সদিচ্ছার অভাব, সমস্যা সমানুভূতিকে হৃদয়ে  পোষ মানিয়ে রাখার মধ্যে। হোক না সেটা ডিজিটাল—হিংসা, হিংসাই। আন্তর্জাতিক আইন কি আরও এগিয়ে এসে “ডিজিটাল হিংসা”কে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না?

বিশ্বের প্রয়োজন মোটেই একরকম হওয়া  উচিত  নয়, বরং প্রয়োজন একটা সর্বজনীন মানবতা। আরও কঠোর  সীমান্তই  সমাধান  নয়, বরং প্রয়োজন এমন মন তৈরী  করা যা নমনীয়—যা অন্য দেশের নাগরিককে গালি না দিয়ে বরং এতটুকু মানবতা দেখাতে পারে যে নিরপেক্ষ এক তদন্তকারী সংস্থা গঠিত হোক, যারা জাতীয় সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে উঠে মিডিয়াতে প্রচারিত বর্ণনার সত্যতা যাচাই করবে। শুধু পাহেলগাঁও নয়, শুধু অপারেশন সিঁদুর নয়—যে কোনো সংঘাতে যেখানে তথ্য অস্ত্রে পরিণত হয়।

মানচিত্র হতে পারে রাজনৈতিক, কিন্তু যন্ত্রণা  সর্বজনীন। তাই বিচারও হতে হবে সর্বজনীন।

 মূল লেখা : এম অশ্বিন রোম (বিশিষ্ট আইনজ্ঞ)

সূত্র : countercurrent. org

ভাষান্তর : বঙ্কিম  দত্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top